আর্থনা সম্মেলনে যোগ দিতে চার দিনের সফরে কাতার যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সরকার প্রধানের সফরটি সম্মেলনে যোগ দেওয়ার উপলক্ষ্য হলেও মূল লক্ষ্য কাতারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা। এক্ষেত্রে তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) নিরবচ্ছিন্ন আমদানি, নতুন কর্মীর কর্মসংস্থান ও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া কিছু রোহিঙ্গাকে কাতারে পুর্নবাসনের অনুরোধ জানাতে পারে বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সোমবার (২১ এপ্রিল) কাতার যাবেন প্রধান উপদেষ্টা। কাতার ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে দোহায় আগামী ২২-২৩ এপ্রিল আর্থনা সম্মেলন-২০২৫ অনুষ্ঠিত হবে। সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেবেন ড. ইউনূস। কাতার সফরকালে দেশটির আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে অধ্যাপক ইউনূসের।
দেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের চারজন জাতীয় নারী ক্রীড়াবিদ প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হিসেবে কাতার যাচ্ছেন। সম্মেলনের প্রতিপাদ্য- ‘আমাদের উত্তরাধিকার গড়ে তোলা : স্থায়িত্ব, উদ্ভাবন ও ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান’।
সরকারপ্রধানের কাতার সফরের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, প্রধান উপদেষ্টা আর্থনা সম্মেলনে যোগ দিতে কাতার সফর করবেন এটা ঠিক। কিন্তু এই সফরের তাৎপর্য কাতারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা। প্রধান উপদেষ্টা কাতারের আমিরের সঙ্গে বৈঠক করবেন। তাদের আলোচনায় দুই দেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ, এলএনজি আমদানি, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা বা নতুন করে কর্মীর কর্মসংস্থান, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি; বিশেষ করে গাজায় ইসরায়েলি হামলা বা ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে আলাপ-আলোচনা হওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হবে। এছাড়া, রোহিঙ্গা সংকট ও সমাধান নিয়ে আলোচনায় গুরুত্ব দেবে বাংলাদেশ।
খসড়া সূচি অনুযায়ী, সোমবার রাতে দোহার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়বেন প্রধান উপদেষ্টা। সফরের দ্বিতীয় দিন তিনি আর্থনা সম্মেলনে যোগ দেবেন ও বক্তব্য রাখবেন। পরে কাতার চ্যারিটির আন্তর্জাতিক অপারেশনসের সহকারী প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নাওয়াফ আবদুল্লা আল হামোদি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। একইদিন কাতারের আমিরের মাতা ও কাতার ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন মোজা বিনতে নাসেরের সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের বৈঠকের কথা রয়েছে। পরে প্রধান উপদেষ্টা কাতার ফাউন্ডেশন পরিদর্শন করবেন।
একইদিন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে অধ্যাপক ইউনূসের। পরে কাতারের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী সাদ বিন সেরিদা আল কাবিরের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের কথা রয়েছে। এছাড়া, প্রধান উপদেষ্টার কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার প্রধান অফিস পরিদর্শনে গিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করার পাশাপাশি একটি সাক্ষাৎকার দেওয়ার কথা রয়েছে।
সফরের তৃতীয় দিন রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে এক গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে ড. ইউনূসের। একইদিন কাতারের শিক্ষামন্ত্রীর অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের কথা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশে গ্যাসের উৎপাদন কমছে। এ কারণে এলএনজি আমদানি বাড়ানো জরুরি। কিন্তু ডলার সংকট থাকায় আমদানি বিল নিয়মিত পরিশোধ করা যাচ্ছে না। প্রধান উপদেষ্টার কাতার সফরে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ দেশটি থেকে নিরবচ্ছিন্ন এলএনজি আমদানি সরবরাহে সহযোগিতা চাইবে বাংলাদেশ।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ কাতারের কাছ থেকে এলএনজি আমদানি করে থাকে। এ নিয়ে দেশটির সঙ্গে চুক্তিও আছে। মাঝখানে ডলার সংকট থাকায় আমদানি বিল নিয়মিত পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। এ সমস্যা কিছুটা কেটে গেছে। তবে বাংলাদেশ এমন পরিস্থিতি চায়, আমদানি বিল বন্ধ হলেও যেন কাতার বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন এলএনজি সরবরাহ করে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগামী অর্থবছরে (২০২৫-২৬) এলএনজি কিনতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিচ্ছে সরকার। এলএনজি কিনতে সরকার বিশ্বব্যাংকের কাছে ৭০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা চায়। দীর্ঘমেয়াদি ও স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির জন্য ৭০ কোটি ডলারের ঋণ সুবিধা নিতে বহুজাতিক এ দাতা সংস্থাটির সঙ্গে আলোচনা চলছে। চলতি বছরে দ্বিতীয়ার্ধে এ ঋণ সুবিধার বিষয়ে চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে। বর্তমানে বিষয়টি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং বিশ্বব্যাংকের মধ্যে আলোচনা চলমান আছে।
এলএনজি আমদানির বাইরে সরকারপ্রধানের সফরে গুরুত্ব পাবে কাতারে বাংলাদেশি কর্মীর কর্মসংস্থান ও রোহিঙ্গা সমস্যা। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির গুরুত্বপূর্ণ একটি বাজার কাতার। প্রায় চার লাখের মতো বাংলাদেশি বর্তমানে দেশটিতে কাজ করেন। ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনে বাংলাদেশি কর্মীরা কাতারে অবকাঠোমো নির্মাণে অবদান রেখেছেন। ওই সময়ে বাংলাদেশি কর্মীদের কর্মসংস্থানের জন্য কাতারকে ধন্যবাদ জানানো হবে। পাশাপাশি নতুন করে যেন কর্মী নেয় দেশটি সেই অনুরোধ করবে বাংলাদেশ। কাতার এখন বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা, প্রকৌশলসহ নানা ক্ষেত্রের দক্ষ লোকজনকে কাজে নিতে চায়। তবে অল্প দক্ষ শ্রমিকদেরও যেন নেওয়া হয়, সেই অনুরোধ করবে বাংলাদেশ।
রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া কিছু রোহিঙ্গাকে কাতারে পুর্নবাসনের অনুরোধ জানাবে বাংলাদেশ। সেটি যদি তারা নাও করে আমরা চাইব, কাতার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আমাদের সহযোগিতা করুক। এছাড়া, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দিয়ে পাশে থাকুক দেশটি।
সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে ২৪ এপ্রিল দেশের উদ্দেশে রওনা হবেন প্রধান উপদেষ্টা।
প্রসঙ্গত, ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর গত বছরের ৮ আগস্ট অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দেন। এরপর নভেম্বরে আজারবাইজানে কপ-২৯ সম্মেলনে যোগ দেন প্রধান উপদেষ্টা। গত ডিসেম্বরে ড. ইউনূস ডি-৮ সম্মেলনে যোগ দিতে মিসর সফর করেন।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (উব্লিউইএফ) বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেন তিনি। এরপর মার্চে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সফরে চীন যান অধ্যাপক ইউনূস। সবশেষ, এপ্রিলে থাইল্যান্ড সফর করেন তিনি।