সাবেক প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল সম্পদেও ‘লাল’

Slider বাংলার মুখোমুখি

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার ২৯৮নং সংসদীয় আসনের সাবেক সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও তার স্ত্রী মল্লিকা ত্রিপুরার নামে অবৈধ উপায়ে শত শত কোটি টাকার সম্পদ আহরণের প্রমাণ মিলেছে।

অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়ায় ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও তার স্ত্রী মল্লিকা ত্রিপুরাকে সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার জন্য পৃথক নোটিশ দেওয়া হয়েছে। গত ২১ নভেম্বর ইস্যু করা সম্পদের (স্থাবর-অস্থাবর) যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত চেয়ে চিঠি দিয়েছে দুদকের অনুসন্ধান টিম।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে শত কোটি টাকার বেশি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সে কারণে কুজেন্দ্র লাল ও তার স্ত্রীর সম্পদের হিসাবে চেয়ে নোটিশ জারি করা হয়েছে। অভিযোগ অনুসন্ধানে ভূমি অফিস, সাব-রেজিস্ট্রার, গণপূর্ত, রাজউক, সিটি কর্পোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ দেড় শতাধিক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অভিযোগসংশ্লিষ্ট নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। সম্পদের বিবরণ পাওয়া গেলে যাচাই-বাছাই করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘তিনি তার নামের সার্থকতার প্রমাণ দিয়েছেন। অবৈধ সম্পদ অর্জনের মাধ্যমে তিনি নিজে ও পরিবারকে লাল রঙে রাঙিয়ে তুলেছেন!’

দুদকের অনুসন্ধানে এখন পর্যন্ত রাঙ্গামাটির সাজেক ভ্যালিতে দুটি রিসোর্ট, খাগড়াছড়ি সদরে রেস্টুরেন্ট, ঢাকার পূর্বাচলে প্লট, উত্তরায় বিশাল দুইটি ফ্ল্যাট, খাগড়াছড়ি সদরের খাগড়াপুর, খবংপুড়িয়া ও দীঘিনালায় তিনটি বাড়ি এবং ল্যান্ডক্রুজার গাড়িসহ বিলাসবহুল একাধিক গাড়ির তথ্য পাওয়া গেছে। অন্যদিকে, নামে-বেনামে বিভিন্ন হিসাবে শত কোটি টাকা থাকার তথ্য-প্রমাণও পাওয়া গেছে।

কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার সম্পদের পাহাড়

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খাগড়াছড়ি আসনে টানা তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত হন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্সের তৎকালীন চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার সাবেক সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা নিজ এলাকায় অঘোষিত ‘রাজা’ হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি, সরকারি জমি দখল, টেন্ডারবাজি, অর্থের বিনিময়ে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য এবং দলের পদ ও কমিটি নিয়ে অনৈতিক বাণিজ্য করার অভিযোগ রয়েছে।

সর্বশেষ ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জমা দেওয়া হলফনামার তথ্যানুযায়ী, গত ১০ বছরে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার আয় বেড়েছে প্রায় ১৩ গুণ। কিনেছেন শত শত একর জমি, বেড়েছে ব্যবসা। সেই সঙ্গে এফডিআরের পরিমাণ, স্বর্ণালংকার, গাড়ি ও বাড়ির সংখ্যা বেড়েছে তার। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের হলফনামায় কেবল খাগড়াছড়ি সদর ও দীঘিনালায় সম্পত্তি থাকার কথা উল্লেখ থাকলেও ২০২৩ সালে জমা দেওয়া হলফনামায় রাঙ্গামাটি ও ঢাকায় সম্পত্তি থাকার হিসাব দেখানো হয়।

২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার হলফনামায় ইটভাটা, কৃষি ও মৎস্য খামার, কাঠ ব্যবসাসহ মৌসুমি ব্যবসার খাত থেকে বাৎসরিক আয় দেখানো হয় ৩০ লাখ ৫৭ হাজার ৩৭৫ টাকা। ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৫ লাখ ১৪ হাজার টাকায়। ২০২৩ সালে এসে তার আয় দাঁড়ায় চার কোটি ১৬ লাখ ৬৫ হাজার ৬৮০ টাকা। তার আয়ের সবচেয়ে বড় খাত হিসেবে দেখানো হয় রাঙ্গামাটির সাজেকে রিসোর্ট ব্যবসা। এখান থেকে তার বছরে আয় হয় এক কোটি ৩৬ লাখ ৩১ হাজার ২৪৭ টাকা।

দ্বিতীয় আয়ের খাত হিসেবে ইট, বালুসহ বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহের কথা বলা হয়। এ খাত থেকে তার আয় হয় এক কোটি ৩১ লাখ ৭৬ হাজার ৫৫৪ টাকা। ইটভাটা থেকে আয় ২৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন এফডিআর, সঞ্চয়ী জামানত ও অংশীদারি বিনিয়োগ থেকে আয় দেখানো হয়।

নিজের পাশাপাশি স্ত্রীর নামেও রয়েছে কোটি টাকার সম্পদ। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের হলফনামায় সম্পদ, আয় ও আর্থিক বিবরণী একই রকম দেখা গেলেও ২০২৩ সালে এসে তা বেড়ে যায়। ২০২৩ সালের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের ব্যবধানে আনুমানিক আট কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ বেড়েছে। যার মধ্যে রাঙ্গামাটির সাজেক ভ্যালির কংলাকে ৪ দশমিক ০৮ একর ভূমির ওপর খাস্রাং নামের রিসোর্টে বিনিয়োগ দেখানো হয় চার কোটি ৪২ লাখ এক হাজার টাকা। খাগড়াছড়ি সদরের আলুটিলায় খাসাং রেস্টুরেন্টে বিনিয়োগ দেখানো হয় দুই কোটি ২২ লাখ ৬৫ হাজার টাকা।

যত বাড়ি-গাড়ি

খাগড়াছড়ি সদরের খাগড়াপুর, খবংপুড়িয়া ও দীঘিনালায় কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার বাড়ি রয়েছে তিনটি। হলফনামায় যার মূল্য দেখানো হয়েছে তিন কোটি ১৭ লাখ ৭১ হাজার ৩৬৬ টাকা। রয়েছে শুল্কমুক্ত ল্যান্ডক্রুজার ও জিপসহ বিলাসবহুল কয়েকটি গাড়ি। এ ছাড়া এমপিপুত্রের নামে ৩৬ লাখ টাকার লাল রঙের একটি বিলাসবহুল প্রাইভেট কার, পরিবহন খাতে ব্যবসার উদ্দেশ্যে পিকআপ-১, পিকআপ-২-সহ ভাড়ায়চালিত অসংখ্য গাড়িও রয়েছে বলে জানা গেছে।

ঢাকার পূর্বাচলে ভূমি কেনাবাবদ বিনিয়োগ দেখিয়েছেন সাত লাখ ৫০ হাজার টাকা; ঢাকার উত্তরায় এক হাজার ৭৮৩ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, নথিপত্রে যার ক্রয়মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ৪২ লাখ টাকা। বাস্তবে যার মূল্য অনেক বেশি। অন্যদিকে, অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে এক কোটি ১৫ লাখ পাঁচ হাজার ১৫৬ টাকার এফডিআর, ১৪ লাখ ১৭ হাজার ৮৪১ টাকার ডিপিএস, সংসদ সদস্য ও টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান পদ থেকে বাৎসরিক আয় ২৪ লাখ ৮৭ হাজার টাকা দেখিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া ‘মল্লিকা অ্যাগ্রো প্রজেক্ট’র নামে বনায়ন, কৃষি, মৎস্য ও গবাদি পশু পরিপালনে ১০৭ একর জমির তথ্যও উল্লেখ করেছেন হলফনামায়।

অভিযোগ রয়েছে, খাগড়াছড়ি সদর উপজেলাধীন আলুটিলা পর্যটন এলাকায় ১০ একর (১০০০ শতাংশ) সরকারি খাসজমি দখল করেন কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার রাস্তার বাম-ডান উভয় পাশে কয়েক হাজার একর জমিতে আমবাগান, দীঘিনালা উপজেলাধীন বোয়ালখালী এলাকায় স্ত্রী ও নিজের নামে ‘কুজেন্দ্র মল্লিকা মডার্ন কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এজন্য ২০ কোটি টাকার ব্যক্তিগত ট্রাস্টি গঠন করেন তিনি।

যদিও নির্বাচনী হলফনামায় ব্যবসা খাতে ‘ব্রিক ফিল্ড’ থেকে তার বাৎসরিক আয় ২৫ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। সেখানেও রয়েছে ঘাপলা। কারণ, খাগড়াছড়ি জেলায় বৈধ কোনো ইটভাটা নেই। জেলায় প্রায় ৪০টি ইটভাটার মধ্যে একটিরও কোনো লাইসেন্স ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই।

এ ছাড়া খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নের মধ্য বোয়ালখালী এলাকার কেবিএম ব্রিকস ও ফোরবিএম ব্রিকস নামে দুটি ইটভাটার সঙ্গে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এর মধ্যে কেবিএম ব্রিকসের সরাসরি ব্যবসায়িক অংশীদার এবং ফোরবিএম ব্রিকসের প্রায় অর্ধেক অংশের ভূমির মালিক তিনি।

দুদকের নোটিশে যা বলা হয়েছে

সম্পদের হিসাব চাওয়া দুদকের পৃথক নোটিশে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও তার স্ত্রী মল্লিকা ত্রিপুরার নামে থাকা স্থাবর-অস্থাবর যাবতীয় সম্পদের বিবরণ ২১ কর্মদিবসের মধ্যে জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। এ আদেশ পাওয়ার ২১ কর্মদিবসের মধ্যে নির্ধারিত ছকে সম্পদের বিবরণী দাখিলে ব্যর্থ হলে কিংবা মিথ্যা সম্পদের বিবরণী দাখিল করলে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ৫ (২) ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সেখানে আরও বলা হয়েছে, ‘প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধান করে দুদকের স্থির বিশ্বাস জন্মেছে যে, আপনারা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত স্বনামে/বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ/সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। নিজ ও আপনাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তির নামে-বেনামে অর্জিত যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ, দায়-দেনা, আয়ের উৎস এবং তা অর্জনের বিস্তারিত বিবরণী কমিশনে দাখিল করবেন। তবে, সম্পদের হিসাব জমা দিতে ২১ কর্মদিবস বেঁধে দিলেও চাইলে সময়ের আবেদন করে ১৫ কর্মদিবস সময় বৃদ্ধি করতে পারবেন।’

জানা যায়, অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত ৪ সেপ্টেম্বর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদক থেকে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে তলব করা হলেও তিনি হাজির হননি। এর আগে ২৯ আগস্ট দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ থেকে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *