রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারে ‘ষড়যন্ত্র’, দায় কার?

Slider বাংলার মুখোমুখি


শেষ মুহূর্তে এসে আটকে গেল রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত। পতিত হাসিনা সরকারের আমলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলাগুলো দায়ের করা হয়। সেসব মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে মন্ত্রণালয় পর্যায়ের প্রথম সভায় যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেগুলোতে আসছে বড় পরিবর্তন।

নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মামলা প্রত্যাহারের তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছে কিছু মামলা। ফলে একদিকে মন্ত্রণালয় পর্যায়ের প্রথম সভার সিদ্ধান্ত যেমন হঠাৎ করে আটকে গেল, তেমনি এ নিয়ে শুরু হচ্ছে বিতর্ক। অন্যদিকে, দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে মামলাগুলো প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে। জানা যায়, প্রথম সভায় খোদ আইন উপদেষ্টার প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, মামলা প্রত্যাহারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত বিতর্কিত করতে এবং এটি নিয়ে জটিলতা তৈরি করতে আইন মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তা নানা পাঁয়তারা চালিয়ে যাচ্ছেন।

নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মামলা প্রত্যাহারের তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছে কিছু মামলা। ফলে একদিকে মন্ত্রণালয় পর্যায়ের প্রথম সভার সিদ্ধান্ত যেমন হঠাৎ করে আটকে গেল, তেমনি এ নিয়ে শুরু হচ্ছে বিতর্ক। অন্যদিকে, দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে মামলাগুলো প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে। জানা যায়, প্রথম সভায় খোদ আইন উপদেষ্টার প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়

রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করতে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের আইন-১ শাখা থেকে জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে জেলা ও মন্ত্রণালয় পর্যায়ে দুটি কমিটি গঠন করা হয়। একই সঙ্গে এসব কমিটির কার্যপরিধি ও কর্মপদ্ধতি নিয়েও বিস্তারিত নির্দেশনা দেওয়া হয়। জেলা পর্যায়ে মামলা প্রত্যাহার সংক্রান্ত ওই কমিটিতে সভাপতি করা হয় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে। কমিটিতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে সদস্য সচিব করার পাশাপাশি সদস্য হিসেবে রাখা হয় পুলিশ সুপার ও পাবলিক প্রসিকিউটরকে। অপরদিকে, মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটিতে আইন উপদেষ্টাকে সভাপতি এবং জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবকে সদস্য করা হয়।

দায়িত্বশীল সূত্রে জানা যায়, গত ১ জানুয়ারি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটির একটি সভা আহ্বানের অনুরোধ জানানো হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১২ জানুয়ারি আবারও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি নোটিশ জারি করা হয়। নোটিশে ১৪ জানুয়ারি আইন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইন উপদেষ্টার সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ ও নড়াইল জেলা থেকে পাঠানো বেশকিছু মামলা আমলে নেওয়া হয়। একই সঙ্গে সভায় আইন উপদেষ্টার প্রস্তাবের ভিত্তিতে তিন জেলা থেকে পাঠানো মামলাগুলো সর্বসম্মতিক্রমে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন পর্যায়ে এসে আকস্মিক বেশকিছু পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।

সভায় মামলাগুলো প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হলেও মন্ত্রণালয়ে পতিত আওয়ামীপন্থি একটি চক্র ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে প্রথম সভায় যে সিদ্ধান্তগুলো আগেই নির্ধারিত হয়েছিল সেই সিদ্ধান্তের নোটে মামলা প্রত্যাহার না করার সুপারিশ করা হয়

ঢাকা পোস্টের হাতে আসা এ সংক্রান্ত নথিপত্রে দেখা যায়, আইন উপদেষ্টার সভাপতিত্বে আইন মন্ত্রণালয়ের ওই সভার সিদ্ধান্তে প্রথম ধাপের সবগুলো মামলা রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার লক্ষ্যে দায়ের করা হয়েছিল মর্মে বিবেচিত হওয়ায় মামলাগুলো ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ৪৯৪ ধারার বিধান অনুযায়ী প্রত্যাহারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে মর্মে সিদ্ধান্ত হয়।

সভায় আইন ও বিচার বিভাগ কর্তৃক সারাদেশ থেকে বাছাই করে সংগৃহীত মামলাগুলো আলোচ্য কমিটির বিবেচনার জন্য কমিটির পরবর্তী সভায় উপস্থাপন করা এবং একই বিধান অনুযায়ী প্রত্যাহারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ছাড়া সভায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটগণকে মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশগুলো নিয়মিতভাবে যথানিয়মে প্রেরণের অনুরোধ এবং মামলা প্রত্যাহারের জন্য আবেদন দাখিলের সময়সীমা পরবর্তী নির্দেশ প্রদান না করা পর্যন্ত অব্যাহত রাখারও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এ বিষয়ে আমাদের মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি ব্রিফ হয়েছে। ব্রিফিংয়ে যা বলার বলা হয়েছে। এরপর এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। এ মুহূর্তে আনঅফিসিয়ালি কোনো সিদ্ধান্ত জানানো যাবে না
আইন সচিব শেখ আবু তাহের

সূত্র জানায়, সভায় মামলাগুলো প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হলেও মন্ত্রণালয়ে পতিত আওয়ামীপন্থি একটি চক্র ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে প্রথম সভায় যে সিদ্ধান্তগুলো আগেই নির্ধারিত হয়েছিল সেই সিদ্ধান্তের নোটে মামলা প্রত্যাহার না করার সুপারিশ করা হয়। একই সঙ্গে এ সংশোধনী আইন উপদেষ্টাকে না জানিয়ে তড়িঘড়ি করে লিফটের গেট থেকে ওই ফাইলে উপদেষ্টার স্বাক্ষর নেওয়া হয়। ফলে পরিবর্তিত নোট দেখার সুযোগ পাননি আইন উপদেষ্টা। ষড়যন্ত্রের পুরো প্রক্রিয়াটির সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিবসহ কয়েকজন আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তা জড়িত বলে অভিযোগ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কুটিল এ চক্রান্তের ফলে মামলা প্রত্যাহারে তৈরি হয়েছে দীর্ঘসূত্রতা, যা প্রথম সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বিতর্কের মুখে ফেলেছে।

মন্ত্রণালয়ের প্রথম সভার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চাইলে আইন সচিব শেখ আবু তাহের বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি ব্রিফ হয়েছে। ব্রিফিংয়ে যা বলার বলা হয়েছে। এরপর এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। এ মুহূর্তে আনঅফিসিয়ালি কোনো সিদ্ধান্ত জানানো যাবে না।’
দেশের ২৫টি জেলায় আড়াই হাজার রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বা গায়েবি মামলা চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব মামলার আসামি লাখ লাখ মানুষ। আগামী সাতদিনের মধ্যে এসব মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হবে
আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল

এর আগে এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে আইন মন্ত্রণালয়। সংবাদ সম্মেলনে আগামী সাতদিনের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ‘দেশের ২৫টি জেলায় আড়াই হাজার রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বা গায়েবি মামলা চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব মামলার আসামি লাখ লাখ মানুষ। আগামী সাতদিনের মধ্যে এসব মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

‘গায়েবি’ মামলা শনাক্তে কয়েকটি মানদণ্ড নির্ধারণের কথা তুলে ধরে আসিফ নজরুল বলেন, ‘যেমন- মামলাগুলো পুলিশ দায়ের করেছে কি না; বিস্ফোরক আইনে করা হয়েছে কি না; অস্ত্র আইনে করা কি না; বিশেষ ক্ষমতা আইনি হয়েছে কি না; কিংবা পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কি না।’

তিনি বলেন, গায়েবি মামলা প্রত্যাহারে এসব প্রবণতা আমরা নজরে রেখেছি। এসব মামলায় অনেক অজ্ঞাত আসামি থাকে। আমরা দেখেছি, মামলাগুলো হতো বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর বড় বড় আন্দোলনের আগে ও পরে। তিনটি ভুয়া নির্বাচনের আগে ও পরে। এসব ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে আমরা আড়াই হাজারেরও বেশি মামলা শনাক্ত করেছি। এগুলো প্রত্যাহার হবে আশা করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *