আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। শিশুর সুস্থ মানসিকতা ও সৃজনশীল বিকাশের জন্য প্রকৃত ইতিহাস জানা অত্যন্ত জরুরী। ইতিহাস তথা কোনো বিষয় প্রতিষ্ঠার পিছনে যে সব ঘটনাগুলো রয়েছে সেগুলো জানা থাকলে সুনির্দিষ্ট ভবিতব্য তথা দেশের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে জানা সহজতর হয়। সেক্ষেত্রে অভিভাবকও সচেতন মহলের দায়িত্ব থাকবে নতুন প্রজন্মের নিকট তথা আগামী দিনের ভবিষ্যতের নিকট সঠিক তথ্য সরবরাহ করা।
৭ নভেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনের এক অনন্য ঐতিহাসিক তাৎপর্যমন্ডিত দিন। সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে আধিপত্যবাদ, একনায়কতন্ত্র, একদলীয় শাসন, জনজীবনের বিশৃঙ্খলাসহ তখনকার বিরাজমান নৈরাজ্যের অবসান ঘটে। একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ থেকে দেশ একটি সুশৃঙ্খল পরিবেশে ফিরে আসে।
১৯৭৫ সালের ৩ থেকে ৬ নভেম্বর মধ্য রাত পর্যন্ত দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর অনিশ্চিত অবস্থা বিরাজ করছিলো। হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিলো আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীর একটি উচ্চাভিলাষী দল সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে বন্দি করে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় দেশের সাধারণ জনগণ ও সিপাহীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর সর্বমহলে, বিশেষত সিপাহীদের কাছে ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। ফলে তারা পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ ও জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ৬ নভেম্বর মধ্যরাতে ঘটে সিপাহী-জনতার ঐক্যবদ্ধ এক বিপ্লব যা ইতিহাসে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে স্থান লাভ করেছে।
৭ নভেম্বরের বিপ্লব সম্পর্কে তদানীন্তন দৈনিক বাংলার রিপোর্টে বলা হয়, ‘সিপাহী ও জনতার মিলিত বিপ্লবে চারদিনের দুঃস্বপ্ন শেষ হয়েছে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাত প্রায় ১টায় সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর সিপাহী-জওয়ানরা বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। ষড়যন্ত্রের নাগ পাশ ছিন্ন করে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করেছেন বিপ্লবী সিপাহীরা। ৭ নভেম্বর শুক্রবার ভোরে রেডিওতে ভেসে আসে, ‘আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলছি।’ জেনারেল জিয়া জাতির উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে যথাস্থানে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। ওইদিন রাজধানী ঢাকা ছিলো মিছিলের নগরী। পথে পথে সিপাহী-জনতা আলিঙ্গন করেছে একে অপরকে। নারায়ে তাকবির আল্লাহু-আকবর, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ ধ্বনিতে ফেটে পড়েন তারা। সিপাহী-জনতার মিলিত বিপ্লবে ভন্ডুল হয়ে যায় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিরোধী সব ষড়যন্ত্র। আনন্দে উদ্বেলিত হাজার হাজার মানুষ নেমে আসেন রাজপথে। সাধারণ মানুষ ট্যাঙ্কের নলে পরিয়ে দেন ফুলের মালা। এই আনন্দের ঢেউ রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের সব শহর-নগর-গ্রামে ও পৌঁছে যায়।
ওই সময়ের ঘটনা নিয়ে প্রকাশিত বই, পর্যালোচনা, সাক্ষাৎকার বিশ্লেষণ করলে এ কথা বলা অসংগত হবেনা যে জাসদ বা তাহেরের পক্ষে এককভাবে কোনো ধরণের অভ্যুত্থান সংগঠনের সক্ষমতা ছিলো না। কর্নেল তাহের জেনারেল জিয়ার কাঁধে বন্দুক রেখে ক্ষমতার পাখি শিকার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এ ঘটনা প্রবাহের শেষ অঙ্কে জেনারেল জিয়াউর রহমান নেতার ভূমিকায় উপস্থিত হন এবং সবকিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। জেনারেল জিয়া সেনাবাহিনী ও জনসাধারণের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন, যে কারণে শেষ পর্যন্ত কর্নেল তাহের আর টিকতে পারেননি। ৭ নভেম্বরের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতিতে জাসদের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে পেছনের দরজার বা ষড়যন্ত্রের রাজনীতি দিয়ে জাসদ বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি।
প্রতিবছরই ৭ নভেম্বর এলে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা হয়। পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করা হয় কে কাকে উদ্ধার করেছেন? কে কাকে হত্যা করেছেন? এসব নিয়ে বিস্তর আলাপও হয়। দিনটি বিএনপি ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব ও জাতীয় সংহতি দিবস’ হিসেবে পালন করে। জাসদও ‘বিপ্লব দিবস’ হিসেবে পালন করে। আওয়ামীলীগও ‘মুক্তিযোদ্ধা সেনা-অফিসার হত্যা দিবস’ হিসেবে দিনটিকে পালন করতো।
এখানে তিন পক্ষের মধ্যে দুই পক্ষ, বিএনপি ও জাসদ ৭ নভেম্বরকে ‘বিপ্লব’ হিসেবে পালন করে। কিন্তু জাসদ শেষ পর্যন্ত বিপ্লবকে ধরে রাখতে পারেনি। জাসদ কি আসলেই বিপ্লব করেছিলো? না সুযোগের ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলো? তা ইতিহাসের নির্মোহ অবস্থান থেকে বিশ্লেষণ করতে হবে। স্বাধীনতার পরপরই হত্যা, হামলা, জখমের কর্মসূচি নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশে রাজনীতিতে আবির্ভূত হয় জাসদ। পরবর্তী সময় জাসদ এই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি থেকে আর বের হতে পারেনি। ওই সময়ের হাজারো মেধাবী তরুণকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের অলীক স্বপ্ন দেখিয়ে বিপথে ঠেলে দিয়েছিলো জাসদ। মেধা ও তারুণ্যের নিদারুণ অপচয় হচ্ছে জাসদ। এ কারণেই ৭ নভেম্বরের ঘটনা প্রবাহে জাসদ পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পায়নি। জাসদ সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি।
যে কোনো বিপ্লবের পূর্ব শর্ত হচ্ছে জনমত ও জনবলকে সংগঠিত করা। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর জাসদের নিজস্ব জনবল যথেষ্ট ছিলো না। তাই জেনারেল খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে পাল্টা অভ্যুত্থান জাসদের রাজনীতির কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়। ওই সময়ের জাসদের কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তে জাসদ এই অভ্যুত্থানে জড়িত হয়নি। বরং কর্নেল তাহের ও গুটি কয়েকজনের সিদ্ধান্ত এই ঘটনায় জড়িয়ে যায় জাসদ।
‘জাসদের উত্থান-পতন’ অস্থির সময়ের রাজনীতি গ্রন্থে মহিউদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, ৭ নভেম্বর সকালে কর্নেল তাহের ও হাসানুল হক ইনু সেনানিবাসে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে যান। ওই সময় জিয়া জাসদের মূল নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলতে চান। কিন্তু মূল নেতৃত্বে থাকা সিরাজুল আলম খান তখন নিরুদ্দেশ ছিলেন। তাঁর এই অদৃশ্য হওয়া থেকে ধারণা করা হয়, সিরাজুল আলম খান তাহেরের সাফল্য নিয়ে সন্দিহান ছিলেন এবং এই প্রক্রিয়ায় নিজেকে জড়াতে চাননি। এভাবেই কর্নেল তাহেরের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের মূল্য চোকাতে গিয়ে জাসদের রাজনীতির শেষের ধাপ শুরু হয়ে যায় ঠিক মতো বিকশিত হওয়ার আগেই।
জাসদের পক্ষ থেকে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগটা রক্ষা করতেন মেজর (অব.) জলিল। কিন্তু তৎকালীন বাকশালী সরকারের ব্যর্থতা এবং কু-শাসনের প্রতিবাদে ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও কর্মসূচীতে দ্বিতীয় বারের মত গ্রেফতার হন তিনি। মেজর জলিল কারান্তরীণ হলে কর্নেল তাহের এ দায়িত্ব লাভ করেন। এরপরই তিনি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভকে উসকে দিয়ে ‘বিপ্লবী সৈনিকসংস্থা’ নাম দিয়ে এক ধরণের গণবাহিনী গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। তিনি ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে ওই বিপ্লবী সৈনিকসংস্থা ও বিপ্লবী গণবাহিনীকে ব্যবহার করে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে একটি প্রতিবিপ্লব করেন। কিন্তু কর্নেল তাহেরের হিসাবে বড় ধরণের ভুল ছিলো। সামরিক বাহিনীতে জেনারেল জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা এবং সেনাবাহিনীর অন্য কর্মকর্তাদের অবস্থান সম্পর্কে সম্ভবত তাঁর স্পষ্ট ধারণা ছিলো না। সৈনিকদের উপর তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। খালেদ মোশাররফও একই ভুল করেছিলেন। সেনাবাহিনীর অবস্থান ও জিয়ার জনপ্রিয়তা সম্পর্কে সম্ভবত তিনিও ভুল হিসাব করেছিলেন। যে কারণে দুজনই ৭ নভেম্বরে ঘটনার আড়ালে চলে যান। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ প্রতিবিপ্লবে নির্মমভাবে নিহত হন এবং কর্নেল তাহের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে দূরে সরে যান। কারণ, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল তাহের, তাদের দুজনের প্রতি সামরিক বাহিনী বা জনসাধারণের বড় অংশের সমর্থন ছিলো না; বরং অভাবনীয়ভাবে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা জেনারেল জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করেন। জাসদ দাবি করে, তারাই জেনারেল জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করেছেন। জাসদের এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বরং জেনারেল জিয়ার জনপ্রিয়তার ওপর ভর করে জাসদ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ নিয়েছিলো। কিন্তু ‘বিপ্লবী সৈনিকসংস্থা’ কর্তৃক সামরিক বাহিনীর অফিসার হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে দ্রæত কর্নেল তাহের বা জাসদ ওই সময়ের ঘটনা প্রবাহের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেন। বরং সামরিক বাহিনী ও জনসাধারণের সম্মিলিত উদ্যোগের কারণে জাসদের সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়।
জেনারেল জিয়াউর রহমানের সমর্থনে সামরিক বাহিনীর সদস্য ও সাধারণ মানুষ পথে নেমে এসেছিলো। জিয়াউর রহমান রণাঙ্গনে লড়াই করা মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ভাগ্য সাহসীদের সঙ্গে থাকে। জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের একজন। মূলত এসব কারণে জেনারেল জিয়ার প্রতি সাধারণ মানুষের এক ধরনের আস্থা ছিল। এ আস্থাই ১৯৭৫-এর নভেম্বরে জেনারেল জিয়াকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে ক্ষমতার দিকে নিয়ে আসে। এবারের নভেম্বরে অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে চরম শঙ্কায় পড়েছে দেশ। কী হবে? এক অজানা আতঙ্ক জনমনে। ইতিহাসের এক যুগ-সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ।
ইতিহাসের সত্যতা : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ঘটনা এবং ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ধারাবাহিকতায় ওই দিনই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তার অনুসারী সেনাসদস্যদের নিয়ে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করেন। আত্মস্বীকৃত পদোন্নতি নিয়ে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, মেজর জেনারেলের ব্যাজ ধারণ এবং সেনাপ্রধানের পদ অবৈধ পন্থায় দখল করলেও নিরব বিদ্রোহ জেগেছিলো সৈনিকদের হৃদয়ে। ৬ নভেম্বর স্ব-ঘোষিত মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদকে গ্রেফতার করেন। কথিত মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ মন্ত্রিসভা বাতিল ও জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়ার ঘোষণা দেন। একই দিনে তিনি প্রধান বিচারপতি আবু সা’দাত মোহাম্মদ সায়েমকে দেশের প্রেসিডেন্টের পদে এনে বসান। এভাবে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, অনিশ্চয়তা ও একটা সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কেটে যায় প্রায় চারদিন। পরবতীতে ৬ নভেম্বর গভীর রাতে সেনাবাহিনীর সাধারণ সিপাহীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশপ্রেমবোধ নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সেই অভ্যুত্থানে সকলের সজীব সমর্থন দিয়ে সর্বস্তরের মানুষ রাজপথে নেমে আসেন।
সিপাহি-জনতার সেই বিপ্লবে মুক্ত হন সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অভ্যুত্থান নস্যাত করতে গিয়ে প্রাণ হারান স্ব-ঘোষিত জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও তার কিছু অনুসারী। ৭ নভেম্বর সর্বস্তরের সৈনিক ও জনতা সম্মিলিতভাবে নেমে আসে ঢাকার রাস্তায়, ছড়িয়ে পড়ে উচ্ছাসে আর ভালোবাসায় এক আনন্দঘন পরিবেশ। বিশাল এক জনসংহতির নজির সৃষ্টি হয় দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি নির্মাণের প্রচেষ্টায়। তাইতো ৭ নভেম্বর হচ্ছে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তদানীন্তন দৈনিক বাংলার রিপোর্টে ‘বিপ্লব’ সম্পর্কে বলা হয় ‘সিপাহী ও জনতার মিলিত বিপ্লবে চারদিনের দুঃস্বপ্ন শেষ হয়েছে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হয়েছেন যা ছিলো মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ নির্মাণের এক মহারথ। বৃহস্পতিবার রাত প্রায় ১টায় সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর সিপাহী-জওয়ানরা বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। ষড়যন্ত্রের ভেদ ছিন্ন করে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করেছেন দেশপ্রেমিক সিপাহীরা। ৭ নভেম্বর শুক্রবার ভোরে রেডিওতে ভেসে আসে ‘আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলছি’। জেনারেল জিয়া জাতির উদ্দেশে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে যথাস্থানে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান এবং শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে কাজ করে যাবার আহ্বান জানান। রাজধানী ঢাকা সেদিন মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়েছিলো। পথে পথে সিপাহী-জনতা আলিঙ্গন করেছে একে অপরকে। দেশপ্রেমিক সিপাহী-জনতার মিলন মেলায় ধ্বংস হয়ে যায় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিরোধী সকল ষড়যন্ত্র। আনন্দে উদ্বেলিত সাধারণ মানুষ নেমে আসেন রাজপথে। সাধারণ মানুষ ট্যাংকের সামনে রাখেন ফুলের মালা। এই আনন্দের স্রোত রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের সব শহর-নগর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামেও পৌঁছে যায়।’
১৯৭৫ সালের ‘বিপ্লব ও সংহতি’রই অনুপ্রেরণা যেনো ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব। ১৯৭৫ সালের এক দলীয় বাকশাল গঠন যেমন গণমানুষের আকাক্সক্ষাকে পদদলিত করা হয়েছিলো, হত্যা করা হয়েছিলো গণতন্ত্রকে। হরণ করা হয়েছিলো মানুষের ভোটাধিকার। মুজিব বাহিনী ও রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারে দেশের মা-বোনের ইজ্জত রক্ষার কোনো উপায় ছিলো না, অতিষ্ঠ ছিলো মানুষ। সরকারের অনুকম্পায় বেঁচে থাকা চারটি পত্রিকার ছিলোনা কোনো লেখনীর স্বাধীনতা। বাকশালীয় লুটপাটে অবশেষে ঘটেছিলো ইতিহাসের জঘণ্যতম দুর্ভিক্ষ, সাধারণ মানুষ ছিলো দিশেহারা। কাপড়ের অভাবে মানুষ মাছ ধরার জাল ছিঁড়ে ইজ্জত আব্রো রক্ষার চেষ্টা করতো। ব্যাংক লুট করাসহ সেনাবাহিনীর অফিসারের সুন্দরী বউকে অপহরণের মতো জঘন্য ঘটনার সৃষ্টি করাসহ এমন একটা বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে এসে ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেনা বিপ্লব। সেই বিপ্লবে প্রাণ হারান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও বাকশালের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর পরের ধারাবাহিক ঘটনারই অংশ ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব। ২০২৪ সালের বিপ্লবের দানা বাঁধতে শুরু করে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় সংঘটিত লগি বৈঠার তাণ্ডবের পর থেকে। মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করে লাশের ওপর নৃত্য করা হায়েনাদের মানুষ ঘৃণাভরে ক্ষোভ পোষণ করে। এর পর কেটে যায় দীর্ঘ ১৮ বছর। ধারাবাহিক ভাবে ফ্যাসিস্টের রূপ ধারণ করতে থাকে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী ও চৌদ্দ দলীয় জোট। বাকশালীয় কায়দায় বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দমন পীড়ন করতে থেকে আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে আবারো মানুষের ভোটাধিকার হরণ করার প্রকৃয়ায় বাতিল করা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি। বিতর্কিত আদালত গঠন করে বিরোধী মতের নেতাদেরকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়। জননন্দিত নেত্রী তিন বারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, বেগম খালেদা জিয়াকে বাস্তুভিটাহীন করে মিথ্যা মামলায় তাঁকে জেলে বন্দী করা হয়। পৃথিবীর ইতিহাস ভঙ্গ করে আদালতের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়া, সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা কাদের মোল্লার সাজা বাড়িয়ে গণমানুষের মনে আরো ঘৃণা জাগিয়ে তোলেন। সরকারী মদদে তথাকথিক গণজাগরণ মঞ্চ বানিয়ে গণমানুষের ভোগান্তি সৃষ্টি করে ঢাকার শাহবাগ মোড়ে বিরিয়ানী খাইয়ে আন্দোলন করিয়ে আইন পরিবর্তন করে একজন নেতার ফাঁসি নিশ্চিত করা হয়। দেশের জনগণকে ধারাবাহিক দমন পীড়ন অব্যাহত রেখে ডিজিটাল নিরাপত্তার মতো কালো আইন করে সামাজিক যোগাযোগের বাক-স্বাধীনতা পর্যন্ত হরণ করা হয়। ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন, ২০১৮ সালের রাতের ভোটের পুলিশি নির্বাচন ও ২০২৪ সালের ডামী নির্বাচনের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধের চেতনা ফেরি করে, আওয়ামী পরিবারের অসংখ্য ভ‚ঁয়া মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে কোটার নামে সরকারী চাকুরীতে ৫৭% কোটা দখল করেন আওয়ামী জোট সরকার। কোটা ও ড্রাইভার আবেদ আলীর প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় দেশের সাধারণ মানুষ ও মেধাবীরা যখন চাকুরি পাচ্ছে না, তখনই মানুষের ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। ২০১৮ সালে শুরু হয়, কোটা বিরোধী আন্দোলন। সেই আন্দোলনে বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র সংগঠন নামধারী গুÐারা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদেরকে হামলাসহ লাঞ্ছিত করলে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকুরিতে সব কোটা বাতিল করে দিতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে আবার সেই পুরনো পলিসিতে আদালতের মাধ্যমে কোটা পূণর্বহাল করার চেষ্টা করলে গত ১৮ বছরের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দানা বাঁধতে থাকে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদেরকে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গালি দিলে ক্ষোভে ফেটে পড়েন দেশের আপামর জনতা। আন্দোলনকারী ছাত্রদেরকে বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন বেধরক পিঠানো ও লাঞ্ছিত করলে ঘৃণা ও ক্ষোভে আন্দোলনে নেমে আসেন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেকবান কিছু শিক্ষক ও সাধারণ জনগণ। শুরু হয় বাংলা বøকেডের মতো অভিনব কিছু আন্দোলন। চলতে থাকে আওয়ামী জোট এবং সরকারী বাহিনীর দমন পীড়ন ও হত্যা। কিন্তু কোনো দমন-পীড়নই যেনো দমিয়ে রাখতে পারেনি গত ১৮ বছরের ক্ষোভে ফেটে পড়া গণমানুষকে। গুলি করে হত্যা করা হয় আবু-সাইদ, মুগ্ধদের মতো হাজারো তরুণকে। গুলিতে নিহত শত শত লাশকে বেওয়ারিশ দাফন করা হয় গণ-কবরে। এমনকি মহান জাতীয় সংসদ ভবণের পাশেও গণকররের সন্ধান পাওয়া যায়। গুলিতে নিহত লাশের ভ্যানে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয় লাশের স্তুপ। বিক্ষোভে ফেটে পড়েন সাধারণ মানুষ। রাগে ঘৃণায় অভিশাপ দিতে থাকেন আন্দোলনে আসতে না পাড়া কোটি জনতা। অবশেষে কর্মসূচী ঘোষণা করা হয় ঢাকামুখী লংমার্চ। কৌশলে একদিন এগিয়ে আনাও ছিলো এক বিরাট সফলতার অংশ। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দিশে হারা হয়ে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দেন পদত্যাগ ও দেশত্যাগের। কিন্তু শেখ হাসিনার বানানো জেনারেলকে অর্ডার দেন গুলি চালিয়ে ম্যাসাকার করে যে কোনো উপায়ে আন্দোলন দমন করার। কিন্তু সেনাবাহিনীর কিছু জুনিয়র অফিসার সেই ম্যাসাকার করার অর্ডার মানতে অস্বীকৃতি জানালে বিপাকে পড়েন গণহত্যার নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা। অবশেষে পরিবারের অনুরোধে রাজী হন পদত্যাগ ও দেশত্যাগের মতো বেদনাদায়ক সিদ্ধান্ত নিতে। ০৫ আগস্ট দুপুরে কোটি জনতা যখন গণভবনের দিকে যাত্রা শুরু করে তখন সেনাপ্রধানের অনুরোধে দ্রুত সেনা হেলিকপ্টারে করে দেশত্যাগে বাধ্য হন ১৮ বছরের বিভিন্ন জঘন্য অপরাধী ফ্যাসিস্ট খেতাব প্রাপ্ত শেখ হাসিনা। টেলিভিশনে সেনা প্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার খবর প্রচারিথ হওয়ার সাথে সাথে আনন্দে ফেটে পড়েন দেশের আপামর জনতা। খুশিতে কেউ কেউ বাদ্য বাজনা নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। গত ১৮ বছরের শেখ হাসিনার নির্যাতনের নির্দেশ পালনকারী বাংলাদেশ পুুলিশের সকল সদস্য কর্মস্থল ত্যাগ করে গা ঢাকা দিলে রাস্তায় নেমে আসেন সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে বিজিবি। সেই ৭ই নভেম্বর ১৯৭৫ সালের দৃশ্য যেনো পুনারাবৃত্তি ঘটেছে। আনন্দিত মানুষ সেই দিন যেমন ট্যাংকের নলে ফুলের মালা পড়িয়ে দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি সেনাবাহিনীর সদস্যদেরকে মানুষ ফুল দিয়ে বরণ করে, স্যালুট করে অভিবাদন জানান। ২০২৪ এর বিপ্লব যেনো ১৯৭৫ সালের সেই বিপ্লবেরই অনুপ্রেরণা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর ইতিহাসে ‘বিপ্লব ও সংহতি’ দিবস দেশ গঠনের ঐতিহাসিক সূচনা পর্ব, যার মধ্য দিয়ে সার্বভৌমত্ব বিরোধী গভীর সঙ্কট থেকে জাতি রক্ষা পেয়েছিলো। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবও যেনো আরেক দেশপ্রেমের সূচনা। এই বিপ্লবের ফল স্বরূপ আবার মানুষ ফিরে পাবে তার ভোটাধিকার, দূর্নীতিমুক্ত পরিবেশ মানুষ বসবাস করে ফিরে পাবে প্রকৃত নাগরিক সুবিধা। দেশপ্রেম অটুট থাকুক সকলের অন্তরে; এগিয়ে যাক বাংলাদেশ। ২০২৪ সালে মুক্তিযোদ্ধের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করুক দেশের রাজনীতিবিদসহ আপামর জনগণ। ভবিষ্যতে যেনো এদেশে আর কোনো ফ্যাসিস্টের জন্ম না হয়। মহান দুই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহমান থাকুক ইতিহাসের বাংলাদেশ জুড়ে।
লেখক,
আহ্বায়ক
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম।