গ্রাম বাংলা ডেস্ক: পারেননি লায়নেল মেসি। আর্জেন্টিনাও পারল না। ইতিহাস গড়ল জার্মানি। নতুন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পেল বিশ্ব। জয় হলো নিখুঁত ফুটবলের। বিশ্বকাপ জিতল জার্মানি। গতকাল রিওডি জেনেইরোর ঐতিহাসিক মারকানা স্টেডিয়ামে ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে তারা ১-০ গোলে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে জিতল স্বপ্নের শিরোপা।
গোলশূন্য নির্ধারিত সময় শেষে অতিরিক্ত সময়ের ২৩ মিনিটে জার্মানির বিশ্বকাপ জয়ের গোলটি করেন বদলি মিডফিল্ডার মারিও গোটজে। তার মহামূল্যবান এই গোলেই দীর্ঘ ২৪ বছর অপেক্ষা শেষে চতুর্থ বিশ্বকাপ জিতল ইউরোপীয় জায়ান্টরা এবং গড়ল বিরল ইতিহাস। প্রথম ইউরোপীয় দল হিসেবে আমেরিকা মহাদেশে জিতল ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ বিশ্বকাপ শিরোপা।
অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধেই এগিয়ে যেতে পারত মেসি অ্যান্ড কোং। কিন্তু পালাসিও গোলের চমৎকার সুযোগ নষ্ট করেন। ফলে বিশ্বকাপ জেতা হলো না মেসির।
দলে পরিবর্তন ঘটিয়েই দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নামল আর্জেন্টিনা। ল্যাভেজ্জির পরিবর্তে ম্যানচেস্টার সিটি স্ট্রাইকার সার্জিও অ্যাগুয়েরো দলভুক্ত হন। বিরতির পর শুরুটা দারুণ হয় আর্জেন্টিনার। অল্পের জন্য গোল পাননি মেসি। বাঁ-প্রান্ত দিয়ে তার নেয়া চমৎকার শট সাইডবার ঘেঁষে বাইরে চলে যায়। ম্যাচে ফিরতে বেশিক্ষণ সময় নেয়নি জার্মানি। প্রথমার্ধে ৬৩ ভাগ বল পজিশনে রাখা দলটি ফের বল পজিশনে আধিপত্য বিস্তার করল। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তাদের প্রতিটি আক্রমণ প্রতিহত হয় আর্জেন্টাইন রক্ষণভাগে। ল্যাটিন চ্যাম্পিয়নরাও দ্বিতীয়ার্ধের বাকি সময় খেলল কাউন্টার অ্যাটাকে। ফলে টানা তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের শিরোপা লড়াইয়ের ভাগ্য নির্ধারণে ম্যাচ গড়াল অতিরিক্ত সময়ে। গত আফ্রিকা বিশ্বকাপের এক্সট্রা টাইমে আন্দ্রে ইনিয়েস্তার একমাত্র গোলে স্পেন হারিয়ে দেয় নেদারল্যান্ডসকে। এর আগে ২০০৬ সালে জার্মানি বিশ্বকাপে ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ইতালি।
স্বপ্নের ফাইনাল। সেরা দলই বেছে নেবে দুই দল। তবে জার্মানি পারেনি প্রথম পছন্দের একাদশ নামাতে। ইনজুরি দুঃস্বপ্নে স্বপ্নের ফাইনাল খেলা হয়নি সামি খেদিরার। ম্যাচের সামান্য আগে তাকে স্কোয়াড থেকে সরিয়ে নেয় জার্মানি। মারিও গোটজের মতো মিডফিল্ডার দলে থাকার পরও প্রথম একাদশে রেখে সবাইকে অবাক করে দেন জার্মান কোচ জোয়াকিম লো। কোচের আস্থাতেই ক্রিমারের বিশ্বকাপ অভিষেক হয় ফাইনালে। আর্জেন্টিনা সেমিফাইনালের দলটিই অপরিবর্তিত রেখে নামল দীর্ঘ ২৪ বছর অপেক্ষার পর প্রথম শিরোপা লড়াইয়ে। ইনজুরি ফেরত ডি মারিয়াকে প্রথম একাদশে রেখে কোনো ঝুঁকি নেয়নি দুইবারের চ্যাম্পিয়নেরা।
