‘মুই বিচার চাই না, সরকার যেন খালি মোর পোলার লাশের খোঁজডা দেয়’

Slider সারাদেশ

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগে আনন্দ মিছিলে গিয়ে ঢাকার যাত্রাবাড়িতে গুলিবিদ্ধ হন ভোলার মো. হাসান (১৮) নামের এক যুবক। তবে তার গুলিবিদ্ধ দেহ আজও খুঁজে পায়নি তার পরিবার। ছেলেকে খুঁজে পেতে একাই ভোলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কের মোড়ে ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় বাবাকে

শুক্রবার (১৬ আগস্ট) ছেলে হাসানের গুলিবিদ্ধ হওয়া ছবি সম্বলিত ব্যানার হাতে নিয়ে জেলা শহরে নতুন বাজার মোড়ে একাই দাঁড়িয়ে ছিলেন নিখোঁজ হাসানের বাবা মো. মনির। এ সময় তার পাশে কাউকেই দাঁড়াতে দেখা যায়নি।

বিজয় মিছিলে গুলিবিদ্ধ যুবক হাসান ভোলা সদর উপজেলাধীন কাচিয়া ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের কাচিয়া গ্রামের জাহাঙ্গীর বেপারী বাড়ির ভাড়াটিয়া দিনমজুর মো. মনির ও গৃহিনী গোলেনূর দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান।

হাসানের বাবা জানান, আমি মাইনষের কৃষি জমিতে খাঁটুনি খাইট্টা ও ভোলার খালপাড়ে কুলির কাম কইররা টেহা (টাকা) কামাইয়া ওই টেহায় পোলারে বড় করছি। মোর নিখোঁজ বড় পোলা হাসানরে অনেক কষ্টে ফাইভে বিত্তি (বৃত্তি) পর্যন্ত পড়াইছি। অভাবের কারণে পোলাডা ৬ বচ্ছর আগে ঢাকায় একটা ইলেকট্রনিক দোকানে কাম (কাজ) করে টাকা পাঠাইতো। ওর কামাইয়ের টেহা দিয়াই মোর সংসার চলতো। পোলার আশা আছিল (ছিলো) জমি কিইন্না বাপ-মারে ঘর উঠায়া দিবো। সব শ্যাষ। পোলাডারে মনে হয় আল্লাহ লইয়া (নিয়ে) গেছে।

তিনি আরও বলেন, গত ৫ আগস্ট ঢাকার যাত্রাবাড়িতে মোর পোলা হাসানকে কারা জানি গুল্লি কইরা মারছে। পোলাডা মইরা যাওয়ার পরে এহন (এখন) পর্যন্ত মোর পোলার লাশটা মুই খুইজ্জা পাই নাই।

‘ফেসবুকে মাইনষের মোবাইলে একটা ভিডিওতে দেখছি মোর পোলার শরীরে অনেক রক্ত, কয়েকজন মাইনষে মোর পোলার লাশ একটা ভ্যান গাড়িতে কইররা কই জানি লইয়া যাইতে আছে। পরে তারা মোর পোলারে কই নিছে হেইডা (সেটা) আল্লাহয় ছাড়া আর কেউ জানে না। অনেক খোঁজ নিছি।’

তিনি আরও জানান, ‘উত্তাল মেঘনা নদী কয়েকবার ভাইঙ্গা নিছে মোর ভিটেমাটি, গুল্লি নিছে মোর পোলারে। মোর পোলারে হত্যার বিচার চামু কার ধারে? মুই বিচার চাই না। মুই চাই সরকার যেন মোর পোলার লাশের খোঁজডা মোরে দেয়। মুই মোর পোলার লাশটা নিজের হাতে কবর দিমু।’

গুলিবিদ্ধ নিখোঁজ হাসানের মা গোলেনূরকে তার ছেলে হাসানের কথা জিজ্ঞেস করলেই বিলাপ করে বলেন, ‘মোর পোলা কই? মোর বুকটা কারা খালি করল? আপনি (সাংবাদিক) মোর পোলাডারে খুইজ্জা আইন্না মোর বুকে ফিরায়ে দেন। তিনি এখনো আশাবাদী,তার ছেলে বেঁচে আছে।

হাসানের গ্রামের বাড়ি ভোলার কাচিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বেড়িবাঁধ থেকে কিছুটা দূরে অন্যের ভিটা ভাড়া নিয়ে সেখানে দোঁচালা একটি টিনের ঘরে বসবাস করেন নিখোঁজ হাসানের পরিবার।

দিনমজুর মো. মনির ও গৃহিনী গোলেনূর দম্পতির দুই ছেলে দুই মেয়ে। সন্তানদের মধ্যে হাসান দ্বিতীয় ও বড় ছেলে। বিগত কয়েকবছর হাসানের উপার্জনেই সংসার চলতো। কিন্তু ঢাকার যাত্রাবাড়ি সংঘর্ষে উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে এখন দিশেহারা এই পরিবার।

গত ৫ আগস্ট ঢাকার যাত্রাবাড়ি চৌরাস্তায় ছাত্র-জনতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যকার সংঘর্ষের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নিখোঁজ হাসানের বড় বোনের জামাই মো. ইসমাইল মোবাইল ফোনে বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হলে যাত্রাবাড়িতে একটি বিজয় মিছিল বের হয়। তখন ওই মিছিলে আমি ও আমার শ্যালক হাসান যোগ দেই। মিছিলটি যাত্রাবাড়ি চৌরাস্তা এলাকায় এলে মিছিলকারীদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়ে পুলিশ। একপর্যায়ে আমরা যে যার মতো ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। ওই যে আমরা দুইজন আলাদা হয়েছি, তারপর থেকে অনেক খোঁজাখুজির পরও হাসানকে পাইনি।

তিনি আরও বলেন, গত ৬ আগস্ট ফেসবুক একটা ভিডিওতে দেখেছি কয়েকজন লোক একটা ভ্যানগাড়িতে উঠিয়ে হাসানের গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত মরদেহ কোথায় যেন নিচ্ছে। ভিডিওটা দেখার পরে আমি ঢাকা মেডিকেলসহ অনেকগুলো হাসপাতাল ও হাসপাতালের মর্গে গিয়ে খুঁজেও হাসানকে পাইনি।

তিনি বলেন, হাসানের খোঁজে ঢাকার অনেক থানায় গিয়েছি, তখন থানার কার্যক্রম বন্ধ ছিল। সর্বশেষ থানার কার্যক্রম পুনরায় চালু হওয়ার পর যাত্রাবাড়ি থানাতে গিয়েও হাসানের কোনো খোঁজ পাইনি।

স্থানীয় বাসিন্দা মো. ফারুক মাঝি, মাকসুদ, শফিউল বলেন, নিখোঁজ হাসান দিনমজুর মনিরের বড় ছেলে। আমাদের চোখের সামনেই ছেলেটা বড় হইছে,আমরা ওকে চিনি। ওরা নদী ভাঙনের শিকার। ভাড়া ভিটায় থাকে। আমরা এলাকাবাসী চাই হাসান যেন সুস্থ শরীরে ফিরে আসে। আর যদি গুলিতে মারাও যায়, তাহলে সরকার যেন ছেলেটার লাশটা অন্তত তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

কাচিয়া ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য (মেম্বার) মো. মানিক বলেন, ঢাকায় সংঘর্ষে নিখোঁজ হাসান আমার ওয়ার্ডের। আমি ওকে চিনি। আমি জানি ছেলেটা নিখোঁজ রয়েছে। পরিবারের দাবি তারা ভিডিওতে ছেলের মরদেহ দেখেছে। শুক্রবার বাদ জুম্মা স্থানীয় মসজিদে হাসানের জন্য দোয়া করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, দেশের চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার পতনকে কেন্দ্র করে ঢাকায় সহিংসতায় ১৯ জনের বাড়ি ভোলার বিভিন্ন উপজেলায় এবং ভোলায় নিজ জেলাতে সংঘর্ষ চলাকালীন চকবাজারে গত ৪ আগস্ট দুপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ছাতা মেরামতকারী মো. জসিম উদ্দিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *