৫ লাখ টাকা খরচেও মালয়েশিয়া যেতে পারেননি ৩১ হাজার শ্রমিক

Slider ফুলজান বিবির বাংলা

রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর দাবি অনুযায়ী প্রত্যেক শ্রমিক ৫-৬ লাখ টাকা খরচ করার পরও ‘স্বপ্নের দেশ’ মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমাতে পারেননি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যারা যেতে পারেননি তাদের অনেকেই বিমানবন্দরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এসব শ্রমিকের দায় এখন কে নেবে তা নিয়েও উঠছে নানা প্রশ্ন। তারা কি আদৌ দেশটিতে যেতে পারবেন? না যেতে পারলে এজেন্সিগুলোতে তাদের জমা দেয়া লাখ লাখ টাকা তারা কিভাবে ফেরত পাবেন, তা নিয়েও বিদেশ যেতে না পারা হাজার হাজার শ্রমিক ও তাদের স্বজনদের মধ্যে টেনশন বাড়ছে।
এসব কর্মীর অনেকেই জমিজমা বিক্রি অথবা সুদে ধার নিয়ে টাকা জোগাড় করে এজেন্সি মালিকদের কাছে জমা দিয়েছিলেন। ‘স্বপ্নের দেশ’ মালয়েশিয়ায় গিয়ে কামাই রোজগার করে তারা দেশে টাকা পাঠাবেন, ফেরাবেন সংসারে সচ্ছলতা। কিন্তু এখন তাদের সব আশাই শেষ হয়ে গেল। এমন আক্ষেপ সাংবাদিকদের কাছে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
এদিকে মালয়েশিয়া সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত ও ঘোষণা অনুযায়ী, গতকাল শুক্রবার রাত ১২টার পর বাংলাদেশসহ সোর্সকান্ট্রিভুক্ত ১৪ দেশ থেকে আর কোনো শ্রমিকই কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে দেশটিতে গেলে তাদের প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। এরপরও গতকাল রাত সোয়া ৮টায় মালয়েশিয়া সরকারের স্পেশাল পারমিশনে ২৭০ জন যাত্রী নিয়ে বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইট কুয়ালালামপুরের উদ্দেশে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যায়।

এর আগে গতকাল রাত ৮টায় জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিচালক (বহির্গমন) ছাদেক আহমেদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি টেলিফোন রিসিভ করেননি। তাই বাংলাদেশ থেকে মোট কত শ্রমিক বিএমইটির স্মার্টকার্ড নেয়ার পরও ফ্লাইট ধরতে পারেননি তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে বিএমইটির সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ভিসা, টিকিটসহ সবকিছু ডকুমেন্ট পাওয়ার পরও ৩১ হাজারেরও বেশি শ্রমিক মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি। এদিকে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ মালয়েশিয়াগামী শ্রমিকদের জন্য একটি বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করেন। সর্বশেষ ওই ফ্লাইটটি গতকাল শুক্রবার রাত সোয়া ৭টায় ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সেটি ২৭০ জন যাত্রী নিয়ে রাত সোয়া ৮টার পর কুয়ালালামপুরের উদ্দেশে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যায়।

গতকাল রাত সাড়ে ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জানা যায়, মালয়েশিয়া সময় রাত দেড়টা থেকে দু’টা নাগাদ ওই ফ্লাইটটি শিপাং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করার কথা। মালয়েশিয়া সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী রাত ১২টার মধ্যে শ্রমিকদের কুয়ালালামপুর ইমিগ্রেশন অতিক্রম করতে হবে। এখন তাদের বিলম্বে পৌঁছানোর পর ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ প্রবেশের অনুমতি দেবেন কি-না তা জানা সম্ভব হয়নি।

তবে এই ফ্লাইটের দু’জন যাত্রীর আত্মীয় আইটি ইঞ্জিনিয়ার জহিরুল ইসলাম গতকাল নয়া দিগন্তকে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, অনেক কষ্টে (চড়া মূল্যে লাখ টাকার ওপরে) আমার দুই ভাগিনার জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সন্ধ্যা সোয়া ৭টার ফ্লাইটের দুটি টিকিট জোগাড় করেছি। এখন তাদের ফ্লাইট যে সময় মালয়েশিয়ায় পৌঁছাবে ওই সময় (রাত ১২টার পর) ১ জুন তারিখ পড়ে যাবে। এখন তাদের পাঠাবো কি-না তা তিনি জানতে চান। এর আগে রিক্রুটিং এজেন্সি ইনসাইট গ্লোবাল ওভারসিস লিমিটেডের ম্যানেজার তাকে জানিয়েছেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের ৩০০ জন শ্রমিক এখনো মালয়েশিয়ায় যেতে পারেনি। মালয়েশিয়া থেকে তাদেরকে জানানো হয়েছে, আজ রাতে (শুক্রবার দিবাগত রাত) যত শ্রমিক মালয়েশিয়া যেতে পারবে তাদের সবাইকে মালয়েশিয়া বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ রিসিভ করবে।
ভিসা ও জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার সব ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পরও শুধুমাত্র বিমানের টিকিট না পাওয়ার কারণে সর্বমোট ৩১ হাজার ৭০১ জন শ্রমিকের যাত্রা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। না যেতে পারা এসব শ্রমিকদের এখন কী হবে, সে ব্যাপারে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কিংবা শ্রমিক প্রেরণের সাথে জড়িত এজেন্সি মালিকদের পক্ষ থেকে তাদের কোনো কিছুই জানানো হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

গতকাল শুক্রবার রাত ১২টার পর থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে সম্ভাবনাময় শ্রমবাজারটি বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে শেষ দিনে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েন ৩১ হাজার ৭০১ জন কর্মী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শেষ দিনে মালয়েশিয়ার ফ্লাইট ধরতে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হাজারো শ্রমিক ভিড় করেন। বিমানবন্দরে পৌঁছালেও ফ্লাইটের টিকিট পাচ্ছেন না অনেকে। এতে ভোগান্তিতে পড়েন অসংখ্য শ্রমিক। ভুক্তভোগী শ্রমিকরা বলছেন, গত তিন-চার দিন ধরে বিমানবন্দরে তারা অবস্থান করছেন। কেউ নিয়োগকর্তার খোঁজ পাচ্ছেন, কেউ আবার পাচ্ছেন না। মালয়েশিয়া সরকার গত মার্চে ঘোষণা দেয় ৩১ মে এর পর আর কোনো নতুন বিদেশী শ্রমিক দেশটিতে প্রবেশ করতে পারবে না।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান বলছে, গত ২১ মে পর্যন্ত পাঁচ লাখ লাখ ২৩ হাজার ৮৩৪ জন কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য অনুমোদন দেয়। ২১ মের পর আর অনুমোদন দেয়ার কথা না থাকলেও বিএমইটির তথ্য বলছে, মন্ত্রণালয় আরো এক হাজার ১১২ জন কর্মীকে দেশটিতে যাওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। অর্থাৎ, গত বৃহস্পতিবার (৩০ মে) পর্যন্ত পাঁচ লাখ ২৪ হাজার ৯৪৬ জন কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমোদন দেয়া হয়। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশটিতে চার লাখ ৯১ হাজার ৭৪৫ জন কর্মী মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গতকাল বাংলাদেশ থেকে মাত্র এক হাজার ৫০০ জন কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পারে। অর্থাৎ, ভিসা ও অনুমোদন পাওয়ার পরও ৩১ হাজার ৭০১ জন কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারছে না।
বিমানবন্দর সূত্র আরো জানিয়েছে, গতকাল সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে সাতটি ফ্লাইট মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এর মধ্যে বিমান বাংলাদেশের দু’টি, ইউএস-বাংলার দু’টি, মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি, এয়ার এশিয়ার একটি এবং বাতিক এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য সরকার নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয়ের ৯ গুণ বেশি টাকা খরচ করেও হাজার হাজার মালয়েশিয়াগামী শ্রমিক সময় মতো যেতে পারেননি। এসব শ্রমিকদের অনেকেই এখন তাদের মধ্যস্বত্বভোগীদের খুঁজছেন। কিভাবে তারা তাদের টাকা উদ্ধার করবেন এ নিয়ে বিচার সালিশ বসানোর চিন্তা করছেন। অনেকে এজেন্সির বিরুদ্ধে টাকার রিসিটসহ প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে জম্ াদেয়ার জন্য অভিযোগ তৈরি করছেন। অভিযোগে প্রত্যেকে কিভাবে মালয়েশিয়া যেতে ৫-৬ লাখ টাকা জমা দিয়েছিলেন সেগুলো তুলে ধরবেন- এমনটাই জানিয়েছেন। অপরদিকে যেসব শ্রমিক মালয়েশিয়ায় যাওয়ার টিকিট পেয়েছেন এবং নিরাপদে পৌঁছেছেন তাদের মধ্যে কতজন সেখানে গিয়ে চুক্তি অনুযায়ী চাকরি ও বেতন পাবেন সেটি নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *