আ’লীগের ঘরে-বাইরে কোন্দল

Slider রাজনীতি


টানা চার মেয়াদের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ঘরে-বাইরের নানা কোন্দল ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় এলেও এর প্রায় আট মাসের মাথায় চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে দলটি। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের এসব কোন্দল প্রকাশ হচ্ছে। যে কারণে অনেকেই ধারণা করছেন কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দলটির অনেকেই মাঠে নামছেন না। এতে দলের ভেতরে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে, ক্ষুব্ধ হাইকমান্ডও।
এ ছাড়া চলমান বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের ভেতরে-বাইরে সব পর্যায়ে সাংগঠনিক দুর্বলতাও ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে বিভিন্ন সময় দলের হাইকমান্ড ছাত্রলীগকে নানাভাবে গুরুত্ব দিয়ে এলেও এবার তাদের (ছাত্রলীগ) শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতাই সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে মার খেয়েছেন। নাকে খত দিয়ে, কান ধরে ওঠবস করে বিভিন্ন ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

দলীয় সূত্র জানায়, গত চার মেয়াদে তৃণমূল পর্যায়ের ওয়ার্ড, থানা ও জেলা পর্যায়ে সম্মেলনের পরও কোনো কমিটি গঠন করতে পারেননি দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। আর যেসব আংশিক কিংবা পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়েছে, তাতে ত্যাগীরা পদ না পাওয়ায় ক্ষোভ-অভিমানে অনেকেই নিষ্ক্রীয় হয়ে পড়েছেন। এ জন্যই দলের কোনো নির্দেশনা কাজে আসছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দলীয় সূত্র জানায়, চার মেয়াদে সরকারি কেনাকাটায় কমিশন আদায় এবং হাট-ঘাট, পরিবহন খাতেও বিপুল চাঁদাবাজি করে অর্থ বানানোয় অনেকে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ফলে যেকোনো মূল্যে আধিপত্য ধরে রাখতে মরিয়া আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এ জন্যই সঙ্ঘাত ও প্রাণহানি এবং সরকারবিরোধীদের নানামুখী ষড়যন্ত্র ঠেকানো যাচ্ছে না।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় আসার প্রায় সাড়ে সাত মাসের মাথায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে চরম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মাঠে থাকার নির্দেশনা দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কিন্তু সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করে অনেক মন্ত্রী-এমপি এবং দলীয় নেতা দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান। এতে দলের বর্তমান সাংগঠনিক দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। সর্বশেষ গত বুধবার ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ দলীয় প্রধান কার্যালয়ে ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের সাথে মতবিনিময় সভা করেন। সেই সভায় তার প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান উপস্থিত তরুণ ও সাবেক নেতারা। বৈঠকে ওবায়দুল কাদেরকে উদ্দেশ্য করে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে, যা পরিস্থিতিকে জটিল করেছে।

তরুণ নেতারা মনে করছেন, দল ও সরকার বর্তমানে যে মহাসঙ্কটে পড়েছে তাতে সাধারণ সম্পাদকের দায়ই বেশি। প্রধানমন্ত্রী দলের সভাপতি, তিনিই শেষ অবলম্বন। কিন্তু সব বিষয়ে তাকে নজর দিতে হলে সাধারণ সম্পাদকের কাজটা কী? এ ছাড়া তার অতিকথন পরিস্থিতিকে জটিল করেছে বলেও অভিযোগ তাদের। মাঠের এমন পরিস্থিতি হাইকমান্ডকে চিন্তায় ফেললেও কেউই এর দায় নিতে রাজি নন।
শুধু আওয়ামী লীগেই নয়, সহযোগী সংগঠনগুলোতেও দলের বিপদে পাশে থাকা না থাকা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সব সংগঠনের সমন্বয়হীনতা দূর করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অন্য দিকে সুবিধাবাদী-ফাঁকিবাজ ও দলের বিপদে দেশ ছেড়ে যাওয়া নেতাদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গুঞ্জন আছে, গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে নেতৃত্বের পরিবর্তনও হতে পারে। ব্যর্থতার দায়ে এরই মধ্যে ঢাকা উত্তরের ২৭ ইউনিটের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে।

যদিও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, দীর্ঘদিন কমিটি না হওয়া, যোগ্যদের মূল্যায়ন না করে টাকার বিনিময়ে পদ-পদবি দেয়ায় দলের বিপদে কাউকে পাশে পাওয়া যাচ্ছে না। মূল্যায়ন না পাওয়া নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষোভ ঝাড়ছেন অনেকে। এরই ধারাবাহিকতায় সাবেক ছাত্রনেতাদের তোপের মুখে পড়তে হয়েছে খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে। শুধু তা-ই নয়, দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী ১৪ দলের নেতারাও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কড়া সমালোচনা করছেন। বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে তাদের সক্ষমতা নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীর সামনে তারা প্রশ্ন তুলেছেন।

কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রথমে শান্তিপূর্ণভাবে চললেও হঠাৎ করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে জড়ানোর মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। বিশেষ করে ছাত্রদের আন্দোলন ঘিরে গত ১৮ ও ১৯ জুলাই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ১৮ জুলাই ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়েও হামলার চেষ্টা হয়। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে কারফিউ দেয়া হয়। এ পরিস্থিতির দায় নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরে-বাইরে আলোচনা চলছে। অনেকেই বলেছেন, এমন পরিস্থিতি তৈরির আগেই দলের পক্ষ থেকে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত এলে তা হয়তো এড়ানো যেত। এজন্য অনেকেই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলছেন।

গত ২৯ জুলাই রাতে গণভবনে অনুষ্ঠিত ১৪ দলের বৈঠকে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, দলের (আওয়ামী লীগ) ব্যর্থতা, প্রশাসনিক ভুলত্রুটির কারণে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠেছে। এগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করতে হবে। ওবায়দুল কাদেরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সাবেক এই তথ্যমন্ত্রী বলেন, তার বক্তব্য-বিবৃতি পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করে তোলে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, কোটা আন্দোলন ঘিরে উত্তপ্ত পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হওয়ার পর গত ২৩ জুলাই বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢাকা মহানগরী, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের শীর্ষ নেতা, ঢাকার দলীয় এমপিদের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন ওবায়দুল কাদের। যেখানে নেতাকর্মীদের মাঠে না থাকার বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতির ক্ষুব্ধ মনোভাবের কথা জানানো হয়। পাশাপাশি ভেদাভেদ ভুলে নিজেদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা কাটানোর নির্দেশনা দেয়া হয়। একই সাথে গাঢাকা দেয়া নেতাদের তালিকা তৈরি করতে দলীয় প্রধানের নির্দেশনার কথাও জানিয়ে দেন ওবায়দুল কাদের। ওই বৈঠকে কোটা আন্দোলনের সময় সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি হওয়া এলাকার কাউন্সিলরদের ব্যর্থতার বিষয়ও তুলে ধরা হয় বলে জানা গেছে।

গত ২৬ জুলাই দল গোছাতে সমন্বয় সভা ডাকা হলে সেখানেও মাঠে থাকা না থাকার ইস্যু নিয়ে শীর্ষ নেতাদের সামনে ঢাকার নেতারা বাদানুবাদে জড়ান। একজন মাঠে ছিলেন দাবি করে বক্তব্য দিলে অন্যজন তা খণ্ডন করে প্রতিবাদ জানান। একপর্যায়ে যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকা-১৪ আসনের সংসদ সদস্য মাইনুল হোসেন খান নিখিল মাঠে কোনো নেতাকে পাশে পাননি বলে জানালে বিষয়টির প্রতিবাদ জানান ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক মান্নান কচি। এরপর বাদানুবাদে জড়ান এই দুই নেতা। পরে পরিস্থিতি কেন্দ্রীয় নেতারা সামাল দেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৩০ জুলাই রাতের এক বৈঠকে কারা মাঠে ছিলেন, আর কারা ছিলেন না তা নিয়ে নিজেরাই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন ছাত্রলীগের সাবেক নারী নেত্রীরাও। সেই বৈঠকে একজন যুব মহিলা লীগ মাঠে ছিল না এমন বক্তব্য দিলে অন্যরা প্রতিবাদ করেন। সবশেষ ৩১ জুলাই দলের অভ্যন্তরের সমস্যা সামনে আসে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *