মে. জে. (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক
—গত দুইটি কলাম ছিল রমজান, রোজা, পবিত্র কুরআন ইত্যাদি সম্পর্কিত। আজকে লিখব ‘শিকড়’ নামক শব্দটির বিভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে। প্রথমেই লিখতে চাই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার শিকড়ের বিষয় নিয়ে। অতঃপর লিখব ঈমানি সংস্কৃতির শিকড়ের একটি বিষয় নিয়ে যথা বদরের যুদ্ধ নিয়ে। সর্বশেষে বাংলাদেশের রাজনীতির ছড়ানো ছিটানো শিকড় নিয়ে।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার শিকড়
মুক্তিযুদ্ধের শিকড়ের গল্প বলার আগে একটি সর্বজনীন বক্তব্য দিই। বক্তব্যটি হলো এই : বৃ বা গাছ যেমন মানুষ এবং মাটির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে, তেমনই গাছের শিকড় মাটির ভেতরে গিয়ে গাছকে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করে। যেই গাছের শিকড় যত গভীরে যায়, সেই গাছ ততই শক্তিশালীভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, তুফান এলেও পড়ে না। অর্থাৎ শিকড়ের শক্তির ওপরে, অবশিষ্ট দেহের স্থিতিশীলতা নির্ভর করে।
পৃথিবীর সব দেশেই সেনানিবাসগুলো বা সামরিক বাহিনীর প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত জনগণের জন্য উন্মুক্ত নয়, এইগুলো পর্যটন এলাকা নয়। কিন্তু সেনানিবাসগুলোর ভেতরেও শিামূলক বেড়ানোর জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা আছে বা থাকে। উদাহরণস্বরূপ কয়েটি স্থাপনার পরিচয় দিচ্ছি। (চার তারকা) জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান বীর বিক্রম সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব নেয়ার দুই বছর আগে ১৯৯৩-১৯৯৫ সময়কালে যশোর অঞ্চলের এরিয়া কমান্ডার ও যশোর এলাকায় অবস্থিত পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (বা সংেেপ জিওসি) ছিলেন। ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে আমি তৎকালীন মেজর জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান বীর বিক্রমের কাছ থেকে জিওসি হিসেবে দায়িত্ব বুঝে নিয়েছিলাম। জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য ও গৌরবগাঁথা সেনাবাহিনীর পরিবেশে সুদৃঢ়ভাবে স্থিত করার জন্য অনেকগুলো পদপে নিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি হলো যশোর সেনানিবাসের আরবপুর প্রবেশ পথের সন্নিকটেই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর (যার নাম গৌরাবাঙ্গন) প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সেনাবাহিনী প্রধান হওয়ার পর তিনি ঢাকা সেনানিবাসের মাঝামাঝি এলাকায় সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর যার নাম ‘বিজয় কেতন’ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। জেনারেল মোস্তাফিজের কর্মকাণ্ডের প্রেরণায় সব সেনানিবাসেই, ছোট হোক বড় হোক, মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর স্থাপিত হয়েছে। ঢাকার বাইরে জাদুঘরগুলোতে, মুক্তিযুদ্ধকালীন ওই এলাকার বা সেক্টরের ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করা হয়েছে। ভাটিয়ারিতে আমার অবস্থান শেষ হয় ১৯৯৫-এ।
তৎকালীন চট্টগ্রামের জিওসি মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান বীর উত্তমের নির্দেশে ১৯৯৫ জুলাই থেকে ডিসেম্বর ছয় মাস পরিশ্রম করে আমরা চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ‘স্মৃতি অম্লান’ নামে মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর স্থাপন করি। ভাটিয়ারিতে অবস্থিত বাংলাদেশ মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে আমি কমান্ডান্ট থাকা অবস্থায়, আমি ও আমার সহকর্মীরা মিলিতভাবে ‘স্বাধীনতা মানচিত্র’ নামে একটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য নির্মাণ করি সম্পূর্ণ অনানুষ্ঠানিক ও বেসরকারি উদ্যোগে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভাস্কর অলক রায়, কোনো প্রকারের কনসালট্যান্সি ফি ছাড়াই আমাদের প্রচুর সহায়তা করেছিলেন। সেই ভাস্কর্যের একটি জায়গায় একটি বটগাছের গোড়ালি স্থাপিত আছে, প্রতীকী অর্থে। বটগাছ প্রাচীনত্বের প্রতীক, বটগাছের শিকড় দৃঢ়বন্ধনের প্রতীক। ওই প্রতীকী বটমূল দিয়ে বোঝানো হয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা এবং দেশের মাটির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক। আমার লেখা ১১তম বই ‘মিশ্র কথনের’ ৬ নম্বর অধ্যায়ে তথা ২২৭ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে ২৩৩ নম্বর পৃষ্ঠায় এই সম্বন্ধে উল্লেখ আছে। আগ্রহী পাঠক www.generalibrahim.com আমার ওয়েবসাইট-এ গিয়ে এই বর্ণনা পড়তে পারেন। অথবা বাজার থেকে সংগ্রহ করেও পড়তে পারেন। স্বাধীনতা মানচিত্র নামক মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য স্থাপনের বা সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল যুগপৎ তাৎণিক ও দীর্ঘমেয়াদি। বিএমএ-ভাটিয়ারিতে প্রশিণরত জেন্টলম্যান ক্যাডেটরা যেন সদাসর্বদাই মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকী কিছু একটা চোখের সামনে পান। ছুটির দিনে, অথবা অবসর সময়ে ওখানে বেড়াতে গিয়ে দেখবে ভালো করে। বাবা, মা ও ভাইবোন আত্মীয়স্বজন ভাটিয়ারিতে বেড়াতে এলে তাদের দেখাবে। পুরো ভাস্কর্যে যেসব অঙ্গ আছে তার প্রত্যেকটার তাৎপর্য সেই জেন্টলম্যান ক্যাডেটের মনে গভীরভাবে প্রথিত হবে। জেন্টলম্যান ক্যাডেটরা যদিও মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মের বাংলাদেশী, তথাপি তারা যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দূরে না থাকে তার জন্যই এই প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিলাম। কারণ আমার আগে দশজন কমান্ডান্ট ছিলেন। কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থিত ৪৪ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডারের দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে বিএমএর প্রথম কমান্ডান্ট ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা (১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের ৭ তারিখ সকাল ৮-৯টার দিকে কঠিন পরিস্থিতিতে নিহত হন)। পরে আর কোনো মুক্তিযোদ্ধা অফিসার কমান্ডান্ট হননি, ১১০তম কমান্ডান্ট আমি ছিলাম মুক্তিযোদ্ধা। আমার পরেও আর কোনো মুক্তিযোদ্ধা অফিসার বিএমএর কমান্ডান্ট হননি। একজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসার হিসেবে জাতি গঠনের তাগাদায় স্বাধীনতা মানচিত্র নামক ভাস্কর্য সৃষ্টি করেছিলাম। অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশের শিকড় মুক্তিযুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই অতিতের আন্দোলনগুলোতে নিহিত এই কথা বোঝানার জন্য।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে। কিন্তু এর প্রোপট প্রায় সত্তর বছর পূর্ব থেকে শুরু। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকাকে রাজধানী করে যেই নতুন পূর্ববঙ্গ প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল সেটাই আমাদের আদি আন্দোলন। অতঃপর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিা আন্দোলন, ১৯৬৬-৬৭ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৮-৬৯ সালের গণ-আন্দোলন ইত্যাদির প্রোপটেই ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে নির্বাচন হয়েছিল। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে, আন্দোলনের মূল ফোকাস ছিল অর্থনৈতিক সাম্য, রাজনৈতিক সমঅধিকার ও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও গণতান্ত্রিক চর্চা প্রতিষ্ঠিত করা। ১৯৭০-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে তৎকালীন পাকিস্তানের শাসক সামরিক জান্তা, ওয়াদা দিয়েছিলেন, আগামী নির্বাচনে যারাই জিতবে তারা কেন্দ্রীয় মতায় যাবে এবং তারা নতুনভাবে সংবিধান রচনা করবে। নতুন সংবিধান অবশ্যই পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক সাম্য, রাজনৈতিক সম-অধিকার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করবে। সময়মতো নির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের পরে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ওয়াদা রা করেননি। গণতান্ত্রিকভাবে বিজয়ী রাজনৈতিক দল তৎকালীন আওয়ামী লীগকে পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা মতায় যেতে দেননি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম কারণ ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা, গণতান্ত্রিক চর্চা প্রতিষ্ঠিত করার পরিবেশ সৃষ্টি করা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার শিকড় মুক্তিযুদ্ধের ভেতর নিহিত। স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার শিকড় গণতান্ত্রিক চেতনার মধ্যে নিহিত। কিন্তু আমরা এই শিকড়ের যতœ নিতে পারিনি। বাঙালি হিসেবে এবং বাংলাদেশী হিসেবে গত ৪৩ বছর আমরা গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতি অমর্যাদা প্রদর্শন করেই যাচ্ছি। এখন (বাংলাদেশে নিযুক্ত এক সময়ের মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলামসহ) সব সচেতন দেশের ও বিশ্বের নাগরিকদের মতে আমরা একদলীয় রাষ্ট্র রচনার দিকে ধাবিত হচ্ছি। আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক শিকড় উপড়ে ফেলতে চাচ্ছি।
ঈমানি শিকড়
পাঠক এই কলাম পড়ছেন আজ বুধবার রমজান মাসের ১৭ তারিখ, ১৪৩৫ হিজরি। এখন থেকে ১৪৩৪ হিজরি বছর আগে, ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে শুক্রবার ১৭ রমজান তারিখে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। যুদ্ধের স্থানটির নাম ছিল ‘বদর’। মদিনা নগরীতে কিছু দূরে অবস্থিত প্রায় জনমানবহীন একটি উপত্যকা ও চলাচল পথের সঙ্গমস্থল। এই যুদ্ধের প্রোপট পরবর্তী কয়েকটি অনুচ্ছেদে উপস্থাপন করছি। কলামের কলেবর সংপ্তি রাখার প্রয়োজনে বর্ণনা সংপ্তি করব এবং আমার ওয়েব সাইটে একটি দীর্ঘ কলাম পাঠক পড়তে পারবেন।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: তার জন্মস্থান মক্কা নগরী ত্যাগ করে, কমবেশি ৪০০ মাইল দূরে অবস্থিত ইয়াসরেব নামে জনপদ বা শহরে গমন করেছিলেন। ইসলামি পরিভাষায় সেই ‘গমণ’কে হিজরত বলা হয়েছে। মহানবী সা: ইয়াসরেব নামে জনপদে বা শহরে আসার কারণে ইয়াসরেব শহরের জনগণ তাদের জনপদের নাম বদলে ফেলেছিল। পরিবর্তিত নাম হয়েছিল মদীনা-তুন-নবী অর্থাৎ নবীর শহর। কালের পরিক্রমায় ব্যবহার করতে করতে সেই শহরের নাম হয় ‘মদিনা’। নবুয়তপ্রাপ্তির পর মহানবী সা: ১৩ বছর ছিলেন মক্কায় ও দশ বছর ছিলেন মদীনায়। কিন্তু সম্মিলিত জীবনব্যবস্থা হিসেবে মানবতার জন্য পথ প্রদর্শনকারী সর্বাঙ্গীণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে দ্বীন-ইসলাম প্রস্ফুটিত হয়েছিল পবিত্র মদিনা নগরীতেই। দ্বীন ইসলামের রাজনৈতিক আঙ্গিক, প্রশাসনিক আঙ্গিক, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আঙ্গিক সব কিছুই প্রস্ফুটিত হয়েছিল পবিত্র মদিনা নগরীতে। আজকে যেটাকে রাজনৈতিক পরিভাষায় আমরা সংবিধান বলি, তার প্রথম ভিত্তি এই পৃথিবীর জন্য রচিত হয়েছিল পবিত্র মদিনা নগরীতে; যাকে আমরা বলছি মদিনার সনদ বা ইংরেজি ভাষায় দ্য চার্টার অব মদিনা।
মদিনা যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে এবং মদিনাকেন্দ্রিক মুসলমান জনপদ যে তৎকালীন সমগ্র আরব দেশের জন্য এবং সব বেদুইন ও অবেদুইন গোষ্ঠীর জন্য বিপদের কারণ হবে, সেটা মক্কার কোরায়েশ নেতারা বুঝতে পারছিলেন। সেই জন্যই তারা বদ্ধপরিকর ছিল, উঠতি মুসলিম শক্তিকে অঙ্কুরেই নষ্ট করার জন্য। অপরপে নিজেদের শক্তিকে সুসংহত করার জন্য এক বছর বয়সী মদিনাকেন্দ্রিক মুসলিম শক্তি চাচ্ছিল মক্কার শক্তিকে প্রথম সুযোগেই নিজেদের শক্তি সম্বন্ধে একটি পরিচয় দেয়া এবং এই পরিচয় দিতে গিয়ে অস্ত্র ও সম্পদ আহরণ করা। এই প্রোপটেই বদর নামে স্থানে মদিনাকেন্দ্রিক মুসলিম শক্তি এবং মক্কাকেন্দ্রিক কাফের শক্তির মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা ছিল অমুসলমানদের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগ। যুদ্ধের অতি প্রয়োজনীয় বাহন ঘোড়া ও উট ছিল দশ ভাগের এক ভাগ। এই যুদ্ধে চূড়ান্ত পর্যায়ে মুসলমানেরা স্পষ্টভাবে বিজয়ী হন। যদি মুসলমানেরা বিজয়ী না হতেন, তাহলে মুসলিম শক্তি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই ছিল নিশ্চিত এবং দ্বীন ইসলামের প্রচার কিভাবে হতো বা না হতো, অথবা আদৌ আর হতো কি না, তা মানবীয় বুদ্ধি দ্বারা বিবেচনা বা অনুমান করা কঠিন ছিল। তাই মহানবী সা: কায়মনোবাক্যে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে সাহায্য এবং সাহায্যের মাধ্যমে বদরের যুদ্ধে কাফেরদের ওপরে বিজয় প্রার্থনা করেছিলেন। বদরের যুদ্ধের তাৎণিক পূর্ববর্তী অবস্থা, যুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধ ময়দানের অবস্থা ও কর্মকাণ্ড ইত্যাদি প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনেও অনেক আয়াত নাজিল হয়েছে। মুসলমানেরা বদরের যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ ছিল। একটি কারণ হলোÑ ওই যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি মহানবী সা: কর্তৃক অভিনব পদ্ধতিতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা এবং ভৌগোলিক অবস্থানের সৎ ব্যবহার করা। দ্বিতীয় কারণ হলো, মহান আল্লাহ তায়ালার দয়ায় ওই দিনের আগের রাতের প্রকৃতি সহায়ক ছিল তথা বৃষ্টি হয়েছিল। তৃতীয় সর্বশেষ ও প্রধানতম কারণ হচ্ছে, জিবরাইল আ:-এর মাধ্যমে যুদ্ধের কৌশল প্রসঙ্গে মহানবী সা:-এর নিকট বার্তা পৌঁছানো ও ফেরেশতা দ্বারা প্রত্যভাবে যুদ্ধের ময়দানে সহায়তা করা। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব সম্মানিত সাহাবিরা তথা মুসলিম সেনাবাহিনী তাদের প্রধান সেনাপতির প্রতি আনুগত্যে অবিচল ছিলেন। সেনাবাহিনীর সবাই প্রধান সেনাপতি হজরত মুহাম্মদ সা:সহ, মহান আল্লাহ তায়ালার সাহায্যের ওপর শতভাগ আস্থাবান ছিলেন। মুসলিম সেনাবাহিনী কোনো অবস্থাতেই নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যরে ওপর ভিত্তি করে যুদ্ধের ময়দানে কৌশল ও কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেননি। মুসলিম সেনাবাহিনী আল্লাহর ওপর ভরসা (ইসলামি পরিভাষায় তাওয়াক্কুল) করেই সব পদপে নিয়েছিলেন। ইসলামি সংস্কৃতিতে ইসলামি সভ্যতায় শিকড়ের গোড়া গিয়ে ঠেকে মক্কা নগরীতে যেখানে রাসূলুল্লাহ সা: ১৩ বছর সংগ্রাম করেছিলেন ও ঠেকে মদিনা নগরীতে যেখানে ১০ বছর সংগ্রাম করেছিলেন। সংগ্রামী জীবনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো বদরের যুদ্ধ। ইসলামি সংস্কৃতিতে শিকড়ের গভীরতম আগা হচ্ছে সব সৎ কাজে ও সংগ্রামে, আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করা।
রাজনীতির ছড়ানো ছিটানো শিকড়
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর শত্র“প আত্মসমর্পণ করলেও দেখা যায় বোঝা যায় এমন একটি সরকার দেশ শাসন শুরু করেছিল দুই সপ্তাহ পর জানুয়ারি মাসের শুরুতে। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান প্রতিপাদ্য ও আরাধ্য বিষয় ছিল গণতান্ত্রিক শাসন ও সমাজব্যবস্থা। স্বাধীন বাংলাদেশ শুরু করেছিল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট। আনুমানিক ১২ মাসের মাথায় বাংলাদেশের সংবিধান যখন গৃহীত হয় তখন শাসনপদ্ধতি পরিবর্তিত হয়। ১৯৭৩-এর মার্চের নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধু হয়ে যান প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭৩-৭৪ সালে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এত অবনতি হয়েছিল যে, তা বর্তমান প্রজন্ম কল্পনা করতে পারবে না। একাধিক অপশক্তি এর জন্য দায়ী। প্রশাসনিক অদতা এর জন্য দায়ী। তৎকালীন শাসক দলের লোভ-লালসার জন্য দায়ী। পরিস্থিতি সামলানোর জন্য অথবা নিজেদের মতা পাকাপোক্ত করার জন্য, পার্লামেন্টারি পদ্ধতির গণতন্ত্রকে তথা বহুদলীয় গণতন্ত্রকে হত্যা করে, একদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে। এর নাম ছিল বাকশাল পদ্ধতি। শাসক রাজনৈতিক দল ব্যতীত, রাষ্ট্রের বা সরকারের বা সমাজের আর কোনো অঙ্গের স্বাধীনতা, বাকশাল পদ্ধতিতে ছিল না। বহু দিনের পরিচর্যায় লালিত ও হৃষ্টপুষ্ট হয়ে আসা গণতন্ত্রের শিকড়ের ওপর প্রথম আঘাত (বাংলাদেশ আমলে) হলো ওই বাকশাল পদ্ধতি। পর্যবেণকারী ও মন্তব্যকারীরা বলেছেন, বাকশাল পদ্ধতিতে কোনো রাস্তা ছিল না বৈধভাবে সরকার পরিবর্তনের। অতএব বাকশালের ভেতর থেকেই এর বিরুদ্ধে খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে পরিবর্তনের প্রস্তুতি শুরু হয়। ফলাফল হচ্ছে ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের ১৫ তারিখ। কিন্তু সেই যে নিয়মশৃঙ্খলা ভঙ্গ হলো তা রিপিট বা পুনঃঅনুষ্ঠিত হলো ৩ নভেম্বর ১৯৭৫।
১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের অরাজকতা সত্ত্বেও তৎকালীন জাসদ নামে আড়াই বছর বয়সী রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে এবং তৎপরতায় ৭ নভেম্বর তারিখে আরেকটি মহাঅরাজক ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। তবে ভাগ্য ভালো যে, দেশপ্রেমিক সৈনিকের তাৎণিক চেষ্টা ও তাৎণিক প্রতিরোধের কারণে জাসদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড প্রতিহত হয়েছিল। ঘটনার পরিক্রমায় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম মতার কেন্দ্রবিন্দুতে উপস্থাপিত হন। জিয়াউর রহমান নিজে সামরিক শাসন জারি করেননি, নিজে কোনো বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেননি। তিনি শান্তিকামী দেশপ্রেমিক সৈনিক ও জনতার প্রতিভূ ছিলেন মাত্র। জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও অভীষ্ট ল্েয পৌঁছান। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র কায়েম করেন। গণতন্ত্রের শিকড় ১৯৭৫-এ যেই আঘাত পেয়েছিল সেই আঘাত সেবা শুশ্রƒষা পেয়ে সেরে ওঠে। কিন্তু ১৯৮২ সালের মার্চের ২৪ তারিখ তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিনারক্তপাতে মতা গ্রহণ করেন। এখন থেকে চার দিন আগে (১২ জুলাই ২০১৪) অপর একটি জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একটি দীর্ঘ কলাম লিখেছেন। তার কলামটির শিরোনাম ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সমীপে আমার কিছু কথা’। শিরোনামটি যদি এ রকম হতো : দেশবাসীর সমীপে আমার কিছু কথা তাহলে আমার মতে ভালো হতো। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাফাই জবানবন্দী দিয়ে জনাব এরশাদ এটা নিশ্চিত করলেন, প্রধানমন্ত্রী এবং তিনি একই মুষ্টির ভেতরে আবদ্ধ। জনাব এরশাদ তার কলামে তথা জবানবন্দীতে অকপটে স্বীকার করেছেন, (উদ্ধৃতি শুরু) ‘এটাই ব্যতিক্রম যে, কোনো একটি গুলির শব্দ ছাড়াই ১৯৮২-এর পটপরিবর্তন ঘটেছে। সেই পরিবর্তনে আওয়ামী লীগের নীরব সমর্থন ছিল। অন্তত আওয়ামী লীগের তৎকালীন মুখপত্র দৈনিক বাংলার বাণীর সম্পাদকীয়তে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।’ (উদ্বৃতি শেষ)। সমর্থন যে ছিল তার আরো প্রমাণ হচ্ছে ১৯৮৬ সালে, বৃহত্তর রাজনৈতিক অঙ্গনের সমঝোতমূলক ওয়াদা ভঙ্গ করে, আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ১৯৮২ সালে শুরু হওয়া মাননীয় হাসিনা ও মাননীয় এরশাদ এর মধ্যকার সমঝোতামূলক কৌশলগত রাজনৈতিক বন্ধুত্ব আজ অবধি চলছে। উভয়ের বন্ধুত্বের পরবর্তী ফসল ৫ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখের নির্বাচন। তথাকথিত নির্বাচন, ভোটারবিহীন নির্বাচন, মতা কুগিত করার নির্বাচন, ব্যালট বাক্স ভর্তি করার নির্বাচন, জনগণের সম্মতিবিহীন নির্বাচন। যেই গণতন্ত্রের জন্য জনগণের পে যেই ভোটাধিকারের জন্য মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সেই ভোটাধিকার এখন উপেতি। যেই গণতন্ত্রের জন্য ১৯৮৯-৯০ সালে উত্তাল গণ-আন্দোলন হয়েছিল, শত শত ব্যক্তি প্রাণ দিয়েছিল, সেই গণতন্ত্র এখন অবহেলিত। নির্ভয়ে, নিরাপদে ভোট দেয়ার অধিকারের জন্য যেই আন্দোলন হয়েছিল ১৯৯৫-৯৬ সালে, সেই নিরপে সরকারব্যবস্থা এখন নির্বাসিত। এই উপো ও নির্বাসন নাটকের প্রধান নায়ক মাননীয় শেখ হাসিনা ও মাননীয় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। অতীতের মতো গণ-আন্দোলন ব্যতীত তাদের অপসারণ কঠিন। শাসক দলের মাননীয় সাধারণ সম্পাদক নিজ মুখেই বলেছেন অনেকটা এ রকম যে, ‘বৈধভাবে বর্তমান সরকারকে মতা থেকে সরানোর কোনো সুযোগ নেই’। ঠিক এই বক্তব্যটি প্রসঙ্গে নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত আমার কলাম ‘সৈয়দ আশরাফের কথার অগ্র-পশ্চাৎ’ শিরোনামে ১১ জুন ২০১৪ তারিখে কলাম প্রকাশিত হয়েছে। পাঠক ইন্টারনেটের মাধ্যমে নয়া দিগন্তের আর্কাইভ থেকে অথবা আমার ওয়েব সাইট থেকে পড়তে পারেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের শিকড় সংবিধানের পাতায় পাতায় বিধৃত। সেই সংবিধানকে বর্তমান শাসক রাজনৈতিক দল যথেচ্ছভাবে সংশোধন করেছেন। ২০১১ সালের মে মাসে সম্পাদিত পঞ্চদশ সংশোধনী ছিল একটি অতি সুপরিকল্পিত দূরদর্শিতামূলক সংশোধন। বন্দুকটা রাখা হয়েছিল মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন মাননীয় প্রধান বিচারপতির বন্ধুপ্রতিম ঘাড়ে। এইরূপ পরিবেশে মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয় যেই পদ্ধতিতে ও যেই বক্তব্যে রায় দিয়ে গেলেন, সেটা সর্বাবস্থাতেই প্রশ্নের অধীন থাকবে। সেই দীর্ঘমেয়াদি সুপরিকল্পনার অংশ হিসেবে বর্তমানে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ শাসন করছে। আওয়ামী লীগের কূটকৌশল ও দূরদর্শিতা, লণীয় ও গভীর। আওয়ামী লীগের এই মুহূর্তের একমাত্র না হলেও প্রধানতম ল্যবস্তু হচ্ছে, যেকোনো নিয়মে অন্তত ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের মতায় থেকে যাওয়া। মতায় থাকাকালে নিজেদের উপকার করা, পৃষ্ঠপোষকদের উপকার করা এবং বন্ধুদের উপকার করা। আওয়ামী লীগের কৌশলগত ব্যাপক প্রচারণার কারণে, তাদের দুর্বলতাগুলোকে মানুষের কাছে পৌঁছানো যায় না। প্রচারমাধ্যমের ওপর আওয়ামী লীগের যে আধিপত্য, তাও আওয়ামী লীগেরই সুপরিকল্পনার অংশের সুফল। বাংলাদেশে বর্তমানে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নেই। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতার নিরাপত্তা নেই (প্রসঙ্গ পার্বত্য চট্টগ্রাম)। গণতান্ত্রিক চর্চার নিরাপত্তা নেই। এই তিনটি ‘নেই’ এর কথা খেয়াল রেখেই বাংলাদেশের জনগণকে সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে ২০ দলীয় জোটকে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে হবে। ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ শরিক হিসেবে বিএনপিকে এর নেতৃত্ব দিতে হবে। নেতৃত্ব দিতে হলে ২০ দলীয় জোটের প্রত্যেকটি শরিক দলকে সাংগঠনিকভাবে নিজ নিজ বলয়ে শক্তিশালী হতে হবে। দেশব্যাপী সোচ্চার শুভাকাক্সক্ষীদের মূল্যায়নে সবচেয়ে বেশি সাংগঠনিক পুনর্গঠন প্রয়োজন প্রধান শরিকের রাজনৈতিক রাজধানীতে।
রমজানের পরে আন্দোলন শুরু হবে এবং এই মর্মে প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য মাননীয় দেশনেত্রী আহ্বান জানাচ্ছেন। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইফতার মাহফিলে তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে যে সংপ্তি বক্তব্য রাখছেন, তার সারমর্ম হলো আন্দোলন এবং আন্দোলনের মাধ্যমেই দেশ ও মানুষকে বাঁচানোর জন্য বর্তমান সরকারকে হটাতে হবে। আন্দোলন হচ্ছে রাজনীতির মাঠে কম্পন। আন্দোলন হচ্ছে শরীরের মধ্যে রক্ত চলাচল। আন্দোলন হচ্ছে শান্ত সমুদ্রে হঠাৎ তুফান আসার কারণে সৃষ্ট ঢেউ। অতএব, শিকড়ের শক্তি না থাকলে, কাণ্ড শক্তিশালী হবে না। কাণ্ড শক্তিশালী না হলে ডালপালা শক্তিশালী হবে না। ডালপালা শক্তিশালী না হলে বাতাস আসলে পাতা নড়বে না অথবা ডালের ওপর কোনো ভর দিলে ডাল ভেঙে যাবে। প্রতীকী অর্থে রাজনৈতিক দল হলো মানুষের শরীর অথবা বৃরে কাণ্ড। এর শিকড়কে শক্তিশালী করতে হবে এবং ডালপালা শক্তিশালী করতে হবে। ডালপালা হলো সাংগঠনিক প্রস্তুতি ও অংগ সংগঠনগুলো।
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com
সুত্র: নয়াদিগন্ত