লন্ডন প্রতিনিধি: বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া লন্ডনে পৌছেছেন। বুধবার বাংলাদেশ সময় সোয়া ১১টার দিকে তিনি লন্ডন পৌঁছান। চিকিৎসা ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গত রাত সাড়ে ৯টায় এমিরেটস এয়ারলাইন্সের (ফ্লাইট নম্বর-৫৮৫) একটি বিমানে লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন তিনি।
লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেককে , সাধারণ সম্পাদক কয়সর এম আহমেদ, সহ-সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, জিয়া পরিষদের সহ আর্ন্তজাতিক বিষয়ক সম্পাদক, সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের যুক্তরাজ্য শাখার যুগ্ম আহবায়ক,বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম যুক্তরাজ্য শাখার সাবেক সহ সভাপতি, শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক রিসার্চ ইনস্টিটিউটর প্রতিষ্ঠাতা এবং চার্টাড ইনস্টিটিউট অব লিগ্যাল এক্সিকিউটিভের মেম্বার ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম, প্রচার সম্পাদক মোতাহার হোসেন লিটন, শামিম আহমেদ বিএনপির সিনিয়র নেতাসহ বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মী বেগম খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানান।
এ বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের প্রেস সেক্রেটারি মারুফ কামাল খান বলেন, মধ্য রাতে অ্যামিরাটস এয়ারলাইন্সের বিমানটির দুবাইতে দুই ঘন্টার যাত্রা বিরতি রয়েছে। কাল বুধবার সকালে ম্যাডামের লন্ডন পৌঁছানোর কথা রয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া দু’সপ্তাহের সফরে যুক্তরাজ্য যাচ্ছেন। এটা তাঁর ব্যক্তিগত সফর। এ সফরের উদ্দেশ্য হচ্ছে চোখ ও পায়ের চিকিৎসা করানো। সেখানে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাবেন তিনি।
তিনি বলেন, তাঁর বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে চিকিৎসাধীন। তিনি সেখানে সপরিবারে বাস করেন। প্রয়াত পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শারমিলা রহমান সিঁথি ও কন্যারাও এ উপলক্ষে লন্ডন গেছেন। ঈদুল আযহাও একসংগে উদ্যাপনের কথা রয়েছে।
তিনি আরও জানান, লন্ডনে ইতোমধ্যেই বেগম খালেদা জিয়ার জন্য চিকিৎসকদের সঙ্গে এপয়েন্টমেন্ট করা হয়েছে। বড় ছেলে তারেক রহমানের স্ত্রী জুবাইদা রহমান নিজেই একজন চিকিৎসক এবং তিনিই তার শাশুড়ির চিকিৎসার বিষয়ে সমন্বয় ও দেখভাল করবেন।
জনাব মারুফ কামাল খান সোহেল আরও জানান, চিকিৎসা ও পারিবারিক ব্যস্ততার ফাঁকে দলের প্রবাসী নেতা-কর্মীদের সংগেও সফরকালে বেগম খালেদা জিয়া কর্মসূচি হতে পারে। তিনি সফর শেষে আগামী পয়লা অক্টোবর দেশে ফিরবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।
সন্ধ্যা থেকে হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের প্রবেশমুখে পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনী জোরদার করা হয়। এতে বিমানবন্দর টার্মিনালে যেতে দলের নেতা-কর্মীরা বাঁধা মুখে পড়ে। রাত ৮টা ২০ মিনিটে বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িবহর বিমান বন্দরের টার্মিনালে প্রবেশ করলে সড়কে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা নেতা-কর্মী-সমর্থকরা করতালি দিয়ে নেত্রীকে বিদায় জানায়।
এ সময়ে দলের জ্যেষ্ঠ নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, মোহাম্মদ শাহজাহান, গোলাম আকবর খন্দকার, আসাদুজ্জামান রিপন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবিব উন নবী খান সোহেল, হাবিবুর রহমান হাবিব, আবদুস সালাম আজাদ, সৈয়দ সালেহ এমরাহ প্রিন্স, শামীমুর রহমান শামীম, নুরে আরা সাফা, শিরিন সুলতানা, হেলেন জেরিন খান, শাম্মী আখতার, অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন, মমিনুল হক প্রমূখ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর নিয়ে সেখানে বেশ তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। বিশেষ করে দীর্ঘ দিন লন্ডনে অবস্থানকারী বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে খালেদা জিয়া বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠান নিয়ে সেখানে নেতারা কয়েক দিন ধরে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বলে জানা গেছে। জানা গেছে, তিনি চিকিৎসা ছাড়াও বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার কথা রয়েছে। বিশেষ করে খালেদা জিয়া যেকোন সময় মামলায় গ্রেপ্তার হতে পারেন। এ কারণে তখন দলের নেতাদের মধ্যে কারা কি দায়িত্ব পালন করবেন বা করলে ভালো হবে তা বেগম জিয়া তারেক রহমানকে ধারণা দেবেন। তখন তিনি সে মতে দলকে পরিচালনা করবেন। এাছাড়া বেগম জিয়া লন্ডনে অবস্থানকালে
সেখানে বৃটিশ সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করার পাশাপাশি লন্ডনে বিএনপি নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকেও বিএনপির কয়েকজন নেতা লন্ডনে আসার কথা রয়েছে। এছাড়া তারেক রহমানের আইন বিষয়ক পরামর্শদাতা টবি ক্যাডমানের সঙ্গেও খালেদা জিয়ার আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে।
খালেদা জিয়ার একজন উপদেষ্টা বলেন, ম্যাডামের লন্ডন সফরের মূল উদ্দেশ্য তিনি সেখানে চোখের চিকিৎসা করাবেন। সেই সঙ্গে পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন বৈঠক করবেন। এছাড়াও দলের বেশ কয়েকটি বিষয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবেন।
সূত্র জানায়, গত মাসে তার লন্ডন সফরের কথা ছিল। কিন্ত পরে তা পিছিয়ে দেওয়া হয়। পরিকল্পনা ছিল কাজের অগ্রগতি হলেই তিনি লন্ডনের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়বেন। তারেক রহমান লন্ডনে বেশ কয়েকজন বৃটিশ মন্ত্রী ও এমপির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এখন তাদের সঙ্গে খালেদার বৈঠক করানোর চেষ্টা করছেন। এনিয়ে সেখানকার নেতারাও কাজ করেন। বৃটিশ প্রধনমন্ত্রীর সঙ্গেও যাতে তার সাক্ষাৎ হয় সেটাও পরিকল্পনায় রয়েছে।
লন্ডন থেকে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, বেগম খালেদা জিয়া প্রথমে হোটেলে উঠবেন। সেখানে কয়েকটি বৈঠক করার পর যাবেন তারেক রহমানের বাসায়। বড় ছেলের বাসায় নাতিদের সাথে কয়েকদিন সময় কাটাবেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
তারেক রহমানের বাসায় গিয়েছেন এমন একজন বিএনপি নেতা বলেন, আমাদের দলের ভাইস চেয়ারম্যান যে বাড়িতে থাকেন সেটা বেশি বড় নয়। ম্যাডাম ছোট বাসায় থাকতে পারেন না। এই কারণে তার যাতে থাকতে অসুবিধা না হয় এবং কাজ করতে এবং চিকিৎসা করা সহজ হয় সেজন্য তিনি হোটেলে উঠবেন। পরে ছেলের বাসায় যাবেন। খালেদা জিয়াকে বিমানবন্দরে অর্ভথনা জানাতে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির নেতারা উপস্থিত থাকবেন ।
বিএনপির একাধিক সূত্রের দাবি, তিনি চোখের চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যাচ্ছেন। সেখানে চোখের চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরবেন। তারা এটাও বলার চেষ্টা করছেন লন্ডনের একটি হাসপাতালে তার একটি এপয়েন্টমেন্টও নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র বলছে, এটা একটি উপলক্ষ্য। পারিবারিক ও রাজনৈতিক বেশ কয়েকটি বিষয়ে খালেদা জিয়া তার ছেলের সঙ্গে আলোচনা করবেন। একটি আগাম নির্বাচনের পরিকল্পনা ও এ নিয়ে আন্দোলন শুরু করা ও তা সফল করার পরিকল্পনাও চূড়ান্ত করা হবে তার এ সফরে।
কোকো মারা যাওয়ার পর তারেক রহমানের দেশে আসার কথা ছিল। কিন্ত বেগম খালেদা জিয়া তাকে না আসার পরামর্শ দেন। তিনি চাইছেন তারেক রহমান সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েই দেশে ফিরে আসুক।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়া যাতে যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য কিংবা অষ্ট্রেলিয়া সফর করেন গত দুই বছর ধরেই বিভিন্ন দিক থেকে অনুরোধ করা হচ্ছিল। ওই সব দেশ সফরের জন্য কোন কোন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি অর্থ সহায়তাও দিতে চেয়েছিল। এনিয়ে তার পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টার সঙ্গেও একাধিক প্রতিষ্ঠান যোগাযোগ করে। তিনি সেই যোগাযোগ করার পর খালেদার সফরের জন্য অর্থ সহায়তা দিতে চান।
সূত্র জানায়, খালেদা জিয়া আপাতত ছেলের সঙ্গে দেখা করা ও চোখের চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাচ্ছেন মনে হলেও তিনি সুদূরপ্রসারী চিন্তা থেকেই সেখানে যাচ্ছেন। তিনি সেখানে গিয়ে বেশ কয়েকটি কাজ করবেন। সেই সঙ্গে আগামী দিনে তারেক রহমানের যাতে কাজ করতে সুবিধা না হয় সেই ব্যবস্থাও করবেন। তিনি তারেক রহমানকে আরো দায়িত্ব দিতে চান যাতে করে তিনি বাইরে থেকেও দলের জন্য কাজ করতে পারেন।
খালেদা জিয়ার আশঙ্কা সরকার তার মামলার দ্রুত নিস্পত্তি করে তাকে শাস্তি দিবে। সেটা করা সম্ভব হলে কারাগারে যেতে হতে পারে খালেদা জিয়াকে। তিনি কারাগারে গেলে তার ছেলের সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ করতে পারবেন না। আর সেটা করতে না পারলে এর প্রভাব দলের উপর পড়বে। তিনি এসব বিবেচনা করে এটাই করতে চাইছেন যে তিনি কারাগারে থাকলেও যাতে তারেক রহমান লন্ডনে বসে কাজ করতে পারেন। সেটা করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষমতাও তারেক রহমানকে দিবেন। খালেদা জিয়া কারাবন্দি হলে দলের নেতা কর্মীদের মনোবল যাতে না হারায় সেটাও ধরে রাখার জন্য তিনি পরামর্শ দিবেন। তার অবর্তমানে কিভাবে কি করতে হবে সেই বিষয়েও নির্দেশনা দিবেন। সূত্র জানায়, কেবল দলীয় বিষয় নয় পারিবারিক বেশ কিছু বিষয় রয়েছে তিনি কারাগারে থাকলে সেই সব বিষয়ে কি হবে সেটাও তিনি নির্দেশনা দিবেন।
খালেদা জিয়া ডিসেম্বরে দলের কাউন্সিল করতে চাইছেন। ওই কাউন্সিল করার জন্য দলের অনেক কাজ বাকি আছে সেই সব কাজগুলো সম্পন্ন করবেন। দলের যে সব নেতাকে আগামী দিনে দায়িত্ব দিবেন ওই সব নেতার বিষয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনা করবেন। আলোচনা করে দুইজন একমত হয়েই দলের বিভিন্ন স্তরে নেতৃত্ব দিতে চাইছেন। এর আগে ২০১৩ সালে একবার তারা এই ব্যাপারে কাজও করেছিলেন। এখনকার অবস্থা বিবেচনা করে ওই সব নেতাদের মধ্যে কিছু নাম বাদ দিবেন। আর নতুন করে কিছু নাম সম্পৃক্ত করবেন। কাউন্সিল করার জন্য তারেক রহমান সারাদেশের নেতাদের তালিকা করেছেন, কাকে কোন দায়িত্ব দেওয়া যাবে সেটাও ঠিক করেছেন। ওই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন।
এদিকে বিএনপির যেসব নেতা খালেদা ও তারেকের প্রতি আস্থাশীল নন, নানাভাবে তাদের সমালোচনা করছেন ওই সব নেতাদের ব্যাপারেও করণীয় নিয়ে আলোচনা করবেন। এরমধ্যে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, আমানউল্লাহ আমান, এম কে আনোয়ার, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, আব্দুল মঈন খান. শমসের মোবিন চৌধুরীসহ আরো বেশ কয়েকজন নেতার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করে তাদের ব্যাপারে কি করা যাবে সেটা নিয়ে আলোচনা করবেন।
সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক মহলের বিভিন্ন প্রভাবশালীর সঙ্গে কথা বলে তিনি একাদশ নির্বাচন যাতে দ্রুত করানো সম্ভব হয়, সরকারের উপর চাপ তৈরি করা সম্ভব হয় সেই ব্যাপারে চেষ্টা করবেন। খালেদা জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ না করে এই সরকারের কর্মকা-ের সমলোচনা করে বক্তব্য তুলে ধরতে পারেন। সেই সঙ্গে তিনি দেশের জনগণের বিষয়টি তুলে ধরে সকলের সহযোগিতা চাইবেন। বিএনপির নেতাদের নামে মামলা হামলা ও তাদের উপর নির্যাতনের বিষয়েও আলোচনা করবেন। তাদেরকে সহায়তার ব্যাপারেও আরো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে চাইছেন।
এদিকে একটি সূত্র জানায়, সরকারের আশঙ্কা তিনি কেবল চিকিৎসা নয় বিশেষ কারণেই লন্ডনে যাচ্ছেন। সেখানে তিনি আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে সমঝোতা করতেই যাবেন। খালেদা জিয়া লন্ডনে গেলে সেখানে তিনি একাধিক মিডিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিতে পারেন। এছাড়াও মিট দ্য প্রেস করতে পারেন। সেই সঙ্গে তিনি তার বক্তব্য তুলে ধরার পাশাপাশি তা যাতে আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসে সেটাও চাইছেন।