
‘আমি পায়ের দিকে তাকাতে পারি না। আমার পায়ের উপর দিয়ে ট্রাক চলে গেছে। পঙ্গু জীবনটা নিয়ে আমাকে কে টানবে? এ কথা বলতেই অঝোরে কেঁদেছেন বেতার শিল্পী মুনিবুন ফেরদৌস মনি। ৩৫ বছর বয়সী এই বেতার শিল্পী প্রতিদিন কন্ঠ দিয়ে ছুঁয়েছেন মানুষের মন। আজ নিজেই হয়েছেন নিঃশব্দ এক বেদনার গল্প। ট্রাকের নিষ্ঠুর চাকায় থেমে গেছে তার পায়ের পথচলা। এখন হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন তিনি।
মুনিবুন ফেরদৌস মনি বলেন, আমি ঠাকুরগাঁও বেতারের উপস্থাপক, নাট্যশিল্পী ও সংবাদ পাঠক। ভাইয়ের সঙ্গে মোটরসাইকেলে করে বেতারে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় আমি দুই পা হারাই। আমাদের শিল্পীদের যাতায়াতের জন্য কোনো গাড়ির ব্যবস্থা নেই। একাধিকবার কর্তৃপক্ষকে জানালেও আমাদের বলা হয় বেতারে পর্যাপ্ত বাজেট নেই। শীতের সময় সকাল ৬টায় অন্ধকারে আমাদের মতো শিল্পীদের কষ্ট করে বেতারে আসতে হয়। আমরা একটি গাড়ি চাই, যেখানে নিরাপদে যাতায়াত করতে পারবো।
কাঁদতে কাঁদতে মনি আরও বলেন, বেতারে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি। সেই কাজের প্রতি ভালোবাসার কারণে আজ পা হারালাম। আমাকে যদি বেতারে কাজের সু-ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে আমি কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবো। সেইসঙ্গে আমার কৃত্রিম পা লাগানোর ব্যবস্থা যেন সরকার করে। আমরা শিল্পী, আমরা কারো সহযোগিতা নেওয়ার মানুষ না। এরপরেও পরিস্থিতির কারণে আমি অসহায় হয়ে পড়েছি। আমি আমার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই।
মনির বড় বোন আক্তার জাহান বলেন, মনি বিয়ে করেনি। আট ভাই-বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। বাবা তিন বছর আগে মারা গেছেন। মা হার্টের রোগী। মনিই তার সেবাযত্ন করতো। মা বারবার জানতে চাচ্ছে মনি কোথায়, কিন্তু হার্টের রোগী হওয়ায় তাকে বলার সাহস পাচ্ছি না। মাকে কি জবাব দেব। এত বড় দুর্ঘটনার পরও মনি জীবন যুদ্ধে হেরে যায়নি। সে কারো বোঝা হয়ে থাকতে চায় না। নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে বেতারেই যেন তার একটি স্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা করে দেয় সরকার। তাহলে কর্মের মাঝে ডুবে থেকে সে নিজের কষ্ট ভোলার চেষ্টা করবে।
তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত যতটুকু খরচ হয়েছে আমরা চালিয়ে নিয়েছি। কিন্তু কৃত্রিম পা সংযোজন ও উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। এজন্য সরকারের পাশাপাশি সমাজের সামর্থ্যবান মানুষের প্রতি আকুল আহ্বান আমার বোনের জন্য সবাই এগিয়ে আসুন।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগের চিকিৎসক সানিউজ জাহান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় মনির দুই পা একদম বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। বাম পায়ে এখনও ইনফেশন কন্ট্রোল হয়নি। তার ড্রেসিং চলছে। আমরা সাধ্য অনুযায়ী তার সুচিকিৎসার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
মানবাধিকার কর্মী ও বেতার শিল্পী অ্যাডভোকেট জোবাইদুল ইসলাম বলেন, বেতারের প্রতিটি কেন্দ্রে শিল্পীদের যাতায়াতের জন্য গাড়ি বরাদ্দ আছে। কিন্তু বেতার কর্মকর্তারা তাদের নিজেদের জন্য সেই গাড়ি ব্যবহার করেন। তাই আজ মনির মতো শিল্পীরা নিরাপদ পরিবহনের অভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় জীবনের সর্বস্ব হারিয়ে ফেলেছেন। অবিলম্বে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টাসহ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যেন মনির পাশে দাঁড়ান আমি সেই আহ্বান জানাচ্ছি।
উল্লেখ্য, গত ৩ জুলাই সকালে বড় ভাইয়ের মোটরসাইকেলে করে ঠাকুরগাঁও বেতার কেন্দ্রের দিকে আসছিলেন মুনিবুন ফেরদৌস মনি। ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় সড়কের সালন্দর চৌধুরীহাট বাজার এলাকায় পৌঁছলে মোটরসাইকেল থেকে রাস্তায় পড়ে যান মনি। এ সময় একটি মালবোঝাই ট্রাক মনির দুই পায়ের উপর দিয়ে চলে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোসার্জারী বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন রয়েছে। মনি ঠাকুরগাঁও সালন্দর ইউনিয়নের চৌধুরীপাড়ার বাসিন্দা।
