দুই বিদশেী নাগরিক খুন হওয়ার পর রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। মূল সড়ক থেকে শুরু করে রাজধানীর অলিগলিতে বসানো হয়েছে চেকপোস্ট। বাড়ানো হয়েছে ফুট পেট্রল, ভেহিক্যাল পেট্রল। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারিও। কিন্তু এত নিরাপত্তার পরও থেমে নেই অস্ত্রবাজ-ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য। ঘটেছে বোমাবাজির মতো ঘটনা। রাজধানীতে রাতে চেকপোস্টে পুলিশ খুনের ঘটনা পর হোসনী দালানে শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর বোমা হামলার ঘটনায় নিরাপত্তার প্রশ্নটি আবার সামনে এসেছে। হোসনী দালানের ঘটনার সময় পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্যন্য সদস্যরা ওই এলাকায় দায়িত্ব পালন করছিলেন। এমন অবস্থায় এ ধরণের একটি হামলার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা।
গত সোমবার প্রকাশ্য দিবালোকে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে চার সন্ত্রাসী এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি করে ২৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। চলতি মাসের প্রথম বিশ দিনে পুলিশের হিসেবেই রাজধানীতে অন্তত ২০টিরও বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে আরও অনেক বেশি। অনেকেই থানা পুলিশের কাছে যেতে চান না।
ঢাকা মহাগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, অস্ত্রবাজ-ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে এ কথা সত্য নয়। দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে। আমরা সে বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি। অপরাধীদের গ্রেপ্তারে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে। পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, অপরাধীদের ঠেকাতে পুলিশ দুইভাবে কাজ করছে। প্রিভেনটিভ ওয়ার্কের অংশ হিসেবে পেট্রল, চেকপোস্টসহ দৃশ্যমান পুলিশিং বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনার পর অপরাধীদের দ্রুততম সময়ে আইনের আওতায় আনার প্রচেষ্টা চলে। আমরা প্রিভেনটিভ ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি অপরাধীদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় আনার জন্য কাজ করছি।
গত ১৪ই অক্টেবার রাজধানীর গুলশান থানার উল্টোদিকের এক বাসায় দুই মোটরসাইকেলযোগে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা হানা দেয়। সন্ত্রাসীরা ওই বাড়ির দারোয়ানকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে একটি পার্লার ও ফ্ল্যাট মালিক সমিতির সভাপতির বাসায় ঢোকার চেষ্টা করে। কূটনৈতিক পাড়া হিসেবে খ্যাত গুলশানের মতো কড়া নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা এলাকায় অস্ত্রবাজির ঘটনায় অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তবে ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও পুলিশ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করতে পারেননি। স্থানীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা গুলশান থানা ছাত্রলীগের সদস্য বলে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। এ ঘটনার একদিন আগে ১৩ই অক্টোবর শ্যামপুরে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে মারা যান রাসেল নামে এক যুবক। রাসেল খুলনা থেকে ঢাকার শ্যামপুরে ফুপুর বাসায় যাওয়ার সময় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। ১১ই অক্টোবর রাতে ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত রজনীগন্ধা সুপার মার্কেটের মেসার্স রুমানা ট্রের্ডাসের কর্মচারী বেলাল ও আলামিন পাওনা টাকা নিয়ে ফিরছিল। বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে তারা। ছিনতাইকারীরা বেলালকে ছুরিকাঘাত করে তার সঙ্গে থাকা এক লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়ে যায়। ৮ই অক্টোবর ভোরে বিমানবন্দর রেলস্টেশনে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে মাসুম নামে এক যুবক আহত হয়েছেন। ছিনতাইকারীরা তার টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। ৪ই অক্টোবর ভোরে যাত্রাবাড়ী এলাকায় টাঙ্গাইল জেলার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট লুবনা জাহান ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। ছিনতাইকারীরা তার ব্যাগে থাকা ৭-৮ হাজার টাকা, একটি মোবাইল ও মূল্যবান কিছু কাগজপত্র ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
গোয়েন্দা ও অন্যান্য সূত্র জানা গেছে, দৃশ্যমান পুলিশিং ও কড়া নিরাপত্তার কারণে ছিনতাইকারী ও অস্ত্রবাজরা তাদের কৌশল পাল্টিয়েছে। তারা পুলিশের নিরাপত্তা চৌকি রেকি করে বেড়ায়। ছিনতাইকারীদের একটি দল আগে যায়। তারা রাস্তায় পুলিশের চেকপোস্ট আছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করেই পিছনের অস্ত্রধারী দলকে সামনে আগানোর নির্দেশনা দেয়। এ ছাড়া রাজধানীর ফাঁকা কিছু জায়গাকে বেছে নিয়ে ছিনতাই করে থাকে। এ ছাড়া ভোরের দিকে পুলিশ সদস্যরা যখন একটু নিরাপত্তায় শিথিলতা দেখায় সেসময় ছিনতাইয়ে নেমে পড়ে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মধ্যে প্রগতি সরণি, রামপুরা, মালিবাগ, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও, শান্তিনগর, কাকরাইল, বিজয়নগর, পল্টন, বাসাবো, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী, শাহবাগ, ফার্মগেট, গাবতলী, মিরপুর, রাজধানীর অর্ধশত এলাকায় প্রতিনিয়ত গুলি করে, অস্ত্র ঠেকিয়ে কিংবা কুপিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। তবে ছোট খাটো অনেক ছিনতাইয়ের ঘটনায় ভুক্তভোগীরা থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ না করায় বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের গাড়িচালককে হাত-পা বেঁধে গাড়িটি ছিনিয়ে নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই বিদেশী হত্যার ঘটনায় রাজধানীতে এত নিরপত্তা জোরদার করার পরও ছিনতাইকারী-অস্ত্রবাজদের দৌরাত্ম্য দেখে তারা রীতিমতো বিস্মিত। পুলিশের এই নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে অনেকেই ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’ প্রবাদের সঙ্গে তুলনা করছেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্য অনুযায়ী গত মাসে রাজধানীতে ২১টি ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে। তবে চলতি মাসে প্রথম বিশ দিনেই এই সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। তবে চলতি মাসের প্রথম বিশ দিনে কতটি ছিনতাই মামলা হয়েছে তা জানা যায়নি।