ম্যাচের শুরুতে থেকেই বল পজিশনে মনোযোগ দেয় জার্মানি। এতে সফলও হয় তারা। তবে গোলের প্রথম সুযোগ সৃষ্টি করে আর্জেন্টিনাই। কাউন্টার অ্যাটাকে ডান প্রান্ত দিয়ে চমৎকার ড্রিবলিং করে বল মাইনেস দেন। সেকেন্ড বারে কোনো আর্জেন্টাইন না থাকায় রক্ষা পায় জার্মানি। দলটি নিশ্চিত গোল হজম থেকে বেঁচে যায় ২২ মিনিটে। টনি ক্রুসের ভুলে জার্মান ডি বক্সের সামান্য বাইরে বল পেয়ে যান হিগুয়েন। কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদের স্ট্রাইকার গোলরক্ষককে একা পেয়ে গোল করতে ব্যর্থ হন। আধঘণ্টা মার্কেই লিড পেয়ে যেতে পারত আর্জেন্টিনা। কাউন্টার গোলও করেন হিগুয়েন। কিন্তু অফসাইডের কারণে গোলটি কাউন্ট হয়নি। ততক্ষণে একটি ধাক্কাও হজম করল জার্মানি। ফাইনাল দিয়ে বিশ্বকাপ অভিষেক হওয়া ক্রেমার দুঃস্বপ্ন নিয়ে মাঠ ছাড়েন। ইনজুরির কারণে ৩০ মিনিটেই শেষ হয় ২৩ বছর বয়সী এই জার্মান তরুণের বিশ্বকাপ।
ক্রেমারের বদলি হিসেবে মাঠে নামেন চেলসির স্ট্রাইকার আন্দ্রে শরলা। মাঠে নেমেই ম্যাজিক দেখান তিনি। ৩৬ মিনিটে গোলও পেতে বসেছিলেন। তবে প্রস্তুত আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক রোমেরো। দারুণ দক্ষতা দেখিয়ে রুখে দেন ডি-বক্সের বাইরে থেকে শরলার নেয়া চমৎকার শট। প্রথমার্ধের একেবারে শেষ মুহূর্তে সাইডবার দুর্ভাগ্যে নিশ্চিত গোলবঞ্চিত হয় জার্মানি। ক্রুসের নেয়া কর্নারে দুর্দান্ত হেড করেন হোয়েডেস। তার বুলেট গতির হেড সাইডবারে লেগে প্রতিহত হয়।
পর্দা নামল বিশ্বকাপের
ফ্রিডম। সলিডারিটি। প্যাশন। এবং ডাইভারসিটি। চারটি শব্দের স্লেøাগানে বিদায় নিল ব্রাজিল বিশ্বকাপ। বুকে জমাটবাঁধা আর্তনাদ সত্ত্বেও বর্ণাঢ্য আয়োজনেই ২০১৪ সালের বিশ্বকাপকে বিদায় জানাল ব্রাজিল। কলম্বিয়ান পপ তারকা শাকিরার হৃদয়স্পর্শী সুর মূর্ছনা শিহরণ বইয়ে দিলো হাজারো ভক্তের শরীরে। ঐতিহ্যবাহী সাম্বা নৃত্য আর ফুটবলকে নিয়েই মঞ্চস্থ হলো ফুটবলের নান্দনিক সৌন্দর্য ও শক্তির উৎপত্তিস্থল ব্রাজিলে বিশ্বকাপের সমাপনী অনুষ্ঠান। ফুটবলের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও এর নজরকাড়া সৌন্দর্যের ক্যালিওগ্রাফির মধ্যে ফুটিয়ে তুললেন পারফরমারেরা।
