নতুন ভোক্তা শিক্ষার্থীরা, তামাক পণ্য বিক্রি বন্ধ হবে কি?

Slider শিক্ষা

রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত নওয়াব হাবিবুল্লাহ্ মডেল স্কুল এন্ড কলেজ। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চারটি শ্রেণি যথাক্রমে— সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির মোট ১০০ শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধ— এটি তারা জানে কি না। ৫৬ জনই বলে, জানে না। জানবে কীভাবে? এ বিষয়ে জোরালো কোনো কর্মসূচি কি কারও চোখে পড়েছে, কী শিক্ষার্থী, কী সাধারণ মানুষ?

জানতে চাওয়া হয় নওয়াব হাবিবুল্লাহ্ মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. শাহিনুর মিয়া, সহকারী প্রধান শিক্ষক দীপ্তি চক্রবর্তী এবং প্রাথমিক, উন্মুক্ত ও ভোকেশনালের ইনচার্জ আরিফা বিল্লাহর কাছে। তারাও এ বিষয়ে অবগত নন। সম্প্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কোনো নির্দেশনা তারা পাননি।

তবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে কেউ ধূমপান করলে সে বিষয়ে তারা বেশ সজাগ। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও নোটিশ বা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে কেউ ধূমপান করতে পারবে না। যদি কোনো শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থেকে বের হয়ে ধূমপান করে এবং শিক্ষক বা অন্য কারও চোখে পড়ে তবে সেই শিক্ষার্থীর অভিভাবককে ডেকে কাউন্সেলিং বা পরামর্শ দেওয়া হয়, যাতে শিক্ষার্থী তামাক বা ধূমপানে আসক্ত না হয়। এ বিষয়ে সদা তৎপর নওয়াব হাবিবুল্লাহ্ মডেল স্কুল এন্ড কলেজ প্রশাসন। স্পষ্ট উচ্চারণও শোনা যায় তাদের গলায়।

অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গা-ঘেঁষে দেদারছে বিক্রি হচ্ছে সিগারেটসহ তামাকজাত পণ্য। এগুলো বিক্রির পাশাপাশি দেখানো হচ্ছে বিজ্ঞাপনও। এ বিষয়ে নজরও নেই কারও!

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৯ সালের ২৮ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি, বিজ্ঞাপন প্রদর্শন ও প্রচারণা সংক্রান্ত একটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ গজের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়, বিজ্ঞাপন প্রদর্শন ও প্রচারণা নিষিদ্ধ করে গণবিজ্ঞপ্তি জারিকরণসহ এতদবিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য তার অধিক্ষেত্রাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্দেশনা প্রদানের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ জানানো হলো।’

ওই গণবিজ্ঞপ্তির পরও কেউ যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করে তার দায় কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের— প্রশ্নটা নওয়াব হাবিবুল্লাহ্ মডেল স্কুল এন্ড কলেজ কর্তৃপক্ষের যেমন, সাধারণ জনগণেরও।

২০১৬ সালে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মোট ১১০টি বিদ্যালয়ের পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় একটি গবেষণা চালায়। এতে বিদ্যালয়ের ১০০ মিটারের মধ্যে থাকা মোট ৫০৭টি মুদি দোকানের ৪৮৭টিতেই অন্য পণ্যের পাশাপাশি তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন করতে দেখা যায়।

এ সম্পর্কিত আরও তথ্য জানা যায় চট্টগ্রামে ২০১৭ সালের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস (সিটিএফকে) এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন (ইপসা) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ‘বিগ টোব্যাকো টাইনি টার্গেট: বাংলাদেশ’ শীর্ষক জরিপের তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও রাঙামাটি জেলার ৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩৬টির ১০০ মিটারের মধ্যে সিগারেটসহ বিভিন্ন তামাক পণ্য অবাধে বিক্রি হয়।

ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডাব্লিউবিবি) ট্রাস্ট জানায়, ৪৫টি জেলার ৯৪৪টি স্থানের বিক্রয়কেন্দ্র তারা চিহ্নিত করেছে। সেখানকার প্রায় সাড়ে ৩২ হাজার জায়গায় তামাকের বিজ্ঞাপন দেখা গেছে। বিজ্ঞাপন প্রদর্শন এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘনের শীর্ষে রয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি), ৯৬ শতাংশ এবং জাপান টোব্যাকো কোম্পানি (জেটিআই), ৮৭ শতাংশ

ইপসা’র সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. নাজমুল হায়দারের কাছে জানতে চাওয়া হয়, কেউ যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে সিগারেটসহ বিভিন্ন তামাক পণ্য অবাধে বিক্রি করে, এর দায় আসলে কার? তিনি বলেন, ‘এর দায় স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের। তাদের অবহেলার কারণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে সিগারেটসহ বিভিন্ন তামাক পণ্য অবাধে বিক্রি হচ্ছে। এতে সিগারেট কোম্পানিগুলোর নতুন নতুন ভোক্তা তৈরি হচ্ছে।

ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের ২০২০ সালে প্রকাশিত এক জরিপ বলছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর ৯০.৫ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে সিগারেটসহ বিভিন্ন তামাক পণ্য অবাধে বিক্রি হচ্ছে।

কেন এমন হচ্ছে— জানতে চাওয়া হলে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের স্বাস্থ্য সেক্টরের প্রকল্প সমন্বয়কারী মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘তামাক কোম্পানিগুলো আসলে অনেকভাবে ইন্টারফেয়ার (হস্তক্ষেপ) করে। এমনকি তারা স্থানীয় সরকারকে অনেকভাবে ফেসিলেটেড (সুবিধা প্রদান) করে। যার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে সিগারেটসহ বিভিন্ন তামাক পণ্য অবাধে বিক্রির বিষয়টি এখনও গাইডলাইন পর্যায়ে রয়ে গেছে।’

‘যদিও সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এটি নিয়ে একটি খসড়া তৈরি করেছে। সেই খসড়া সংসদে পাস হলে তা আইন আকারে প্রকাশ পাবে।’

এইড ফাউন্ডেশন ২০২৩ সালে দেশের পাঁচটি পৌরসভায় জরিপ পরিচালনা করে। তাদের তথ্য বলছে, ৩৩৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে সিগারেটসহ বিভিন্ন তামাক পণ্য অবাধে বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত গাইডলাইন অনুসরণ করার পরে ২০২৪ সালে তারা আরেকটি জরিপ পরিচালনা করে। সেখানে দেখা যায় সেই সংখ্যা ১৪১-এ নেমে এসেছে।

এইড ফাউন্ডেশন’র প্রকল্প পরিচালক শাগুফতা সুলতানার কাছে জানতে চাওয়া হয়, কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তামাক কোম্পানির মূল লক্ষ্য? উত্তরে তিনি বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো সবসময় তরুণদের টার্গেট করে যাতে তারা নতুন নতুন ভোক্তা তৈরি করতে পারে। এই ভোক্তা একবার তৈরি হলে তা চলতেই থাকে। এ কারণে তারা সরকারকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে সিগারেটসহ বিভিন্ন তামাক পণ্য বিক্রিতে কঠোর না হওয়ার ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করে।’

নির্দেশিকায় যা আছে

তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর নিরলস প্রচেষ্টা এবং সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা’ প্রকাশিত করে। নির্দেশিকার ৮.৫-এ ধারায় বলা হয়েছে, ‘সকল ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের আশেপাশে ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের জন্য লাইসেন্স প্রদান করা যাবে না।’

কারণ হিসেবে সেখানে বলা হয়, যদি অবাধে লাইসেন্স দেওয়া হয় তাহলে বিক্রি বাড়বে এবং তামাক নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে তামাকসেবী ভোক্তা বেড়ে যাবে। সেই ভোক্তার বয়সও নির্দিষ্ট থাকবে না। সুতরাং লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্দেশিকার বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে সিগারেটসহ বিভিন্ন তামাক পণ্য বিক্রি করলে এর দায় স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের
ইপসা’র সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. নাজমুল হায়দার

এ বিষয়ে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল (এনটিসিসি)-এর প্রাক্তন সমন্বয়কারী (অতিরিক্ত সচিব) হোসেন আলী খোন্দকার বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যাতে ধূমপানের খারাপ প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে এবং নতুন জেনারেশন যেন সিগারেটসহ তামাকজাত দ্রব্যের প্রতি আগ্রহী না হয়, সে কারণে খসড়া প্রস্তাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি নিষেধের বিষয়টি রাখা হয়েছে।’

নওয়াব হাবিবুল্লাহ্ মডেল স্কুল এন্ড কলেজের গেট থেকে কয়েক কদম দূরের একটি দোকানে তামাকজাত পণ্য বিক্রি হতে দেখা যায়। দোকানির কাছে জানতে চাওয়া হয়, তামাক বা সিগারেট বিক্রি করতে যে লাইসেন্স প্রয়োজন তা নিয়েছেন কি না? তার উত্তর, ‘লাইসেন্স নেওয়ার বিষয়ে কিছুই জানি না। লাভের আশায় অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে সিগারেটও বিক্রি করি।’

লাভ কার, ক্ষতি কার

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লাভের জন্য সিগারেটের মতো ক্ষতিকর পণ্য বিক্রি করলেও এ ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জনস্বাস্থ্য। শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে বিক্রেতা ও তামাক কোম্পানিগুলো। কোম্পানিগুলো তাদের লাভের পাল্লা ভারী করতে বিক্রেতাদের সিগারেট বিক্রিতে প্রলুব্ধ করে। এরই অংশ হিসেবে তারা বিক্রেতাদের বিভিন্ন উপহার বা লভ্যাংশ প্রদান করে। তবে দোকানদাররা বলেন, তামাকজাত পণ্য রাখলে কাস্টমার বেশি আসে। এটিই চায় তামাক খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। তারাও চায় ভোক্তা বাড়াতে, নতুন নতুন ভোক্তা তৈরি করতে।

রাজস্ব আয়ের অঙ্ক খুঁজতে গেলে দেখা যায়, তামাক খাত থেকে ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালে সরকার রাজস্ব পেয়েছে যথাক্রমে ২৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, ৩০ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা এবং ৩২ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। কিন্তু তামাকজনিত রোগের চিকিৎসায় এবং অকাল মৃত্যুর কারণে ব্যয়ের পরিমাণ উল্লিখিত রাজস্বের চেয়ে অনেক বেশি।

বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির গবেষণা বলছে, ২০১৮ সালে তামাকজনিত ব্যাধির চিকিৎসাজনিত ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। এ ব্যয় ক্রমশ বাড়ছে।

ভোক্তা কারা

টোব্যাকো অ্যাটলাস’র সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ১০-১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ছিল ৬ শতাংশ। আর ইউনিভার্সিটি অব বাথ-এর ২০২৪ সালের ৯ মে’র তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ৪৩.৭ শতাংশ মানুষ তামাকজাত পণ্যের ভোক্তা।

এই যে ভোক্তা বাড়ছে তারা কারা? নতুন নতুন তামাকসেবী। যাদের অধিকাংশই সদ্য কৈশোর পেরিয়ে উঠতি বয়সের তরুণ/তরুণী। ধীরে ধীরে যারা তামাক খাতের ভোক্তা হয়ে উঠছে। অন্যদিকে, তামাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দিন দিন লাভবান হচ্ছে।
তামাক কোম্পানিগুলো আসলে অনেকভাবে ইন্টারফেয়ার (হস্তক্ষেপ) করে। এমনকি তারা স্থানীয় সরকারকে অনেকভাবে ফেসিলেটেড (সুবিধা প্রদান) করে। যার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে সিগারেটসহ বিভিন্ন তামাক পণ্য অবাধে বিক্রির বিষয়টি এখনও গাইডলাইন পর্যায়ে রয়ে গেছে
ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের প্রকল্প সমন্বয়কারী মো. শরিফুল ইসলাম

শীর্ষে যেসব প্রতিষ্ঠান

২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই লক্ষ্যে কাজ চলছে। আগের চেয়ে সচেতনতাও বেড়েছে। বেড়েছে তামাক কোম্পানির দৌড়ঝাঁপ। একদিকে সরকার প্রতি বছর তামাকজাত পণ্যের ওপর কর বাড়াচ্ছে, অপরদিকে প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের চোখ এড়িয়ে চালাচ্ছে নিজেদের কার্যক্রম।

ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডাব্লিউবিবি) ট্রাস্ট ২০২৩ সালের ২৮ নভেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে তারা জানায়, ৪৫টি জেলার ৯৪৪টি স্থানের বিক্রয়কেন্দ্র তারা চিহ্নিত করেছে। সেখানকার প্রায় সাড়ে ৩২ হাজার জায়গায় তামাকের বিজ্ঞাপন দেখা গেছে। বিজ্ঞাপন প্রদর্শন এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘনের শীর্ষে রয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি), ৯৬ শতাংশ এবং জাপান টোব্যাকো কোম্পানি (জেটিআই), ৮৭ শতাংশ।

তামাক কোম্পানির কৌশল

করারোপের বিষয়ে তামাক কোম্পানিগুলো এক ধরনের কৌশল অবলম্বন করে। উন্নয়ন সমন্বয়’র গবেষণা পরিচালক আব্দুল্লাহ নাদভী বলেন, বর্তমানে নিম্নস্তরের সিগারেটে ৫৮ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ধার্য করা আছে। বাকি তিন স্তরের (মধ্যম, উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তর) সিগারেটের ওপর ৬৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা আছে। নিম্নস্তরের সিগারেটের ভোক্তা বেশি। কারণ, এর বিক্রয়মূল্য কম। ফলে সহজেই তা কিশোর-তরুণসহ অল্প আয়ের মানুষের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। এ কারণে তামাক কোম্পানি নিম্নস্তরের সিগারেটে অল্প কর দিতে চায়। কিন্তু আমরা নিম্নস্তরের সিগারেটেও সম্পূরক শুল্ক ৬৩ শতাংশে উন্নীত করার পাশাপাশি সব স্তরের সিগারেটের দাম ১৩ থেকে ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করেছি।

প্রতি অর্থবছরে তামাকের কর বাড়ানো হয়। ফলে তামাকের ক্রয়মূল্য বাড়ে। এরপরও খুব একটা প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না তামাকসেবীদের মধ্যে। কারণ, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। ফলে আরও সস্তা হচ্ছে তামাক দ্রব্য। পাশাপাশি নিত্যনতুন প্রচার কৌশল এবং যত্রতত্র সিগারেটসহ বিভিন্ন তামাক পণ্য অবাধে বিক্রি তরুণদের এর প্রতি বেশি বেশি আকৃষ্ট করছে। কোম্পানিগুলোর দীর্ঘমেয়াদি ভোক্তায় পরিণত হচ্ছে তারা।
তামাক কোম্পানিগুলো সবসময় তরুণদের টার্গেট করে যাতে তারা নতুন নতুন ভোক্তা তৈরি করতে পারে। এই ভোক্তা একবার তৈরি হলে তা চলতেই থাকে। এ কারণে তারা সরকারকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে সিগারেটসহ বিভিন্ন তামাক পণ্য বিক্রিতে কঠোর না হওয়ার ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করে
এইড ফাউন্ডেশন’র প্রকল্প পরিচালক শাগুফতা সুলতানা

নিয়ন্ত্রণের উপায় কী

এইড ফাউন্ডেশন’র প্রকল্প পরিচালক শাগুফতা সুলতানা জানান, যত্রতত্র সিগারেটসহ বিভিন্ন তামাক পণ্য বিক্রি নিয়ন্ত্রণে অন্যতম কার্যকর উপায় হলো বিক্রেতাদের লাইসেন্সের আওতায় নিয়ে আসা। ২০২২ সালের জুলাই মাস থেকে লাইসেন্স প্রদান কার্যক্রম শুরু হয়। গোটা দেশে ৩৩১টি পৌরসভার মধ্যে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত নয়টি পৌরসভায় এক হাজার ৯২০টি তামাক বিক্রয়কেন্দ্রের (দোকান) লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।

জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে বৈশ্বিক সংস্থা ভাইটাল স্ট্রাটেজিস’র কারিগরি পরামর্শক আমিনুল ইসলাম সুজন বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকারের যে নির্দেশনা রয়েছে তা বিদ্যমান আইন বাস্তবায়নে সহায়ক। এ নির্দেশনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে সিগারেটসহ তামাকজাত দ্রব্যের খুচরা বিক্রি নিষিদ্ধ। পাশাপাশি তামাকের বিক্রয়কেন্দ্রগুলো লাইসেন্সের আওতায় আনার মতো বিষয় রয়েছে। এগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনীতেও যুক্ত করা হয়েছে। যদি এ খসড়া আইন পাস হয় তাহলে তা তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সহায়ক হবে। খসড়া আইনটি দ্রুত পাস হওয়া প্রয়োজন।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে খসড়া আইনের ৬গ-তে বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্লিনিক, খেলাধুলার স্থান ইত্যাদি সীমানার মধ্যে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধ। ৬ঘ-তে বলা হয়েছে, লাইসেন্স গ্রহণ ব্যতীত তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধ।

খসড়া আইন বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের সাবেক কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিন বলেন, বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সঠিকভাবে প্রয়োগের পাশাপাশি আইনভঙ্গকারীদের শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে সবাই সচেতন হবে। এছাড়া খসড়া আইন সংসদে পাস হলে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে এবং তা কার্যকরে সবাই ঐক্যবদ্ধ হবে।
নির্দেশনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে সিগারেটসহ তামাকজাত দ্রব্যের খুচরা বিক্রি নিষিদ্ধ। পাশাপাশি তামাকের বিক্রয়কেন্দ্রগুলো লাইসেন্সের আওতায় আনার মতো বিষয় রয়েছে। এগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনীতেও যুক্ত করা হয়েছে। যদি এ খসড়া আইন পাস হয় তাহলে তা তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সহায়ক হবে
ভাইটাল স্ট্রাটেজিস’র পরামর্শক আমিনুল ইসলাম সুজন

ঐক্যবদ্ধ হতে হবে সবাইকে

তামাক খাতের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দৌড়ে সরকার বা প্রশাসন যে আসলে পিছিয়ে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন কৌশলে নিজেদের স্বার্থ পূরণ করে নিচ্ছে।

২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের নির্দেশনা দেন। ২০২২ সালের ১৬ জুন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এফসিটিসি-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকে এমন বেশ কয়েকটি সংশোধনীর মাধ্যমে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি সংশোধনের একটি খসড়া প্রস্তুত করে তা ওয়েবসাইটে দেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত আইনটি মন্ত্রণালয়েই আটকে আছে। জাতীয় সংসদে কবে উত্থাপিত হবে সেটিই এখন প্রশ্ন!

উন্নয়ন সমন্বয়-এর গবেষণা পরিচালক আব্দুল্লাহ নাদভী বলেন, আইন শক্তিশালী করে সংসদে পাস করার কথা বললেই তামাক কোম্পানিগুলো সরকারকে ভয় দেখায়। তারা বলে, এ খাত-সংশ্লিষ্ট বিশাল সংখ্যক শ্রমজীবী বেকার হয়ে যাবে। সরকারের রাজস্ব কমে যাবে। কিন্তু আদতে তা নয়। দেশের আনুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের মাত্র ১ শতাংশ বিড়ি-সিগারেট শিল্পে নিয়োজিত। তাহলে কোম্পানিগুলো যে ভয় সরকারকে দেখায় তা আসলে অমূলক।
নিয়মিত সিগারেটসহ তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি এবং ধূমপায়ীদের দেখলে তার (শিক্ষার্থী) মধ্যেও তামাকসেবী হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। একটু স্মার্টনেস ভাব দেখানোর জন্য সে নিয়মিত তামাকসেবীও হয়ে উঠতে পারে। এটি বেশ শঙ্কার বিষয়
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল খায়েরের কাছে জানতে চাওয়া হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করলে কী করণীয়। তার উত্তর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি না করার জন্য একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। যেহেতু এটি আইন নয়, নির্দেশনা। এটি ইমপ্লিমেন্ট (বাস্তবায়ন) করা ভেরি টাফ (খুব কঠিন)। তাই আমরা সবাইকে আহ্বান করেছি যাতে এ নির্দেশনা মেনে চলে।

আইন কার্যকর হওয়ার বিষয়ে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল (এনটিসিসি)-এর প্রাক্তন সমন্বয়কারী (অতিরিক্ত সচিব) হোসেন আলী খোন্দকার বলেন, আমরা সরকারকে গত টার্মে আইনটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব করেছিলাম। সব ধাপ সম্পন্ন করে এবারও আইনটি প্রস্তাব করা হয়েছে। এখন কেবিনেট মিটিংয়ে (মন্ত্রিসভার বৈঠক) উঠলেই আইনটি মন্ত্রণালয়ে যাবে। এ বিষয়ে আমরা আশাবাদী।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে শিক্ষার্থীরা যদি নিয়মিত সিগারেটসহ তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি এবং ধূমপায়ীদের দেখে সেক্ষেত্রে তার মনোজগতে কোনো প্রভাব পড়ে কি না— জানতে চাওয়া হয়েছিল মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামালের কাছে। তিনি বলেন, নিয়মিত সিগারেটসহ তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি এবং ধূমপায়ীদের দেখলে তার (শিক্ষার্থী) মধ্যেও তামাকসেবী হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। একটু স্মার্টনেস ভাব দেখানোর জন্য সে নিয়মিত তামাকসেবীও হয়ে উঠতে পারে। এটি বেশ শঙ্কার বিষয়।
আগামী প্রজন্মকে তামাকমুক্ত করতে গেলে সরকারের সব সংস্থাকে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি বন্ধের বিষয়টি সংশোধিত আইনে উল্লেখ থাকলে তা উঠতি বয়সী তরুণদের তামাক থেকে দূরে রাখতে দারুণ কার্যকর হবে। পাশাপাশি সার্বিক তামাক নিয়ন্ত্রণেও এর সুফল পাওয়া যাবে
জনস্বাস্থ্যবিষয়ক আইনজীবী সৈয়দ মাহবুবুল আলম

‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে সিগারেটসহ তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং এর বাস্তবায়ন জরুরি। এতে শিক্ষার্থীরা সিগারেটসহ তামাকজাত দ্রব্যের প্রতি আগ্রহ দেখাবে না। পাশাপাশি এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে হবে। তাদেরকে নিয়ে এর বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়ে জোরালো বার্তা দিতে হবে।’

জনস্বাস্থ্যবিষয়ক আইনজীবী সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন মনে করেন, আগামী প্রজন্মকে তামাকমুক্ত করতে গেলে সরকারের সব সংস্থাকে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি বন্ধের বিষয়টি সংশোধিত আইনে উল্লেখ থাকলে তা উঠতি বয়সী তরুণদের তামাক থেকে দূরে রাখতে দারুণ কার্যকর হবে। পাশাপাশি সার্বিক তামাক নিয়ন্ত্রণেও এর সুফল পাওয়া যাবে।

‘নানাবিধ সমস্যা ও শঙ্কা থাকলেও তা উপেক্ষা করে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *