ইলিশ শুধু সুস্বাদু ও জনপ্রিয় একটি মাছই নয়, এটি দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের অন্যতম প্রাকৃতিক উৎস। আবহমান কাল থেকে দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং খাদ্যাভ্যাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে রুপালি ইলিশ।
ইলিশের উৎপাদন, চাহিদা ও জনপ্রিয়তা সবকিছুই বেশি বাংলাদেশে। তবু এদেশের অনেক মানুষ মাছটির স্বাদ নেওয়া থেকে বঞ্চিত হন। বছরে একবার ইলিশের স্বাদ নিতে পারেন না এমন মানুষের সংখ্যাও এখন নেহায়েত কম নয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ অবস্থার জন্য প্রধানত দায়ী ইলিশের উচ্চমূল্য। নদী বা সাগর থেকে আহরণের পর সাধারণ ক্রেতার হাতে পৌঁছানোর আগে কয়েক হাত ঘুরে ইলিশের দাম অনেক বেড়ে যায়। জেলে, মহাজন, আড়তদার, পাইকার- এসব সিন্ডিকেট ঘুরে সবশেষ যখন পাড়া-মহল্লার বাজারে পৌঁছায় তখন ইলিশের দাম হয় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। মাছের আকার যত বড় হয়, পাল্লা দিয়ে দামও তত বেশি নেওয়া হয়।
দাম বেশির জন্য খুচরা বাজারের বিক্রেতারা একচেটিয়া দোষ চাপান পাইকারি বাজারের বিক্রেতাদের ওপর। পাইকারি বিক্রেতারা নিজেদের কাঁধে দোষ নিতে নারাজ। তারা বলেন ঘাটেই দাম বেশি।
রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) ভোর থেকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে কয়েকটি মাছের আড়তে ঘুরে দেখা যায়, পাইকারি বাজারে ইলিশের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। বরিশাল, ভোলা, চাঁদপুর, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পিক-আপ ও ট্রাকে করে আনা হয়েছে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ। ব্যবসায়ীরা জানান, সপ্তাহ জুড়েই বাজারে প্রচুর ইলিশ এসেছে। তবে সে অনুযায়ী দাম কমেনি।
বেশি সরবরাহ থাকার পরও কেন বাড়তি দাম দিয়ে ইলিশ কিনতে হচ্ছে? এ প্রশ্নের সদুত্তর কেউ দিতে পারেননি। এ বিষয়ে কথা বলতেও অনাগ্রহ প্রকাশ করেন অধিকাংশ পাইকার।
পাইকারিতে কত, খুচরা বাজারে কত?
বাজারে আসা ইলিশ ৪টি ভাগে বিভক্ত। প্রথম ক্যাটাগরিতে রয়েছে সবচেয়ে বড় সাইজের মাছ। এসব মাছের ওজন ১ কেজি কিংবা এর কিছুটা বেশি। যার পাইকারি দাম ধরা হচ্ছে কেজি ১৫০০-১৬০০ টাকা। এসব মাছই একই বাজারে খুচরা ১৭০০-১৮০০ টাকা কেজি দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
এরপর রয়েছে মাঝারি আকৃতির ইলিশ। যার ওজন ৭০০-৮০০ গ্রাম। এসব মাছের পাইকারি দাম ধরা হচ্ছে ৯০০-১১০০ টাকা। যা পরবর্তীতে খুচরা বাজারে ১৩০০-১৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
তৃতীয় ক্যাটাগরিতে আছে ৫০০-৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ। এগুলো পাইকারিতে ৬০০-৭০০ এবং খুচরায় ৯০০-১০০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
৪র্থ ক্যাটাগরিতে আছে জাটকা বা ছোট সাইজের (দেখতে কিছুটা পুরাতন) ইলিশ। এগুলো পাইকারিতে ৫০০ টাকা কেজি এবং খুচরায় ৬০০-৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে।
ইলিশের রং, আকার-আকৃতি, তাজাভাব বিবেচনায় দামের ক্ষেত্রে আরও কিছুটা তারতম্য দেখা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, ইলিশ মাছের বাড়তি দামের অন্যতম কারণ অতিরিক্ত ‘রপ্তানি’ ও ‘সিন্ডিকেট’।
