
চব্বিশের জুলাইয়ে দীর্ঘ স্বৈরশাসন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিল পুরো জাতি। সেই সময়ে সবচেয়ে বিপৎসংকুল সম্মুখ সারিতে ছিলেন নারীরা। আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছড়িয়েছেন সাহস ও দ্রোহের বার্তা। রাজপথ, মিটিং, মিছিল, সংগঠন— সবখানেই নারীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো।
গত বছর রক্তাক্ত জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটে। সেই জুলাই পেরিয়ে আরেক জুলাই। মাঝখানে একটা বছর। রক্তঝরা সেই জুলাই আন্দোলনে যে নারীরা সামনে থেকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন তাদেরই একজন শারমিন আক্তার। আবু সাঈদের প্রসারিত দুই হাত তাকে ঘর থেকে বের করে এনেছিল। রাষ্ট্রযন্ত্রের বন্দুকের নল আর ক্ষমতাসীনদের দেখানো ভয়ভীতি উপেক্ষা করে রাজপথে নেমে এসেছিলেন শারমিন। তার মতো রাজপথে থাকা হাজারো সাহসী নারী উন্মোচিত করেছে ইতিহাসের এক নতুন দিগন্ত
ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বছর না ঘুরতেই সেই নারীদের ত্যাগ, সাহসিকতা ও অনুপ্রেরণাকে ভুলতে বসেছে জাতি— এমনটাই মনে করছেন রংপুর সরকারি কলেজের ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষের প্রাক্তন শিক্ষার্থী শারমিন আক্তার। ইতিহাস বিভাগে স্নাতকোত্তর শেষ করা এই সাহসী নারী বর্তমানে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় চাকরি করছেন।
৩৬ জুলাইয়ে এক দফার সফল গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী শারমিন আক্তার চলে গেছেন আড়ালে। কিন্তু মন থেকে আড়াল হয়নি চোখের সামনে ভেসে বেড়ানো জুলাইয়ের প্রাণঝরা আর্তনাদের দিনগুলো। ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে সেই স্মৃতিচারণ করেছেন শারমিন আক্তার।
আবু সাঈদের প্রসারিত দুই হাত ঘরে থাকতে দেয়নি
সাহিত্য ও সংস্কৃতিনুরাগী এই নারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৩৬ জুলাইয়ের শুরুটা কোটা আন্দোলন দিয়ে শুরু হলেও প্রথম দিকে এই আন্দোলনে আমার কোনো আগ্রহ ছিল না। যা হচ্ছে হোক, কোটা থাকলেও পড়াশোনা করতে হবে, না থাকলেও করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই— এই ভেবে আন্দোলন নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। আমি তখন চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ১৩ জুলাই আমার একটা পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষার অপেক্ষায় বাড়িতে যাওয়া পিছিয়ে যায়। পরীক্ষা দিয়ে পরের দিন সকালে চলে যাই। বাড়িতে গিয়ে ফেসবুকে খুব একটা আসা হয়নি। ১৬ জুলাই যখন দেখলাম বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র (আবু সাঈদ) পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। দেশের অন্যান্য জায়গাতেও আরও কয়েকজন নিহত! তখন আর চুপ করে থাকতে পারছিলাম না।
এর মধ্যে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। যে যেভাবে পারছে রংপুর ছাড়ছে। নিরাপদ স্থানে সরে যাচ্ছে, মেস এলাকাগুলো ফাঁকা পুরো। পুলিশের তল্লাশি, ধরপাকড়ের জন্য ছেলেদের মেসে কেউ থাকতে পারছিল না। এই অবস্থায় গ্রামের বাড়ি থেকে আমি ২৭ জুলাই রংপুরে চলে আসি। যোগ করেন শারমিন আক্তার।
সেই দিন গা ছমছম করেছিল
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে খানিকটা চুপ করে ছিলেন শারমিন। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ঝেড়ে ফেলে বললেন, আমি যখন পার্কের মোড় দিয়ে শহরে ঢুকছিলাম চারপাশে কোনো মানুষের দেখা নেই। একটা-দুটো অটোরিকশা যাতায়াত করছিল। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটা কুকুর পর্যন্ত শুয়ে বা দাঁড়িয়ে ছিল না। গা ছমছম করে উঠলো। মেসে পৌঁছে সবার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলাম। পরের দিন সকালে সশরীরে আন্দোলনে যুক্ত হই। বৃষ্টিতে ভিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট থেকে মডার্ন এলাকা পর্যন্ত আমাদের মিছিল ঘুরে আসে। পরের দিন প্রচণ্ড রোদ। আমরা মডার্ন মোড়ে গিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করি। সবার মধ্যে আতঙ্ক এবং অধিকার আদায়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। তখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার পতনের ডাক পড়েনি। পুরো বাংলাদেশ উত্তাল। দিনদিন মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে আর মানুষ ফুঁসে উঠছে। পরের দিন প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন এবং মিছিল বের করে রংপুর শহর ঘুরে টাউন হলের সামনে বসলাম। সেদিনও (৩ আগস্ট) প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল।
৪ আগস্ট রংপুরে ভয়াবহ দিন গেছে। সেই দিন সম্মুখ লড়াইয়ে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের ঘণ্টা বাজে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর গুলিবর্ষণ, দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা করেও শেষ পর্যন্ত মাঠে টিকে থাকতে পারেনি সরকার দলীয়রা। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কয়েকজনের মৃত্যু হয়।
মনে হচ্ছিল আমি মরে যাব
শারমিন আক্তার বলেন, সেই দিনটি (৪ আগস্ট) আমার কাছে সব থেকে ভয়াবহ ছিল। আমি সকালে বাড়িতে ফোন করে আন্দোলনে যাওয়ার জন্য অনুমতি নিই। এর আগে কখনো বাড়িতে বলা হয়নি আমি আন্দোলনে আছি। কারণ, তখন ভয় ছিল না। কিন্তু আগের দিন রাতে যখন জানতে পারি আওয়ামী লীগ আমাদের ওপর হামলা করবে। তখন আমার ভয় করছিল যদি মরে যাই। সেদিন পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে ছিল। মনে প্রচণ্ড ভয়, তবুও মুক্তির আশায় টাউন হলের সামনে গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে বসে যাই। ছেলেরা চারপাশে আমাদের ঘিরে রাখে যাতে আঘাত আসলে প্রথমে আমরা আহত না হই। আন্দোলনের একপর্যায়ে শোনা গেল সরকার দলীয়রা অস্ত্র হাতে সামনে এগিয়ে আসছে। আমরা মেয়েরা তখনও বসেই ছিলাম। আমাদের ছেলেদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছিল। হঠাৎ কয়েকজনের মৃত্যুর খবর আসার পরই আমরা যে যার মতো নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে ছুটতে থাকি।
আমি তখন টাউন হলের ভেতরে ঢুকতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই। আমার গায়ের ওপরে একজনের পর একজন, এভাবে অন্তত আট-দশজন পড়ে যায়। সেখান থেকে উঠে দেখি আমার হাতে থাকা ফোনটি ভেঙে গেছে। হাতের কয়েক জায়গা থেকে রক্ত পড়ছে। রাস্তায় গিয়ে অনুভব করতে পেলাম আমার মাথা চক্কর দিচ্ছে। যেকোনো সময় পড়ে যেতে পারি। আমার পাশে থাকা নওরিনকে জড়িয়ে ধরি। সকালে না খেয়ে আন্দোলনে এসেছিলাম। কড়া রোদ, তার মধ্যে না খেয়ে থাকা; আমার মনে হচ্ছিল মরে যাব। আমার বাবা-মা আমার খোঁজ পাবে না— বলেন শারমিন।
দৃষ্টিভঙ্গি না বদলালে স্বৈরাচার বদলিয়ে লাভ হবে না
ঢাকা পোস্টকে শারমিন আক্তার বলেন, ৫ আগস্ট দুপুর ২টা। রংপুরে বৃষ্টি হচ্ছিল। হঠাৎ রুমমেট চিৎকার করতে করতে এসে আমাকে জানালো শেখ হাসিনা পালিয়েছে। রাস্তায় বের হয়ে দেখি আনন্দ মিছিল। সবার চোখে-মুখে অন্যরকম ভালোলাগার বহিঃপ্রকাশ। কেউ কেউ বলছিল, শেখ হাসিনার পতনে রহমতের বৃষ্টি ঝরছে। সেদিন রাতে যখন খবর শুনছিলাম তখন মনটা খারাপ হতে লাগলো। আমি চেয়েছিলাম বৈষম্যহীন একটা দেশ ও সমাজ। অথচ একটা দিন পার না হতেই দেশের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় মারামারি, ভাস্কর্য ভাঙা এবং মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা। তখন মনে হচ্ছিল এক স্বৈরাচারের পতনে যেন আরেক স্বৈরাচারের আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে। এখন অনেক কিছু দেখে মাঝেমধ্যে মনে কষ্ট লাগে। আন্দোলনের সময় ফোনে কয়েকটা ছবি তুলেছিলাম, সেটাও অভিমানে মুছে ফেলেছি। আমি প্রচার চাই না, আমি চাই সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। ন্যায্যতা ফিরুক, ভীতি কাটুক। নারী সম্মান নিয়ে বাঁচুক।
শারমিন আরও বলেন, শেখ হাসিনা পলায়নের এক বছর হলো। এই এক বছরে যত নারী ধর্ষিত হয়েছে, যত মানুষ খুন হয়েছে, তা দেশের ইতিহাসে রেকর্ড। এখন নারীর ক্ষমতায়নের কথা মুখে মুখে শোনা যায়, কাজে বিন্দুমাত্র বহিঃপ্রকাশ নেই। নারীরা শঙ্কিত, কখন কে এসে বলবে তোমার হিজাব কোথায়, বোরকা কোথায়? নারীর কাপড় টেনে খুলে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে এই এক বছরে। আমি নিজেও একজন নারী এবং এনজিওকর্মী। আমি বোরকা ও হিজাব ব্যবহার করি না। এজন্য অনেক ধরনের কটু কথা শুনতে হয়। নারীরা জুলাইয়ে যেভাবে সামনের সারিতে ছিল এখন কিন্তু নেই। বিভিন্নভাবে তাদের সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এটা নারীর প্রতি অবহেলা, অবমূল্যায়ন। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি না বদলালে স্বৈরাচার বদলিয়ে কোনো লাভ হবে না।
জুলাইয়ের সাহসী নারীরা যে কারণে আড়ালে
নিজেকে আড়াল করার প্রসঙ্গ টেনে শারমিন বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, রাজনৈতিক ও পারিবারিক চাপ— সবকিছু মিলে জুলাইয়ের আন্দোলন শেষে অনেক নারী আড়ালে চলে গেছেন। কেউ কেউ ফিরে গেছেন পড়ার টেবিলে। তাদের অনেকেই এখন আর সেই সময়কার স্মৃতি, ত্যাগ, ভয়াবহতা ও সাহসিকতার কথা বলতে চান না। অথচ ৩৬ জুলাই আন্দোলনের অন্যতম অধ্যায়ের সঙ্গে যুক্ত আমাদের মায়েরা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা। তাদের ত্যাগ ও সাহসিকতা তাৎপর্যপূর্ণ। আমাদের মায়েরা দেশের জন্য সন্তানদের মায়া ত্যাগ করেছিলেন। আর আমরা আন্দোলনের সম্মুখে থেকে সংগ্রামী-সাহসী যোদ্ধা ভাই-বোনদের দিয়েছি সাহস, অনুপ্রেরণা ও আশ্রয়।
সাহসী এই নারীর মতে, জুলাই আন্দোলনে রাজপথে নারীরা সাহসিকতার পরিচয় দিলেও রাজনীতির রোষানলে ও সমাজের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে হারিয়ে গেছেন আলোচনার পরিধি থেকে। জুলাই নারীদের প্রাপ্য সম্মান দিতে না পারলে এভাবেই আড়ালে রয়ে যাবেন তারা।
নারী সংগঠকরা যা বলছেন
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়-বেরোবি শাখার সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা রিনা মুরমু বলেন, জুলাইয়ের নারীরা জুলাই অভ্যুত্থানে সাহসিকতা, নেতৃত্ব ও প্রতিরোধের এক নতুন ইতিহাস গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু এই অবদান অস্বীকৃত রেখে আক্রমণ ও নিরাপত্তাহীনতার সংস্কৃতি দিয়ে তাদের ম্লান করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এজন্য জুলাইয়ের নারীদের সক্রিয় হতে সরকার, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। নারীদের ন্যায্য হিস্যা, অংশগ্রহণ, নিরাপত্তা ও স্বীকৃতিপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, গণঅভ্যুত্থানে নারীদের অবদান স্বীকার করলেই তো তাদেরকে স্টেক দিতে হবে বিভিন্ন জায়গায়। নারীর অধিকার চাইলেই এখন ট্যাগিংয়ের শিকার হতে হচ্ছে। যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হয়েছে বৈষম্য দূর করার জন্য, সেখানে আমরা নারীরাই বেশি বৈষম্যের শিকার হচ্ছি।
সম্প্রতি রংপুর শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে মানবাধিকার ও পরিবেশ আন্দোলন আয়োজিত করেছিল ‘মুক্তিযুদ্ধ থেকে জুলাই অভ্যুত্থান : নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বপ্ন, সংগ্রাম ও অর্জন’ শীর্ষক আলোচনা সভা। এতে আলোচক ছিলেন শ্রম সংস্কার কমিশনের সদস্য রাজেকুজ্জামান রতন ও যুক্তরাষ্ট্র উস্টার স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অব ইন্টারডিসিপ্লিনারি স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নাফিসা তানজীম।
বক্তারা বলেন, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে এক মেয়ে পুলিশের ভ্যান ঠেকিয়ে দিয়েছিল। ছেলে সমন্বয়কদের সঙ্গে এক মেয়ে ডিবির হাতে গ্রেপ্তার হয়। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সেই মেয়েরা কোথায়? তারা ঘরে ফিরে গেছে, কেউ আর খোঁজ রাখেনি তাদের! দেশের নারীরা ঘরে সন্তান লালন-পালন করলেও তাদের মূল্যায়ন করা হয় না। আলোচনা সভায় বেগম রোকেয়ার চোখ দিয়ে সমাজের দুটি চাকার মতো নারীদের একটি চাকা হিসেবে দেখার আহ্বান জানানো হয়।
