কোন পথে সিরিয়া?

Slider সারাবিশ্ব

দুই দশকের বেশি সময় ধরে সিরিয়ার মসনদে জেঁকে বসা স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশটি কোন পথে এগোবে তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। সিরিয়াজুড়ে লাখো জনতার উল্লাস দেখা গেলেও স্বৈরশাসক আসাদের পতনের প্রভাব কেমন হতে যাচ্ছে তা নিয়ে দেশটিতে ব্যাপক উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

সিরিয়ায় নিযুক্ত জাতিসংঘের বিশেষ দূত গেইর পেডারসেন বলেছেন, প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতন এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত হলেও সেটি ‘‘সতর্ক প্রত্যাশার’’ একটি মুহূর্ত মাত্র। আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের কূটনীতিক আনোয়ার গারগাশ বলেছেন, ‘‘বিশৃঙ্খলা, চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকির কারণে সিরিয়ার আঞ্চলিক অখণ্ডতা হুমকির মুখে পড়েছে।’’

পেন্টাগনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ড্যানিয়েল শাপিরো বলেছেন, তথাকথিত ইসলামিক স্টেট (আইএস) গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মার্কিন বাহিনী পূর্ব সিরিয়ায় থাকবে। ইসলামিক এই গোষ্ঠী ‘বিশৃঙ্খল ও পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিকে’ কাজে লাগিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।

আর তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান বলেছেন, আসাদের পতনের পর এখন লাখ লাখ সিরীয় শরণার্থী নিজ দেশে ফিরতে পারবে বলে আশা করছেন তিনি।
• ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া অস্পষ্ট

রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট ফেলো এইচ এ হেলিয়ার বলেন, সিরিয়া পরিস্থিতি এখন প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক রূপান্তর প্রক্রিয়া কোন দিকে মোড় নেবে এবং ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীকে নিয়ে গড়ে তোলা বিরোধী দলগুলো একসাথে কাজ করতে পারবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

তিনি বলেন, আমরা বেশ নাটকীয়ভাবে যে অগ্রগতি দেখতে পেয়েছি, তা সম্পাদন করার জন্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মাঝে গত সপ্তাহে ও তারও আগে অবশ্যই সমন্বয় করা হয়েছিল।

‘‘তবে মূল প্রশ্নগুলো হতে যাচ্ছে, সেখানে অন্তর্বর্তী সরকার হতে চলেছে, সেখানে অন্তর্বর্তী প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে—কিন্তু সবাই কি সরাসরি সেই প্রক্রিয়াতে অংশ নিচ্ছেন? আপনি কীভাবে এই প্রক্রিয়ায় লোকজনকে আনবেন? আপনি কীভাবে নিশ্চিত করবেন যে, এই তাঁবুটি যথেষ্ঠ চওড়া; যেখানে বাইরের কোনও ভক্ষক থাকবে না?’’

হেলিয়ার বলেন, যে কোনও রূপান্তর প্রক্রিয়ায় সিরিয়ার সকল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সেখানে সংখ্যালঘুদের ওপর এখন পর্যন্ত বড় ধরনের হামলা হয়নি, এটিও বেশ আশাব্যাঞ্জক।

তিনি বলেন, ‘‘লোকজন যদি সকল সম্প্রদায়ের সদস্যদের—একটি বা দু’টি নয়; অংশগ্রহণে রূপান্তর প্রক্রিয়াকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে চূড়ান্ত রূপান্তরের জন্য ইতিবাচক হতে চলেছে সেটি।’’

‘‘কিন্তু স্বৈরাচারী, স্বৈরশাসক বা স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা থেকে প্রত্যেকটি পরিবর্তনের সমস্যা হল, লোকজন মনে করে না যে, তাদের এই প্রক্রিয়ায় নেওয়া হয়েছে। সিরিয়ার বহুত্ববাদের বিস্তৃত পথ থেকে যত বেশি লোকজনকে এই প্রক্রিয়ায় নেওয়া যায়, ততই ভালো। আমি মনে করি, এই বিষয়ে আমাদের আশা করা উচিত।’’
• সংকটে যুক্তরাষ্ট্রকে টেনে আনতে পারে সিরিয়া

ডারহাম ইউনিভার্সিটির শান্তি ও নিরাপত্তা বিভাগের অধ্যাপক রবার্ট গেইস্ট পিনফোল্ড বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার পরিবর্তিত পরিস্থিতি থেকে দূরে থাকতে চাইলেও ওয়াশিংটনকে এই সংকটে টেনে আনতে পারে সিরিয়া।

তিনি বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত-প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে আমরা যা দেখতে পারি, তা হল তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবেন ট্রাম্প।’’

‘‘ট্রাম্প শক্তিশালী স্বৈরাচারদের পছন্দ করেন। এরদোয়ান তাদের মধ্যে একজন ছিলেন এবং এখনও রয়ে গেছেন। তাই প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায় মার্কিন সংস্থাগুলো কতটা ভূমিকা রাখবে এবং তারা তুরস্কের সঙ্গে কতটা ভিন্নমত পোষণ করবে… মূলত স্থানীয়ভাবে সিরিয়ার পুলিশি সব বিষয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়া ঠেকাতে তুরস্ক কী পদক্ষেপ নেবে, সেটাই দেখতে হবে।’’