রফিকুল ইসলাম (ছদ্মনাম) নামে ইলিশের এক পাইকার বলেন, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ইলিশ ভারতে রপ্তানি করা হয়। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বাজারে ইলিশের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এই রপ্তানির ফলে দেশের বাজারে ইলিশের ঘাটতি দেখা যায়। যার ফলে দেশে ইলিশের দাম বেড়ে যায়।
তিনি বলেন, ইলিশ মাছের দাম সবসময়ই বেশ চড়া থাকে। বিশেষ করে বড় ইলিশের ক্ষেত্রে। কারণ, যখন বেশি পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়ে তখন বাজারে ছাড়া হয় না। সেগুলো কোল্ড স্টোরেজে রাখা হয়। পরবর্তীতে যখন সংকট তৈরি হয় তখন সেগুলো বাজারে ছাড়া হয়। ভরা মৌসুমে কিংবা রপ্তানি কম হলে ইলিশ বেশি থাকে। কিন্তু তারপরও সেগুলো বাজারজাত করা হয় না।
এদিকে নদীর পানি দূষণ, নাব্যতার সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আসছে বলে জানান কয়েকজন ব্যবসায়ী। তারা বলেন, এখন আর আগের মতো ইলিশ পাওয়া যায় না। ইলিশের উৎপাদন কম হচ্ছে। এ কারণে বাজারে ইলিশের প্রাপ্যতাও কমে যাচ্ছে। এতে করে পাইকারি বাজারেই দাম চড়া থাকছে।
সামনের দিনে ইলিশ মাছের দাম আরও বাড়বে বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, দেশে ইলিশ মাছের উচ্চ চাহিদা থাকা সত্ত্বেও উচ্চমূল্য, রপ্তানি এবং প্রাপ্যতার সংকটের কারণে দাম বাড়তি থাকে। ইলিশের রপ্তানি বন্ধ থাকায় দাম কমার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল সেটিও মিইয়ে গেছে ফের ইলিশ রপ্তানির ঘোষণায়।
মোসলেম উদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ইলিশের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বিশেষত দুর্গাপূজার সময়ে বাংলাদেশ থেকে ইলিশ রপ্তানির হার বেড়ে যায়। কিন্তু রপ্তানি বন্ধ থাকলে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো যায় এবং একইসঙ্গে ইলিশ মাছের প্রজনন প্রক্রিয়াও সুরক্ষিত থাকে। তাই দাম কমানোর জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে ইলিশের প্রাপ্যতা সুরক্ষিত রাখতে রপ্তানিতে সীমাবদ্ধতা রাখা উচিত।
ইলিশ সংরক্ষণ ও প্রজননক্ষেত্রের উন্নয়নে উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে পরবর্তী সময়ে দাম আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন তিনি।
১৩ অক্টোবর থেকে ২২ দিন ইলিশ ধরা-বিক্রি নিষিদ্ধ
মা ইলিশ রক্ষায় বিজ্ঞানভিত্তিক প্রজনন সময় বিবেচনায় নিয়ে আশ্বিন মাসের পূর্ণিমাকে ভিত্তি ধরে আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশ আহরণ, পরিবহন, বিপণন ও মজুত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, বাংলাদেশে ইলিশ মাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈজ্ঞানিকভাবে এ মাছ সংরক্ষণের দিন নির্ধারণ করা হয়। ইলিশ মাছ সুরক্ষায় বিজ্ঞানীরা পূর্ণিমা ও আমবস্যার সঙ্গে মিল রেখে তারিখ ঠিক করে থাকেন। আজকের বৈঠকে যে তারিখটা নির্ধারণে সবাই একমত হয়েছি, সেটা হলো ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর। এই ২২ দিন ইলিশ ধরা ও বিক্রি করা যাবে না।