গতকাল রিও ডি জেনিরোর হোম অব ফুটবল মারাকানা স্টেডিয়ামে জমকালো আয়োজনে ব্রাজিল সমাপ্তি টানল বিশ্বকাপ মহাযুদ্ধের। কংক্রিটের চার দেয়ালের মধ্যে বিশ্বখ্যাত সঙ্গীততারকাদের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা মুগ্ধ করল পুরো বিশ্বকে। সুরের ঝঙ্কার ও বাদ্যের তালে পারফরমারেরা ফুটিয়ে তোলেন ব্রাজিলের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, সাধারণ মানুষের হাসিকান্না ও অপরিসীম ধনভাণ্ডার। মাত্র ১৮ মিনিটের অনুষ্ঠানে সুনিপুণভাবে ব্রাজিল প্রদর্শন করল ফুটবলের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা।
মাঠের লড়াইয়ে স্বাগতিকদের ভরাডুবির কারণে কষ্টের পাহাড় জমেছে ব্রাজিলের জনসাধারণের হৃদয়ে। বিশ্বকাপ দেশটির অনেকের কাছেই পরিণত হয়েছে স্রেফ দুঃস্বপ্নে। এর পরও সমাপনী অনুষ্ঠানে কোনো কিছুরই কমতি রাখেনি ল্যাটিন আমেরিকার সর্ববৃহৎ দেশটি। ফুটবলের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রদর্শন করেই বিগত এক মাসের বিশাল আয়োজনকে গুডবাই জানাল। অনুষ্ঠানের শুরুতেই ব্রাজিলীয় সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন সাম্বা নৃত্যের প্রদর্শনী খোরাক জোগাল নিখাঁদ বিনোদনের। বাদ্য ও সুরের ছন্দে নেচে-গেয়ে মাতিয়ে তুলল মঞ্চ। দর্শকেরাও সাম্বার উন্মাদনায় মেতে উঠলেন। সাগর তীরের ফুটবল ও সাম্বার প্রতীকী রূপে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল প্রতিটি প্রাণ। এরই এক ফাঁকে টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণকারী ৩২ দলের পতাকা হাতে মঞ্চে ঘুরে গেলেন পারফরমারেরা।
ফুটবলকে কেন্দ্র করেই সমাপনী অনুষ্ঠানের পুরোটা মঞ্চস্থ হলো মারাকানায়। দুই ফাইনালিস্ট ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার জার্সি দুই মানব ফুটবল নিয়ে মেতে উঠেন অকল্পনীয় খেলায়। শরীরের বিভিন্ন ভাঁজে ফুটবলীয় কারুকার্য ফুটিয়ে তোলেন নিপুণভাবে। বাদ্যের তালে তালে মানবস্পর্শে ফুটবলের বিস্ময়কর এই সৃষ্টি তৈরি করল অসাধারণ দৃশ্যের।
শাকিরার ‘লা, লা, লা’র অপেক্ষা বেশিক্ষণ করতে হয়নি বিশ্বকে। বিগত দুই বিশ্বকাপ মাতানো কলম্বিয়ান পপ তারকা উর্বশীর রূপে মঞ্চে আসতেই নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হলেন সবাই। শাকিরা গাইলেন। জয় করলেন অগণিত হৃদয়। লা,লা,লা’র সুর মূর্ছনায় মাত হলো পুরো বিশ্ব। কলম্বিয়ান তারকার পারফরম শেষ না ‘ভবিষ্যৎ প্রেরণার’ স্লোগান নিয়ে মঞ্চে এলেন ওয়ারকিফ জেন ও কার্লোস সান্তানা। গাইলেন তাদের সুপার হিট সং ‘উই উইল ফাইন্ড এ ওয়ে’। সব শেষে ব্রাজিলীয় সঙ্গীতের সুর মূর্ছনায় দর্শকদের বিমোহিত করেন পাইরেস ও সাঙ্গালো। মনমাতানো বাদ্য ও সুরের মধ্যেই বিশ্বকে স্বাধীনতা, সমতা, ভালোবাসা ও ঐক্যের ডাক নিয়ে বিদায় নিলো ব্রাজিল বিশ্বকাপ। গুডবাই ব্রাজিল। স্বাগতম রাশিয়া ২০১৮ বিশ্বকাপ।