গেইস্ট পিনফোল্ড বলেন, বাশার আল-আসাদের পতনে পশ্চিমা বিশ্ব বিদ্রোহীদের স্বাগত জানালেও এখনও আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ঠ কারণ রয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ নেতৃত্বাধীন সরকারের উৎখাত আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সিরিয়ার ইসলামপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামকে (এইচটিএস) সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকাভূক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। শুধু তাই নয়, এইচটিএসের প্রধান আবু মোহাম্মদ আল-জোলানির মাথার দাম ১ কোটি মার্কিন ডলার ঘোষণা করেছিল ওয়াশিংটন।
• আইএসের পুনরুত্থানের শঙ্কা

সিরিয়ার বিশাল এলাকাজুড়ে এক সময় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল মধ্যপ্রাচ্য-ভিত্তিক ইসলামপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর দেশটিতে আবারও এই গোষ্ঠীর মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সাবেক কমান্ডার মেরিন জেনারেল ফ্রাঙ্ক ম্যাকেঞ্জি বলেছেন, ‘‘তিনি সিরিয়ার সামনের পথ নিয়ে উদ্বিগ্ন।’’

মার্কিন সংবাদমাধ্যম এবিসি নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, আজকের পরিবর্তিত পরিস্থিতি সিরিয়ার জনগণের জন্য সুসংবাদের হলে আমি আরও বেশি আশাবাদী হতে পারতাম। কিন্তু আমরা সেখানে একটি ইসলামিক রাষ্ট্রের উত্থান দেখতে পারি; যার গভীর নেতিবাচক প্রভাব ওই অঞ্চলে পড়বে। আর এটা সম্ভব।
• আসাদের পতনে ক্ষমতায় ভারসাম্য আসবে?

প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের শাসনের অবসানে ওই অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য পুনরুজ্জীবিত হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আসাদের পতনের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের প্রভাব বলয়ে লজ্জাজনক এক আঘাত দেখছে ইরান। আসাদের শাসনাধীন সিরিয়া ছিল ইরান ও হিজবুল্লাহর সংযোগের অন্যতম এক অংশ। লেবাননের রাজনৈতিক আন্দোলন হিজবুল্লাহর কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ পথও ছিল সিরিয়া।

ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে হিজবুল্লাহ নিজেই ভয়াবহভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। গৃহযুদ্ধের সবচেয়ে সহিংস পর্যায়ে সিরিয়ায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর উপদেষ্টাদের পাঠায় তেহরান। বিরোধীদের দমনে আসাদকে সহায়তা করার জন্য সিরিয়ায় হাজার হাজার যোদ্ধা ও অস্ত্র পাঠিয়েছিল হিজবুল্লাহও। ঘনিষ্ঠ মিত্র আসাদের পাশে দাঁড়িয়ে রাশিয়াও তার শক্তিশালী বিমান বাহিনীকে ব্যবহার করেছে। কিন্তু এবারের আন্দোলনে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে উদ্ধারে তারা এগিয়ে আসেনি। আর সরকারি বাহিনীকে ব্যবহার করে নিজেও বাঁচতে পারেননি আসাদ।

ইয়েমেনে হুথিদের লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা দেখেছে ইরানও। ইরাকে মিলিশিয়া এবং গাজায় হামাস; তেহরান যাদের প্রতিরোধের অক্ষ হিসাবে বর্ণনা করে, তারাও এখন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিরিয়ার নতুন এই বাস্তবতায় ইসরায়েলে উল্লাস দেখা গেছে। ইরানকে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসাবে দেখা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ৫০ বছর পর সিরিয়ায় প্রথমবারের মতো সামরিক ট্যাংক পাঠিয়ে দিয়েছেন।

বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, তুরস্কের সহায়তা ছাড়া সিরিয়ায় এবারের এই আন্দোলনের সফল পরিণতি সম্ভব হতো না। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সিরিয়ার শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের অনুমতি দেওয়ার জন্য কিছুদিন আগে আসাদকে চাপ দিয়েছিলেন। তুরস্কের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে সিরিয়ার অন্তত ৩০ লাখ বাস্তুচ্যুত নাগরিক রয়েছেন। সিরীয় শরণার্থীরা তুরস্কের জন্য স্থানীয়ভাবে বেশ স্পর্শকাতর বিষয় হলেও আসাদ তাদের গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।

সিরিয়ার কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠীর প্রতি তুরস্কের সমর্থন রয়েছে। তবে আসাদকে উৎখাতের বিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারী ইসলামি গোষ্ঠী এইচটিএসকে সমর্থন করার কথা অস্বীকার করেছে তুরস্ক। এইচটিএস সমঝোতামূলক এবং কূটনৈতিক বার্তা পাঠিয়ে আসছিল তুরস্কে। কিন্তু বর্তমানে সিরিয়া পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তনে বিপজ্জনক শূন্যতা তৈরির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তা আরও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ও সহিংসতার কারণ হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *