পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস এবং এ নিয়ে বিভিন্ন মহলের কঠোর সমালোচনার মধ্যেই এ সংক্রান্ত যে আইন হচ্ছে তাতে নেই প্রশ্ন ফাঁসের শাস্তি বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ।
তবে ১৯৮০ সালের এ সংক্রান্ত আইনে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় ১০ বছরের শাস্তির বিধান ছিল, যদিও ওই সময় প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি এখনকার মতো আলোচনায় ছিল না।
সরকারের এই উদ্যোগের কঠোর সমালোচনা করে শিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। ২৯ অক্টোবরের মধ্যে শিক্ষাবিদসহ অংশীজনের মতামত নিয়ে খসড়াটি চূড়ান্ত করবে মন্ত্রণালয়।
[email protected] এবং [email protected] ই-মেইলে প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের খসড়ার উপর মতামত দেওয়া যাবে।
খসড়ায় ৬৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করলে অথবা এই কাজে জড়িত থাকলে বা সহায়তা করলে তিনি সর্বোচ্চ চার বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
১৯৮০ সালের ‘দ্য পাবলিক এক্সামিনেশনস (অফেন্স) অ্যাক্ট’-এ প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় ১০ বছরের শাস্তির বিধান ছিল। ১৯৯২ সালে তা সংশোধন করে সাজা চার বছর করা হয়।
সরকারের এই উদ্যোগের কঠোর সমালোচনা করেছেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই সাবেক উপদেষ্টা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চার বছরের কারাদণ্ড অথবা এক লাখ টাকা জরিমানা প্রহসনের মতো, এটাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না।”
এক লাখ টাকা জরিমানা দেওয়া প্রশ্ন ফাঁসকারীদের জন্য কোনো বিষয়ই না উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এর মধ্য দিয়ে অনৈতিকতাকে বাড়িয়ে দেবে। অপরাধ করেও অনেকে পার পেয়ে যাবেন, যা অপরাধীদের আরও উৎসাহিত করবে।
“শাস্তির পরিমাণ কোনোভাবেই কমানো যাবে না। কারণ প্রযুক্তির কারণে এখন এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে। ১৯৮০ সালে তো এসব প্রযুক্তি ছিল না। তখন যদি এই অপরাধে ১০ বছরের সাজা হয় এখন সেটা কেন কমানো হবে?”
ঢাকায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সংগঠন অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবীর দুলুও চার বছরের সাজাকে ‘আইওয়াশ’ হিসাবে দেখছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যারা প্রশ্ন ফাঁস করে তাদের বাঁচিয়ে রাখতেই সাজা কমানো হচ্ছে বলে আমি মনে করছি।”
আগের আইন অনুযায়ী ১০ বছরের সাজার সঙ্গে মোটা অঙ্কের আর্থিক জরিমানা করার দাবি জানিয়ে দুলু বলেন, “যারা প্রশ্ন ফাঁস করেন তারা তো কোটি কোটি টাকা আয় করে। তাই জেল-জরিমানা উভয় শাস্তিই দিতে হবে।”
সরকারের সদিচ্ছার অভাবেই প্রশ্ন ফাঁসকারীদের ধরা যাচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ দিয়ে কয়েকটি নিবন্ধ লেখন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। একটি নিবন্ধের মাধ্যমে এই অধ্যাপকের একটি লেখার জবাবও দেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন মহল সরকারের কঠোর সমালোচনা করে আসছে।
এ বিষয়ে কয়েক দফা যোগাযোগ করেও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খানের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
প্রশ্ন ফাঁসের বিষয় ছাড়াও খসড়া আইনে গাইড বা নোটবই প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া মুখস্তবিদ্যাকে নিরুৎসাহিত করতে সব পরীক্ষাই সৃজনশীল পদ্ধতিতে নেওয়ার সুপারিশ এসেছে।
তবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড অনুমোদিত পাণ্ডুলিপির অনুমোদন নিয়ে কোনো প্রকাশক, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি সহায়ক শিক্ষা উপকরণ বা সহায়ক পুস্তক বা ডিজিটাল শিখন-শেখন সামগ্রী প্রকাশ করতে পারবেন বলে খসড়ায় বলা হয়েছে।
সহায়ক শিক্ষা উপকরণ প্রকাশে কোন ব্যক্তি নিয়ম অমান্য করলে দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা ছয় মাসের কারদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
শিক্ষা আইনের খসড়া অনুযায়ী, নিবন্ধন ছাড়া কোনো বেসরকারি বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা স্থাপন ও পরিচালনা করা যাবে না। কোনো এলাকা বা অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা না থাকলে সরকার সেগুলো একীভূত, স্থানান্তর বা বিলুপ্ত করতে পারবে।প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ইবতেদায়ী মাদ্রাসায় ভর্তি উপযোগী শিশুকে জন্ম নিবন্ধন সনদ বা সরকার অনুমোদিত প্রাক-প্রাথমিক বা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির সনদ দাখিল সাপেক্ষে উপযুক্ত শ্রেণিতে ভর্তি করা যাবে।
আইনে নবম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট বা সমমানের পরীক্ষা পাসের সনদ এবং একাদশ বা আলিম শ্রেণিতে ভর্তিতে এসএসসি বা সমমানের সনদ দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
খসড়া অনুযায়ী, প্রাথমিক ও ইবেতেদায়ী স্তরে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বৃত্তিমূলক এবং তথ্য ও যোগাযোগ বিষয়ক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত হবে।
উচ্চশিক্ষায় বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষার ব্যবহার অব্যাহত থাকবে উল্লেখ করে খসড়ায় বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসায় স্নাতক পর্যায়ে সকল কোর্সে ন্যূনতম নম্বর বা ক্রেডিট ইংরেজি বিষয় অধ্যয়ন বাধ্যতামূলক হবে।
সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিকমানের কারিকুলামসহ কম্পিউটার বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক বিভাগ খুলতে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে।প্রস্তাবিত আইনের খসড়া অনুযায়ী, প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা রাষ্ট্রর ব্যয়ে পরিচালিত হবে। জরুরি পরিস্থিতিতে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখতে সরকার বিশেষ বাজেট বরাদ্দ দেবে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক এবং মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সরকার স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ ও উপযুক্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করবে বলেও খসড়ায় উল্লেখ করা হয়।