সাভার (ঢাকা): সাভারের মরহুম সাবেক সংসদ সদস্য ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি সামসুদ্দোহা খান মজলিশের স্ত্রী সেলিমা খান মজলিশ মেহের হত্যা মামলার রহস্য ১৩ বছর বছর পর উদঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
সাভার পৌর এলাকার দক্ষিণ পাড়ার নিজ বাসভবণে তাকে রান্না ঘরে তার গলায় চাকু চালিয়েছে ইলেকট্রিশিয়ান সুবল কুমার রায় (৫০)। এরপর দেয়া হয়েছে বৈদ্যূতিক শক। তারপর তাকে বেডরুমে এনে পত্রিকা বিছিয়ে তার উপর শুইয়ে রাখা হয়। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত তিনজনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি।
গ্রেফতাররা হলেন মূল হত্যাকারী সাবেক এমপির বাসার বৈদ্যূতিক মিস্ত্রি সুবল কুমার রায়, সাবেক এমপির বড় মেয়ে শামীমা খান মজলিস ওরফে পপি এবং গৃহপরিচারিকা আরতি সরকার (৬০)।
পিবিআই সুনির্দিষ্ট করে বলছে, অনৈতিক সম্পর্কের প্রতিবাদ করায় ভিকটিমকে হত্যা করা হতে পারে। তদন্ত এখনো চলছে। পুরো তদন্ত শেষ হলে সবকিছু জানা যাবে।
পিবিআইয়ের দাবি, ভিকটিমের বড় মেয়ে শামীমা খান মজলিস ওরফে পপির (৫৫) সাথে পরকীয়ার সম্পর্ক ছিল তাদের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত করা বৈদ্যূতিক মিস্ত্রি সুবলের। বিষয়টি তার মা জানার পর ২০০৫ সালে বাসায় যেতে নিষেধ করেন সুবলকে। ২০০৮ সালে সুবল তার গ্রাম নেত্রকোনায় বিয়ে করেন। ২০১১ সাল থেকে সুবল ফের ওই বাসায় গোপনে যাতায়াত শুরু করেন। ২০১১ সালে ১৪ জুন ভোরে সুবল ওই বাসায় ঢুকলে সেলিমা খান মজলিশ বাসার ছাদ থেকে তা দেখে ফেলেন। তিনি চিৎকার করে সুবলকে গালমন্দ করেন। এরপর সুবল ও শামীমা খান ওরফে পপি বাসার দোতলায় গেলে এ নিয়ে সেলিমা খান মজলিশের সাথে তাদের বাকবিতন্ডা হয়। একপর্যায়ে রান্না ঘরে মেয়ের সহায়তায় তার মায়ের গলায় ফল কাটার চাকু দিয়ে পোচ মারে সুবল।
মঙ্গলবার ঢাকার ধানমন্ডিতে পিবিআই প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার। থানা পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাত ঘুরে মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। সিআইডি মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল আদালতে। এর ফলে মামলার ডকেট পাওয়া ছিল দুস্কর।
বনজ কুমার মজুমদার জানান, হত্যাকাণ্ডের রহস্য দীর্ঘ দিন উদঘাটন না হলে একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায় মামলার তদন্ত কাজ। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মামলা পুনরায় পুনরুজ্জীবিত করতে নির্দেশনা আসে। আমরা ঘটনার তদন্ত শুরু করি। তদন্ত শুরু হলে আমরা ভিকটিমের বড় মেয়ে আসামি শামীমা খান মজলিস ওরফে পপির পাশাপাশি বাকি দুই মেয়েকেও সন্দেহের মধ্যে রাখি। আমরা খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি যে ওই বাসায় কারা কারা আসতো। জানতে পারি একজন ইলেকট্রিশিয়ান মাঝে মাঝে ওই বাসায় আসতো। কিন্তু তার বহুদিন ওই বাসায় আসা-যাওয়া নেই। জানতে পারি সে বিগত ৩০ বছর ধরে সাভার মডেল থানায় ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে কাজ করছে এবং সিভিল কাজ করাদের নিয়ন্ত্রক ছিলেন। সেই সঙ্গে পাশেই তার একটি মুদির দোকানও আছে। আমরা তদন্তকালে যেসব কথা জানতে পারি তার মধ্যে সুইচ বোর্ডটি ভাঙ্গা এবং দুইটা তার বের করে রাখার একটা বিষয় উঠে আসছিল। এরপর আমরা আসামি ইলেকট্রিশিয়ান সুবল কুমার রায়কে গ্রেফতার করে নিয়ে আসি।
সাবেক সংসদ সদস্য খান মজলিস তাকে পছন্দ করতেন। তাই আসামি সুবল কুমার রায় মাঝেমধ্যে সেখানে যাতায়াত করতেন এবং বাড়ির ইলেকট্রিকের কাজ করে দিতেন। ১৯৯৮ সাল থেকে সুবল কুমার রায় সাবেক সংসদ সদস্যের বাড়িতে যাতায়াত করতেন।
পিবিআই জানায়, আসামি সুবল কুমার রায়কে গ্রেফতারের পর আদালতের জবানবন্দিমূলক স্বীকারোক্তিতে জানান, ভিকটিম সেলিমা খান মজলিশের বড় মেয়ে তার স্বামীকে নিয়ে নিচতলায় বসবাস করতেন। সেখানে সে নিয়মিত যাতায়াতের এক পর্যায়ে আসামি শামীমা খান মজলিস ওরফে পপির স্বামীর সঙ্গে বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে ২০০১ সালে আসামি সুবল কুমার রায় এবং পপি পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। এই বিষয়টি ২০০৫ সালে জানাজানি হলে তাকে মারধর এবং অপমান করা হলে তিনি বাসা থেকে চলে যান। তাকে আর ওই বাসায় আসতে নিষেধ করা হয়। ২০০৮ সালে সুবল কুমার রায় বিয়ে করেন। ২০১১ সাল থেকে তিনি আবার সেই বাসায় যাতায়াত শুরু করেন।
তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, যেদিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটেছে, সেদিন ভোরবেলা ফজরের নামাজের পর ভিকটিম সেলিমা খান মজলিশ ছাদে উঠেছিলেন এবং সেখান থেকে দেখতে পান সুবল চুপিচুপি তার বাড়ির দিকে আসছেন। এরপর সে এটা দেখে চিৎকার করতে করতে নিচে নামছিলেন। তখন আসামি সুবল এবং শামীমা তাহের পপি তার মায়ের চিৎকার থামাতে ওপরে যান। মাকে থামানোর জন্য মেয়ে পপি তাকে জাপটে ধরেন এবং পাশে থাকা একটি ফল কাটার চাকু দিয়ে গলার দুই পাশে তিনটি পোঁচ দেন সুবল। এরপর যখন তারা দেখেন তার মা মারা যায়নি জীবিত আছে তখন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি সুবল ইলেকট্রিক বোর্ড ভেঙে সেখান থেকে দুটি তার বের করে ভিকটিমের মাথায় ইলেকট্রিক শক দেন গুরুতর আহত হয় এবং তাকে প্রথমে সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে ভর্তি করালে একদিন পর সিএমএইচে ভর্তি করা হলে আইসিইউতে ৪ দিন থাকার পর তিনি মারা যান। ঘটনাটি ঘটে রান্না ঘরে।
বনজ কুমার বলেন, জবানবন্দি থেকে জানা গেছে, ২০০১ সালের ১৪ জুন সকাল অনুমান সাড়ে ছয়টা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে যেকোনো সময় এই ঘটনা ঘটে। বাসার ডাইনিং রুমে ভিকটিমের গলার দুই পাশে ফল কাটার ছুরি দিয়ে পোঁচ মারার পর রক্তাক্ত অবস্থায় প্রতিবন্ধী ছেলে কাদের খান মজলিশ সেতুর কক্ষে নেয়া হয়। সেখানে খাটের চাদরের ওপরে একটি পুরাতন পত্রিকা বিছিয়ে ভিকটিমের মাথার কাছে দুটি বালিশ দিয়ে চাপা দেওয়া হয়। ঘাড়ের নিচে তোষক দিয়ে শুইয়ে রেখে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন সুবল- কুমার রায়। গৃহপরিচারিকা আরতি সব পর্যবেক্ষণ করেন।