কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ— প্রবাদের এই বাক্যের বাস্তব চিত্র যেন ফুটে উঠেছে রাজধানীতে চলমান কোটা আন্দোলনের কারণে।
শিক্ষার্থীদের অবরোধের মুখে প্রায় সব সড়কে আটকে আছে বিপুলসংখ্যক রিকশা-সিএনজিসহ ব্যক্তিগত ও গণপরিবহন। এসব পরিবহনের চালকরা আজ বঞ্চিত হচ্ছেন কাঙিক্ষত আয় থেকে। অনেক রিকশা ও সিএনজিচালক মালিকের ‘জমা’ দেওয়া নিয়েও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
আবার এর উল্টো চিত্রও দেখা গেল। রাস্তায় অনেক রিকশা আটকে থাকায় সংখ্যায় কম থাকা অলিগলির রিকশাচালকরা লুপে নিচ্ছেন বাড়তি আয়ের সুযোগ। ৮০-১০০ টাকার ভাড়া তারা নিচ্ছেন ১৮০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত।
সোমবার (৮ জুলাই) বিকেল তিনটা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকায় কোটা আন্দোলনকারীদের অবরোধ চলাকালে আশপাশের অলি-গলিতে এই চিত্র দেখা গেছে। বিশেষ করে বিকেল ৫টার পর অফিস-ফেরত মানুষেরা পড়েছেন ভোগান্তিতে। তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছেন রিকশাচালকরা।
আন্দোলনে আটকা আলমগীরের ভাগ্য
নিউমার্কেট এলাকা থেকে মিরপুরগামী এক যাত্রীকে নিয়ে রিকশার প্যাডেল মারা শুরু করেছিলেন মো. আলমগীর হোসেন। সাইন্সল্যাব মোড়ে আসতেই রিকশার প্যাডেল থামিয়ে দেন কোটা আন্দোলনের দাবিতে সড়ক অবরোধ করা শিক্ষার্থীরা। কোনোভাবে বুঝিয়ে-শুনিয়ে পার হতে চাইলেও শিক্ষার্থীদের অনড় অবস্থানে আটকে যান তিনি। এতক্ষণে পেছনের দিকেও বাস-সিএনজিসহ আরও গাড়ি এসে পড়ে। ফলে কয়েক ঘণ্টার জন্য আটকা পড়েন তিনি।
অবরোধে বন্ধ যানচলাচল, হেঁটেই গন্তব্যে যাচ্ছে মানুষ
দুর্ভোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুপুরের পর বের হয়ে প্রথম ভাড়াতেই আন্দোলনের চিপায় পড়ে গেছি। যাত্রী আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে, কিছুক্ষণ বসে থেকে ভাড়া না দিয়ে চলে গেছে। তিন ঘণ্টা হয়ে গেছে, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। না সামনে যেতে পারছি, না পেছনে। সারাদিন আমার এখানেই শেষ, বাসায় কিছু নিয়ে ফিরতে পারব কি না জানি না।
আলমগীর হোসেন বলেন, আমরা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। রিকশার প্যাডেল ঘুরলে কয়টা টাকা পকেটে ঢুকে, অন্যথায় মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে হয়। অনেক অনুরোধ করেছি ছেড়ে দেওয়ার জন্য, দিল না। এখন কতক্ষণ বসে থাকতে হয় কে জানে।
আন্দোলনের কারণে তিন ঘণ্টা এক জায়গায় বসে থেকে অবশেষে ভ্যানেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সাইদুল ইসলাম। এ সময় তার ছবি তুলতে গেলে পাশে দাঁড়ানো আরেক রিকশাচালক তাকে ডেকে তুলে দেন।
সাইদুল ঢাকা পোস্টকে বলেন, পান্থপথ থেকে ফার্নিচারের ভাড়া নিয়ে এদিকে এসেছিলাম। যাওয়ার পথে আটকে গেলাম। এক জায়গায় কতক্ষণ বসে থাকা যায়, তাই একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছিলাম।
তিনি আরও বলেন, কপাল ভালো যে আটকে যাওয়ার আগে একটা ভাড়া মারতে পেরেছি। এখান থেকে বের হয়ে আর কোনো ভাড়া নেওয়া সম্ভব না। তাই যা উপার্জন হয়েছে তাতেই আজকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
শুধু সাইদুল ইসলাম আর আলমগীর হোসেনই নন, কোটা আন্দোলনকারীদের অবরোধে কপাল পুড়েছে এমন অসংখ্য রিকশা, ভ্যান, সিএনজি ও বাস চালকদের।
গণপরিবহন বন্ধ, কিছু রিকশাচালকের পৌষ মাস
সড়ক অবরোধে একদিকে যেমন কিছু চালকের বিষাদময় অবস্থা, অন্যদিকে আবার কিছু চালকের রমরমা অবস্থা।
কাছে কিংবা দূরে যেখানেই যাবেন, ৫০ টাকার নিচে কোথাও যাচ্ছেন না রিকশাচালকরা। প্রায় সব গন্তব্যের জন্য দ্বিগুণ বা তিনগুণ পর্যন্ত ভাড়া নিচ্ছেন তারা।
সায়েন্সল্যাবের বিপরীতে সড়কে প্রায় শতাধিক রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। মনমতো ভাড়া না পাওয়া পর্যন্ত কোনোভাবেই রিকশার হাতল ধরছেন না তারা। যাত্রীদের অভিযোগ, ১০০ টাকার ভাড়া সুযোগ বুঝে ২০০ টাকা পর্যন্ত চাচ্ছে তারা।
নিউমার্কেট এলাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন রবিন মিয়া। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে নিউমার্কেট থেকে সায়েন্সল্যাব পর্যন্ত হেঁটে এসে রিকশায় করে মোহাম্মদপুর যাবেন তিনি।
ভাড়া প্রসঙ্গে রবিন মিয়া বলেন, প্রতিদিন বাসে করেই বাসায় যাই, কিন্তু ঠেকায় পড়ে আজ রিকশায় যেতে হচ্ছে। কিন্তু যেখানে ভাড়া থাকে ৯০ থেকে ১০০ টাকা, সেখানে আজ ভাড়া হাঁকাচ্ছে ২০০ টাকা। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছি, কেউই এর কমে যাবে না। এটা রিকশা চালকদের বাড়াবাড়ি।
অতিরিক্ত ভাড়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কামাল উদ্দিন নামে এক রিকশাচালক বলেন, আমরা বেশি ভাড়া নিচ্ছি না বরং যাত্রীরাই খুশি হয়ে ১০ থেকে ২০ টাকা বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবে কয়েকজন বেশি নিতে পারে। কিন্তু সবাই তো এক না।দুই ঘণ্টার কোটা আন্দোলনে স্থবির ঢাকা
রিকশাচালক জামাল মিয়া বলেন, আমরা তো প্রতিদিন বেশি ভাড়া নিই না। শুধু আজকের দিনে একটু বেশি নিচ্ছি। কিছু তো করার নেই, রিকশার তুলনায় যাত্রী অনেক বেশি। একজন এসে ১০০ টাকা ভাড়া বললে অন্য যাত্রী ২০ টাকা বাড়িয়ে সেই রিকশা নিয়ে যেতে চান।
তিনি বলেন, ২০ টাকার ভাড়া আমি সর্বোচ্চ ৩০ টাকা নিচ্ছি। কেউ কেউ হয়ত ৫০-৬০ টাকা নিচ্ছে। আমি অন্যদের মতো বেশি নিচ্ছি না। যাত্রীদের চাহিদা অনুযায়ী অল্পের মধ্যেই চলে যাচ্ছি।
আন্দোলন প্রসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা কলেজের সমন্বয়ক মো. রাকিব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বার্থকে সামনে রেখে আন্দোলনে নেমেছি। আমাদের এই সড়ক অবরোধ করার কথা নয়, আমরা আমাদের পড়ার টেবিলে ফিরে যেতে চাই। আমাদের দাবি যদি মনে নেওয়া হয়, আজকেই আমরা ঘরে ফিরে যাব।
দুর্ভোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেকোনো আন্দোলন সংগ্রামেই সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ হয়। আমরাও দুপুর থেকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আন্দোলন করছি, আমাদেরও কষ্ট হচ্ছে। বৃহৎ স্বার্থে আশা করি সাধারণ মানুষ আমাদের সঙ্গে থাকবেন। অনেকেই এসে আমাদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে যাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় নির্দেশনা এলে আজকের মতো আমরা সড়ক ছেড়ে দেব।