‘তখন তো আন্দোলন হচ্ছিল না, তাহলে আমারে গুলি করল ক্যান?’

Slider বাধ ভাঙ্গা মত


১০ বছর বয়সী শিশু কাউছার। পিতা-মাতাহীন শিশুটি তার ফুফুর সঙ্গে বসবাস করে উত্তরা আবদুল্লাহপুর এলাকার একটি ভাড়া বাড়িতে। গত ১৯ জুলাই (শুক্রবার) কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে পুলিশের ছোড়া গুলিতে গুরুতরভাবে আহত হয় সে। বুলেট তার শরীর এফোঁড়ওফোঁড় করে বেরিয়ে যায়। বর্তমানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কাউছার।

মঙ্গলবার ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় তার। শরীরের যন্ত্রণায় মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। তারপরও বারবার একটি প্রশ্নই করে যাচ্ছিল কাউছার-‘তখন তো আন্দোলন হচ্ছিল না, তাহলে আমাকে গুলি করল ক্যান?’

কোটা সংস্কার ঘিরে গত ১৮ জুলাই থেকে পুলিশের গুলিতে নিহত এবং আহত হন অসংখ্য মানুষ। এর মধ্যে বাদ যায়নি শিশুরাও। সরাসরি গুলিতে মারা গেছে অন্তত ৮ শিশু। এছাড়া গুরুতর আহত হয়েছে অনেকে।

কাউছার বলে, ‘ওইদিনের আন্দোলন শেষ হলে আমি আর কয়েকজন বন্ধু মিলে রাস্তায় বের হয়েছিলাম। তখন কোনো আন্দোলন হচ্ছিল না, তাই আমরা বাসার গলিতে খেলছিলাম। হঠাৎ পুলিশ এসে গুলি করে। তারপর আর কিছু মনে নাই।’

স্বজনরা জানান, তারপরই তাকে নিয়ে আসা হয় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। সার্জারি শেষে আপাতত ডাক্তারের পর্যবেক্ষণে আছে কাউছার।

কাউছারের ফুফু বলেন, কাউছার আমাদের সঙ্গে থাকে। সেদিন গণ্ডগোলের পর কয়েকজন বন্ধুসহ ও বাসার বাইরে যায়। আমরা তো ভাবিনি যে গলিতে এসে পুলিশ গুলি করবে। বাচ্চাগুলার ওপর পুলিশ কী ভেবে গুলি করল, এর কোনো জবাব নেই।

কাউছারের পাশের বেডেই শুয়ে ছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে আহত শিক্ষার্থী রাজিব (ছদ্মনাম)। মিরপুর বাংলা স্কুলের এ শিক্ষার্থীর দুই পায়ে গুলি লেগেছে। আঘাত এতটাই গুরুতর যে পা সেরে উঠতে অন্তত ১ বছর সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।

রাজীবের খালাতো ভাই সেন্ট জোসেফের শিক্ষার্থী বলেন, পুলিশ এমনভাবে গুলি করেছে যে তার পায়ের রানের একটা অংশের কিছুেই নেই। সামনে তার এসএসসি পরীক্ষা ছিল। তার বর্তমান যে অবস্থা, সেখান থেকে সুস্থ হতে অন্তত এক বছর সময় লাগবে।

‘ধারদেনা করে ওষুধ খাচ্ছি’

রাজধানীর ধানমন্ডিতে বসবাসকারী আকাশ কোটা আন্দোলনের অংশ ছিলেন না। মোহাম্মদপুর টাউনহলের কাঠপট্টিতে একটি দোকানে কাজ করতেন তিনি। ১৮ জুলাই মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে একটি কাজ সেরে দোকানে ফেরার পথে পুলিশের ছররা গুলিতে তার শরীরের পেছনের অংশ ঝাঝরা হয়ে যায়। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে আসার পর সার্জারি করে ১৩ পিস বুলেট বের করা হয়। এখনো বেশ কিছু বুলেট শরীরে রয়ে গেছে, যা ধীরেধীরে বের করা হবে।

আকাশ বলেন, আমি সেদিন একটা বিল নিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় গন্ডগোল শুরু হয়ে যায়। চেষ্টা করছিলাম কোনোরকমে বেঁচে দোকানে ফেরার জন্য, কিন্তু তখনই গায়ে গুলি লাগে।

তিনি বলেন, এখানে বিনামূল্যে সার্জারি করাতে পারলেও ওষুধপত্র সব বাইরে থেকে কিনে আনতে হচ্ছে। যেখানে চাকরি করি সেখান থেকে কিছু টাকা দিয়েছিল, যা শেষ হয়ে গেছে। এখন ধারদেনা করে ওষুধ খাচ্ছি। আমি তো কোনো আন্দোলনকারী ছিলাম না, তাহলে আমাকে কেন গুলি করা হলো?’

‘কোটা আন্দোলনে আহতদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে’

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতার জেরে আহত ৫১৮ জন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এখন পর্যন্ত ৬৫ জন ভর্তি রয়েছেন, যাদের মধ্যে ১৮ জনের মেজর সার্জারি ও ৩০ জনের মাইনর সার্জারি করতে হয়েছে। এছাড়া মরদেহ আসে ১৩টি।

হাসপাতালটির পরিচালক ডা. শফিউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আহত যারা চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন তাদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কম ছিল। পথচারী বা সাধারণ মানুষের সংখ্যাই ছিল বেশি। আমরা প্রত্যেক্যেই গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা দিয়েছি।

তিনি জানান, যারা আহত অবস্থায় এসেছিলেন তারা অধিকাংশই চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে গেছেন। গুরুতর রোগীদের দিকে আমরা খেয়াল রাখছি। এছাড়া যেকয়েকটি ডেডবডি এসেছিল, সেগুলোও তাদের স্বজনরা চিহ্নিত করে নিয়ে গেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *