কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজে ভাঙচুরের নেপথ্যে কী?

Slider শিক্ষা


ভুল চিকিৎসায় রাজধানীর ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের অভিজিৎ নামে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় বিচারের দাবিতে মোল্লা কলেজসহ ৩৫টি কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করতে এসে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী কলেজে হামলা ও ভাঙচুর করেছেন। দুপুর ১২টা থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় চলতে থাকে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। এতে সাংবাদিকসহ ২০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, রোববার (২৪ নভেম্বর) দুপুর ২টায় রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী অভিজিতের মৃত্যুর অভিযোগ এনে বিচারের দাবিতে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের সামনে এসে জড়ো হয়। এরই মধ্যে হাসপাতালের গেট ও নেম প্লেট ভাঙচুর শুরু করেন কিছু শিক্ষার্থী। এসময় হাসপাতালের গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে জানালার কাচ ও একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর করা হয়। কিছুক্ষণ পরে শিক্ষার্থীরা একজোট হয়ে কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের দিকে এগিয়ে যান। পথে পুলিশ বাধা দিলে সেটি উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে যান তারা। পরে সোহরাওয়ার্দী কলেজে পৌঁছে ১৭টি ডিপার্টমেন্ট ভাঙচুর, শিক্ষকদের রুম, এক শিক্ষকের প্রাইভেটকার, চারটি মোটরসাইকেল, কলেজের নেম প্লেট ভাঙচুর করেন।

জানা যায়, ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়ে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিৎ হালদার গত ১৬ নভেম্বর সকালে হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি হন। ১৮ নভেম্বর রাত ৮টার দিকে হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ২০ ও ২১ নভেম্বর হাসপাতাল অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, এ দুই দিন ন্যাশনাল মেডিকেলের পক্ষ নিয়ে কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা তাদের ওপর হামলা চালান। এ হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফেসবুকে ‘ইউনাইটেড কলেজ অব বাংলাদেশ’ নামের একটি গ্রুপে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজসহ অন্য কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ ও অভিজিতের মৃত্যুর ঘটনায় বিচারের দাবিতে আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে একত্রিত হন।

ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা বলেন, ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় মারা গেছেন কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিৎ। এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানাতে গেলে হামলা চালান নজরুল সরকারি কলেজ ও সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। এর প্রতিবাদে ৩৫টির বেশি কলেজের শিক্ষার্থীরা একজোট হয়ে কর্মসূচি পালন করেন।

এ বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, শিক্ষার্থীদের যেকোনো যৌক্তিক আন্দোলনের সঙ্গে ছাত্রদল সর্বদা একাত্মতা পোষণ করে। কিন্তু আন্দোলনের নামে অরাজকতা সৃষ্টি করলে তা কখনোই ছাত্রদল মেনে নেবে না।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা ন্যাশনাল মেডিকেলের পক্ষ হয়ে হামলা চালিয়েছিল– এ অভিযোগের বিষয় তিনি বলেন, আজ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে তাতে এর থেকে আরও বড় অভিযোগ দেওয়াটাই স্বাভাবিক। ছাত্রদলের সঙ্গে এর কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই। এ আন্দোলনের পেছনে বড় রকমের ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। অবিলম্বে দেশের গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশ প্রশাসন বিষয়টি সামনে নিয়ে আসবে।

মারা যাওয়া শিক্ষার্থী অভিজিতের বন্ধু সোহেল নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের ওপর কেন হামলা হলো? আমরা এখানে এসে কারো সঙ্গে কথা বলব কিন্তু কেউ নেই কথা বলার মতো। কেউ থাকলে আমরা আমাদের দাবি জানিয়ে চলে যেতে পারতাম। আমরা অভিযুক্ত ডাক্তারের লাইসেন্স বাতিল করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাই। এ ছাড়া আমাদের ওপর যারা হামলা করেছে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশকে পদক্ষেপ নিতে হবে।

কলেজ ভাঙচুরের বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী কলেজের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক তরিকুল ইসলাম বলেন, আমি তাদের একবার বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। পরে দলবল নিয়ে আবার আসছে। অনেক কম্পিউটার নিয়ে গেছে, ভেঙে ফেলেছে। বিএনসিসির রাইফেল নিয়ে গেছে। ১৭টা ডিপার্টমেন্টেই ভাঙচুর করেছে। এক শিক্ষকের প্রাইভেটকার, চারটা মোটরসাইকেল ভেঙেছে।

