পবিত্র আশুরা উপলক্ষে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হোসাইনি দালানের পাশে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে শক্তিশালী গ্রেনেড বিস্ফোরণে এক কিশোর নিহতসহ শতাধিক শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন আহতের ঘটনায় ‘আর্ন্তজাতিক জঙ্গি গোষ্ঠি’ জড়িত থাকার অভিযোগ করেছেন চট্টগ্রামের শিয়া সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ নেতা মাওলানা আমজাদ হোসেন।
গতকাল শুক্রবার দিনগত রাত পৌনে ২টার দিকে রাজধানীর পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে ঐতিহ্যবাহী হোসাইনি দালানের পাশে সংঘটিত এ বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশের মহা পরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করেছেন। আইজিপির সাথে সুর মিলিয়ে একই বক্তব্য দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও। তবে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গহওর রিজভী বলেছেন, এই ঘটনার সাথে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠি জড়িত থাকতে পারে। যদিও র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চট্টগ্রামে জেএমবি আস্তানা থেকে উদ্ধার হওয়া হ্যান্ড গ্রেনেডের সাথে হোসাইনি দালানে বিস্ফোরিত গ্রেনেডের মিল রয়েছে।
সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বিছিন্ন এমন মন্তব্যের মধ্যেই শিয়া সম্প্রদায়ের নেতা মাওলানা আমজাদ হোসেন এঘটনার জন্য দায়ী করেছেন আর্ন্তজাতিক জঙ্গি গোষ্ঠিকে।
শনিবার সকালে পবিত্র আশুরা উপলক্ষে নগরীর সদরঘাট থেকে শোক মিছিল পূর্ব এক আলোচনা সভায় আমজাদ হোসেন এ অভিযোগ করেন। ইরান থেকে পড়ালেখা করে আসা চট্টগ্রামের শিয়া সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ এ নেতা বলেন, ‘চারশ বছরের ঐতিহ্য ও সাম্প্রদায়িকতা ভেঙে হোসাইনি দালানের পাশে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে যে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে তার সাথে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠি জড়িত। যেটি আমাদের চারশ বছরের ইতিহাসে কখনো সংঘটিত হয়নি। আমরা এই ঘটানার তীব্র নিন্দা জানাই। পাশাপাশি নিন্দনীয় এই ঘটনার জন্য দায়ীদের খোঁজে বের করে অবিলম্বে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানাচ্ছি।’
আমজাদ হোসেন আরো বলেন, ‘এই ধরণের ঘটনা ঘটিয়ে আমাদের মাঝে সাম্প্রদায়িক যে সম্প্রতি বিদ্যমান সেটি কখনো নষ্ট করা যাবেনা। যারা দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি নষ্ট করার জন্য পরিকল্পিতভাবে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে।’
এরআগে শনিবার সকাল ১১টায় নগরীর সদরঘাট শিয়া মসজিদ থেকে কারবালা স্মরণে একটি শোক মিছিল বের করেন চট্টগ্রামে অবস্থানরত শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন। মিছিলটি নগরীর নিউমার্কেট মোড়, কোতোয়ালী মোড় প্রদক্ষিণ শেষে শিয়া মসজিদে এসে শেষ হয়।
মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা ‘ইয়া হোসাইন’, ‘ইয়া হোসাইন’ বলে মাতম তোলেন। বহন করা হয় ইমাম হোসাইনের প্রতিকী কফিন, শোকাবহ পতাকা এবং পড়া হয় শোকগাথা। এরপর শিয়া মসজিদে কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনাবলী নিয়ে আলোচনা করেন শিয়া সম্প্রদায়ের নেতা মাওলানা আমজাদ হোসেন।
পুরান ঢাকার হোসাইনি দালানের পাশে গ্রেনেড বিস্ফোরণের পর চট্টগ্রামে তাজিয়া মিছিল উপলক্ষে কড়া নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে পুলিশ। সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য বাংলামেইলকে বলেন, ‘এমনিতে এসব ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আমরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করি। এরমধ্যে গতকাল মধ্য রাতে ঢাকায় একটি ঘটনা ঘটার পর আমরা চট্টগ্রামে তাজিয়া মিলিকে নির্বিঘœ করতে কড়া নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়েছি।’
এদিকে ১০ মহররম পবিত্র আশুরা উপলক্ষে নগরীতে প্রতি বছর মত এবারো শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন শোক মিছিল এবং বিহারিরা তাজিয়া মিছিল বের করে। শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন শনিকার সকাল ১১টায় সদরঘাট ও হালিশহর থেকে মিছিল বের করলেও বিকেল তিনটা থেকে নগরীর সর্দার বাহাদুর নগর, ওয়ার্লেস, ফিরোজশাহ কলোনি, খুলশী কলোনি, রৌফাবাদ, শেরশাহ, হামজারবাগ থেকে বিহারিদের তাজিয়া মিছিল বের হবে বলে জানা গেছে।
সদরঘাট শিয়া মসজিদের ইমাম মাওলানা আমজাদ হোসেন জানান, শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন আশুরার প্রথম দশ দিন ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে থাকে। এসবের মধ্যে একেকটি দিন ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেন (রা.) এর পরিবারের একেক সদস্যের নামে উৎসর্গ করা হয়। গত ৫ মহররম ছিল ইমাম হোসেনের (রা.) ছেলের জন্য দোয়া এবং ৮ মহররম ছিল ইমাম হাসানের (রা.) ছেলের জন্য দোয়া, প্রার্থনা ও মাতম। শুক্রবার মধ্যরাত থেকে শুরু হয় মাতম ও গজলের অনুষ্ঠান।
আশুরার দিনে শোক মিছিল প্রসঙ্গে মাওলানা আমজাদ জানান, একটি তাবুত নিয়ে শোক মিছিল বের করা হয়। ইমাম হোসেন (রা.) এবং তার পরিবারের সদস্যরা শহীদ হওয়ায় মিছিলে তাদের শোকে মাতম করা হয়। মিছিলে কেউ নিজের শরীর রক্তাক্ত করে আবার কেউ বুক চাপড়িয়ে কিংবা বিলাপের মাধ্যমে মাতম প্রকাশ করেন। চাকু লাগানো একটি চেইন দিয়ে নিজের শরীর নিজেই আঘাত করে থাকেন মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা। এতে শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে রক্ত বের হলেও কোনো ব্যথা অনুভব হয় না। আবার কেউ জ্বলন্ত কয়লার উপর হেঁটে যায়। ইমাম হোসেনের (রা.) প্রতি মহব্বতের অংশ হিসেবে শিয়া মুসলমানরা এই ধরনের মাতম করে থাকেন বলে উল্লেখ করেন শিয়া সম্প্রদায়ের এই ধর্মীয় নেতা।