জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস বিভাগের সাবেক সহকারী কমিশনার মোখলেছুল রহমান ও তার পরিবারের চার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। শুধু খোঁজ পাওয়া নয়, তথ্য-প্রমাণ মেলায় তা গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, মোখলেছুল রহমান ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে স্ত্রী ও ছেলের নামে সম্পদ গড়ে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন। এমনকি দুদকের কাজে বাধা তৈরি করতে বিভিন্ন সময়ে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। যদিও আইনগত জটিলতা কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত মোখলেছুর রহমানের পরিবারের তিন সদস্য এখন চার্জশিটভুক্ত আসামি।
কমিশনের পক্ষ থেকে চার্জশিট বা অভিযোগপত্র অনুমোদন পাওয়ার পর এখন চলছে আদালতে দাখিল করার প্রক্রিয়া। শিগগিরই তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে চার্জশিট দাখিল করবেন বলে জানা গেছে।
মোখলেছুল রহমান ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে স্ত্রী ও ছেলের নামে সম্পদ গড়ে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন। এমনকি দুদকের কাজে বাধা তৈরি করতে বিভিন্ন সময়ে উচ্চ আদালতের সহায়তা নিয়েছেন। যদিও আইনগত জটিলতা কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত মোখলেছুর রহমানের পরিবারের তিন সদস্য এখন চার্জশিটভুক্ত আসামি
এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা আলমগীর হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি দুদকের জনসংযোগ দপ্তরে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।
জনসংযোগ কর্মকর্তা (উপ-পরিচালক) আকতারুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ২৫ জুন কমিশনের পক্ষ থেকে কাস্টমস কর্মকর্তা মোখলেছুর রহমানসহ তিন জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিলের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালের ২ নভেম্বর দুদকের ময়মনসিংহ জেলা কার্যালয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে এনবিআরের কাস্টমস বিভাগের সদস্য আলোচিত মতিউর রহমান ও কর বিভাগের প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, মো. মোখলেছুর রহমান খান (সাহান) ১৯৮০ সালের ১ অক্টোবর কাস্টমস ও এক্সসাইজ অফিস বিভাগে পরিদর্শক পদে যোগদান করেন। তিনি গত ২০১২ সালে সহকারী কমিশনার পদে পদোন্নতি পান। ২০১৬ সালের ৫ আগস্ট সহকারী কমিশনার হিসেবে ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস এক্সসাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট থেকে অবসর গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় আসামি তার দ্বিতীয় স্ত্রী কান্তি রহমান। তার প্রথম স্ত্রী ১৯৮৮ সালে মারা যাওয়ার পর ১৯৯৩ সালে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তার দুই ছেলের মধ্যে একজন ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী এবং অন্যজন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।
মোখলেছুর রহমান কর অঞ্চল-৪ এবং তার স্ত্রী কান্তি রহমান কর অঞ্চল-১০ এর করদাতা। চাকরিকালে তিনি নিজ নামে ৫৪ লাখ ৯৮ হাজার ৪০৬ টাকার স্থাবর এবং দুই কোটি ৭৭ লাখ ৮৮ হাজার ৬৭৫ টাকার অস্থাবর সম্পদের মালিকানা অর্জন করেছেন। তার মোট স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ তিন কোটি ৩২ লাখ ৮৭ হাজার ৮১ টাকা। তার পারিবারিক ব্যয় এক কোটি ৬৩ লাখ ৪২ হাজার ২৪৬ টাকাসহ মোট অর্জিত সম্পদের পরিমাণ চার কোটি ৯৬ লাখ ২৯ হাজার ৩৩৩ টাকা।
যার বিপরীতে মোট আয় পাওয়া যায় চার কোটি ৩০ লাখ ৮২ হাজার ২২০ টাকা। অর্থাৎ ৬৫ লাখ ৪৭ হাজার ১১৩ টাকা অবৈধ হিসাব হিসেবে প্রমাণ পাওয়া গেছে। যা দুদক আইন ২০০৪ এর ২৭(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, আসামি কান্তি রহমানের নামে তিন কোটি ৪১ লাখ ৭০ হাজার ২০৫ টাকার স্থাবর এবং ৬ লাখ ৭৯ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদসহ মোট তিন কোটি ৪৮ লাখ ৪৯ হাজার ২০৫ টাকার সম্পদের বিবরণ পেয়েছে দুদক। যার পারিবারিক ব্যয়সহ মোট চার কোটি ২৯ লাখ ৩৬ হাজার ৩৭১ টাকা হয়। আর ওই সম্পদের বিপরীতে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় এক কোটি ১৮ লাখ ৯ হাজার ৭১৮ টাকা। অর্থাৎ তিন কোটি ১১ লাখ ২৬ হাজার ৬৫৩ টাকা অবৈধ হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে দুদকের তদন্তে। ওই সব সম্পদ তার স্বামী মো. মোকলেছুর রহমান খানের ঘুষ ও দুর্নীতির টাকা।
একজন সরকারি কর্মচারী তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় স্ত্রী কান্তি রহমান অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। যা ভোগদখলে রেখে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ২৭(১) ধারা ও দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
এদিকে তৃতীয় আসামি ও মো. মোখলেছুর রহমান খানের বড় পুত্র মো. ফয়জুর রহমান খান বর্তমানে বিদেশে থাকলেও তার বিরুদ্ধে আইনগত অপরাধ মিলেছে দুদকের তদন্তে। নিজেক ব্যবসায়ী হিসেবে ২০০৬-০৭ সালে তিনি প্রথম আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন। আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবসা প্রদর্শন করলেও বাস্তবে তার কোনো ব্যবসা পাওয়া যায়নি। তবে গ্রামীণফোনে ৪০ হাজার টাকা বেতনের একটি চাকরি করতেন। যদিও ২০১৭ সাল থেকে ইংল্যান্ডের নাগরিকত্ব পেয়ে সেখানেই বসবাস করছেন বলে জানা গেছে।
কোম্পানিতে চাকরিরত অবস্থায় ফয়জুর রহমান ২০০৯ সালের ২৫ নভেম্বর গুলশান মডেল টাউন আবাসিক এলাকার সিডব্লিউএন (বি) ব্লকের ৩৬ নং রোডে জেনেটিক রিচমন্ড নামের একটি ভবনে কার পার্কিং স্পেসসহ ২১ লাখ ৩৮ হাজার ৮১৯ টাকায় ১৯৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ক্রয় করেন। দালিলিক মূল্য ওই টাকা হলেও বাস্তবে ফ্ল্যাটের মূল্য ছিল দুই থেকে তিন কোটি।
এ ছাড়া, তার নামে কিশোরগঞ্জে ৫০ শতক জমি ও ৫ লাখ ৭৯ হাজার ৮০০ টাকা ব্যাংক ব্যালেন্সসহ অস্থাবর সম্পদ মিলিয়ে মোট ২৭ লাখ ৮৩ হাজার ৬১৯ টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। যার বিপরীতে প্রমাণযোগ মোট আয় পাওয়া যায় ৪০ হাজার টাকা। এখানে ২৭ লাখ ৪৩ হাজার ৬১৯ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনে তার পিতা মো. মোখলেছুর রহমান খান তাকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন এবং তিনি তার পিতার অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদকে বৈধ করার অপচেষ্টা করেছেন। কৌশল হিসেবে নিজের নামে রেখে তার পিতাকে আমমোক্তার নিয়োগ করেছেন। সেই কারণে মো. ফাইজুর রহমান খানকে সহযোগী আসামি করা হয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে মোখলেছুর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।