সোহরাওয়ার্দী কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপাল ড. ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, কাল (শনিবার) ওই কলেজের প্রিন্সিপাল ও আমাদের প্রিন্সিপাল একটা সমঝোতায় এসেছিলেন। আমরা আশ্বস্ত ছিলাম যে এমন কিছু হবে না। কিন্তু তারপরও হামলা হলো। পুরো কলেজে হামলা চালিয়েছে। আমার রুম পর্যন্ত ভেঙে ফেলেছে।

সোহরাওয়ার্দী কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ড. কাকলী মুখোপাধ্যায় বলেন, আজ পরীক্ষা ছিল। গতকাল রাতে পর্যন্ত কলেজের প্রিন্সিপাল সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলল শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছে, অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেছে। তারা বলল কিছু হবে না। আজ দুপুর সোয়া ১টায় কিছু বোঝার আগেই সিসিটিভিতে দেখি প্রচুর ছেলে-মেয়ে এসেছে। গেট ভেঙে ঢুকেছে। ইচ্ছামতো ভাঙচুর করেছে। গাড়ি ভাঙচুর করেছে। গ্যাস লাইন ছেড়ে দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের মার্কশিট, খাতা, ল্যাপটপ কিছুই নেই। আমি ঢাবিতে জানিয়েছি। প্রো ভিসি বলেছিলেন অ্যাপ্লিকেশন পাঠাতে। ভাঙচুরের জন্য তাও পাঠাতে পারিনি। এরা কি ছাত্র হতে পারে? এত নাশকতা তো ছাত্র করতে পারে না।

পুলিশের লালবাগ জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) জসিম উদ্দিন বলেন, গত ১৮ নভেম্বর মাহবুবুর রহমান কলেজের একজন মারা যান। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান বলে আমরা জানতে পারি। গত বুধবার কলেজের শিক্ষার্থীরা হাসপাতালে এসেছিলেন। এ ঘটনায় একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু এরপরও গত বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীরা অধিক সংখ্যায় এসেছিলেন। শিক্ষার্থীদের দাবি অবহেলাজনিত মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বারবার বলেছে আমরা শিক্ষার্থী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে তদন্ত করব। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চাপের মুখে রাখা হয়।

তিনি আরও বলেন, আজ ছাত্র প্রতিনিধি, মৃতের বাবার হাসপাতালে আসার কথা ছিল। আজ মিটিং ছিল। কিন্তু তারা আসেনি বলে আমরা জানতে পারি। এদিকে আজ আবার সকালে শিক্ষার্থীরা হাসপাতালে এসেছে। তারা যাত্রাবাড়ী থেকে অনেক সংখ্যায় এসেছে। আজ সকাল থেকে আমরা চেয়েছি তাদের বোঝাতে। অবশেষে আমরা সংখ্যা বাড়িয়ে বিকেলে তাদের বোঝাতে সক্ষম হই, পরে তারা চলে যায়।

ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. ইফফাত আরা বলেন, শিক্ষার্থীরা যে অভিযোগ করছে– ভুল চিকিৎসায় মারা গেছে, এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমরা কলেজ শিক্ষার্থী, মৃত শিক্ষার্থীর পরিবারের সঙ্গে বসেছি। একটি তদন্ত কমিটিও গঠন হয়েছে।

কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজ কীভাবে এতে জড়াল– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা জানি না তারা কীভাবে এলো। আমরা তাদের কোনো হেল্প চাইনি, কাউকে আসতেও বলিনি।

জানা গেছে, আন্দোলনে আসা কলেজগুলো হলো– ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ, ঢাকা কলেজ, ঢাকা আইডিয়াল কলেজ, সিটি কলেজ, গিয়াসউদ্দিন কলেজ, সরকারি তোলারাম কলেজ, ইমপেরিয়াল কলেজ, বোরহানউদ্দিন কলেজ, বিজ্ঞান কলেজ, ধনিয়া কলেজ, লালবাগ সরকারি কলেজ, উদয়ন কলেজ, আদমজী, নটরডেম, রাজারবাগ কলেজ, নূর মোহাম্মদ, মুন্সি আব্দুর রউফ কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী কলেজ, গ্রিন লাইন পলিটেকনিক, ঢাকা পলিটেকনিক, মাহবুবুর রহমান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা দনিয়া কলেজসহ রাজধানীর আরও কয়েকটি কলেজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *