বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি খাতের ত্রিশটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) একযোগে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন, যা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে দেশটির গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
ব্যাংকের টাকা ব্যয় করে এত এমডির একযোগে বিদেশ সফরে যাওয়ায় কেউ কেউ সমালোচনা করলেও শীর্ষস্থানীয় একটি ব্যাংকের এমডি বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস বা বিচার বিভাগের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন।
ওই কর্মসূচির শেষে চারটি ব্যাংকের এমডি অফশোর ব্যাংকিংয়ের আওতায় প্রবাসীরা যাতে দেশের ব্যাংকে ডলার জমা করেন, তা নিয়ে প্রচারণামূলক অনুষ্ঠানে যোগ দিবেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অফশোর ব্যাংকিংয়ের আওতায় সিঙ্গাপুর বা দুবাইয়ের মতো বাংলাদেশেও ডলার এলে ভালো। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অফশোর ব্যাংকিংয়ে লাভবান হতে হলে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি ও ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা উন্নয়ন জরুরি বলে মনে করেন তারা।
অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ ব্যাংক কর্মকর্তাদের একযোগে বিদেশ সফরের সমালোচনা করলেও অন্যরা বাণিজ্যের দিক দিয়ে কিছু সুফল আসতে পারে বলেও মনে করছেন।
যদিও ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, এটা বিনোদনমূলক কোনো সফর নয়। বরং ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থেই তারা এই সফরে যাচ্ছেন।
একযোগে সব এমডি যাচ্ছেন কেন
সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন এমডিদের ব্যাংকের অর্থ ব্যয় করে একযোগে বিদেশ সফর নিয়ে প্রকাশিত খবরাখবরের জন্য ক্ষোভ ও উষ্মা প্রকাশ করেন।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর বড় ট্রেড পার্টনার। তাদের অ্যান্টি মানিলন্ডারিং, টেররিস্ট ফাইন্যান্সিং, ট্রেড বেজড লন্ডারিং, কেওয়াইসি, নিষেধাজ্ঞায় থাকা দেশের সাথে ব্যবসার কানুন, ইত্যাদি মেনেই আমরা ব্যাংকিং করি। আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের ডাকে আমরা যাচ্ছি।’
ডিপার্টমেন্ট ও অব জাস্টিসের সাথে এমডিদের আলোচনা শেষে চারটি ব্যাংকের এমডি নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশী ও বিদেশীদের অংশগ্রহণে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিবেন, ব্যাংকগুলো যার নাম দিয়েছে আউটরিচ প্রোগ্রাম। নিউইয়র্কের ওই অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নরও যোগ দিবেন।
মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘আমি বিস্মিত যে মিডিয়া এই ট্রিপ নিয়ে বাঁকা কথা বলছে। ৪৭০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির সাপেক্ষে এইসব কার্যক্রমকে দেখতে হবে। যে দুই কাজে এমডিরা যাচ্ছেন, বা যে সত্যিকারের বড় একটা কাজে ডেপুটি গভর্নর মহোদয় নিউ ইয়র্ক যাচ্ছেন, তার দুটোই এই অর্থনীতির বিকাশের জন্য জরুরি।’
তিনি বলেন, তার ইউরোপে একটি সফরের মাধ্যমে অফশোর ব্যাংক ফিক্সড ডিপোজিট ব্যাল্যান্স সিটি ব্যাংকের একাই এখন ২০ মিলিয়ন ডলারের ওপরে।
‘যারা যাচ্ছে সবাই বড় ব্যাংক। এসব ব্যাংক সরকারকে আট শ’ মিলিয়ন থেকে এক বিলিয়ন ডলার কর দিয়েছে। সেখানে সব এমডির খরচ হবে সোয়া দুই লাখ ডলার। অনেক ট্রেড পার্টনারের সাথে আমাদের আবার অনেক দ্বিপক্ষীয় মিটিং আছে।’
এমডিদের কয়েকজন ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন। বাকিরা আজকালের মধ্যে রওয়ানা দিবেন বলে জানা গেছে।
অর্থনীতিবিদরা যা বলছেন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম এমডিদের দলবেঁধে বিদেশ সফরের তীব্র সমালোচনা করেছেন।
‘যেসব কাজে ওনারা যাচ্ছেন এর কোনোটার জন্যই এমডিদের দলবেঁধে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই। সবসময় এমন ভালো কথা শুনি। সব বেড়ানোর আয়োজন।’
অবশ্য পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাতের সাথে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সম্পর্কের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
‘মানিলন্ডারিং, নিষেধাজ্ঞায় থাকা দেশের সাথে ব্যবসাসহ কতগুলো বিষয় আছে যেখানে একটু ভুল করলেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্য ব্যাংকগুলোর এসব বিষয়ে সতর্ক থাকার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাতের সাথে সম্পর্ক জোরদারের উদ্যোগ ভালো। ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিসের কর্মসূচি তাই কাজে লাগবে বলে মনে করি,’ বলেন তিনি।
‘আউটরিচ প্রোগ্রামটা ব্যাংকের নিজস্ব। অফশোর ব্যাংকিংয়ের জন্য তারা যদি সোর্স অফ মবিলাইজিং ফান্ডের কাজ করে তাহলে অসুবিধা কোথায়। কিছু এলে তো লাভ। রাষ্ট্রই লাভবান হবে।’
উল্লেখ্য, অফশোর ব্যাংকিং সারা পৃথিবীতে প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের একটি অংশ। বিশ্বজুড়ে অনেক ব্যাংকের জন্য এটা বড় আয়ের অংশ। সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ অনেক দেশ এভাবে লাভবান হয়েছে বলে অনেকে বলে থাকেন।
তবে বাংলাদেশের নাজুক ব্যাংকিং খাতকে বিবেচনায় রেখে এ ধরনের অফশোর ব্যাংকিংয়ের বিষয়ে সুফল পেতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীন নজরদারি, মনিটরিং এবং ব্যাংকিং খাতে সুশাসন জরুরি বলে মনে করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যে ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় যে দুর্বলতা, সুশাসনের ক্ষেত্রে দুর্বলতা, সংস্কারের ক্ষেত্রে শ্লথতা- তার সুযোগে উল্টো দেশের অর্থ পাচার না হয় সে ধরনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা দরকার। ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী হলে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে দেখভাল যদি করতে পারে তাহলে অফশোর ব্যাংকিং সাধারণ ব্যাংকিং কর্মকাণ্ড হিসেবেই সংযোজিত হবে।’
‘তবে সমস্যা হলো- টাকা পাচার, ঋণখেলাপি, টাকা বাইরে নিয়ে যাওয়া – এখানে চলমান সমস্যা। এ কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সতর্ক ও সাবধান হওয়া দরকার,’ বলেন মোস্তাফিজুর রহমান।
কীভাবে চলছে বাংলাদেশের অফশোর ব্যাংকিং
বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৯টি ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। শুধুমাত্র লাইসেন্সধারী ব্যাংকগুলোতে অফশোর অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে। যাদের লাইসেন্স আছে তাদের নতুন করে নিতে হবে না।
এ ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রমে যারা বিনিয়োগ করবে তারা বিদেশী বা অনাবাসী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হতে হবে।
অনুমোদিত এই আইনের অধীনে ব্যাংকগুলো বিদেশী বা অনাবাসী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় যে আমানত গ্রহণ করবে তা স্বাভাবিক ব্যাংকিং পদ্ধতিতে ব্যবহার করতে পারবে।
বিদেশে যে বাংলাদেশী বসবাস করছেন তার পক্ষে দেশে অবস্থানরত কোনো বাংলাদেশী নাগরিক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। সহায়তাকারী হিসেবে তারা অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করতে পারবেন।
পাঁচ ধরনের বৈদেশিক মুদ্রা- ডলার, পাউন্ড, ইউরো, জাপানি ইয়েন ও চীনা ইউয়ানে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে।
বর্তমানে যে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা রয়েছে তাতে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) না থাকলে আমানতের আয়ের উপর ১৫ শতাংশ কর দিতে হয়। আর টিআইএন থাকলে ১০ শতাংশ কর দিতে হয়। নতুন আইনে কোনো কর দিতে হবে না।
একইসাথে অফশোর ব্যাংকিং লেনদেনে যে সুদ আসবে তার ওপর কোনো কর আরোপ করা হবে না। অ্যাকাউন্ট পরিচালনার জন্য কোনো সুদ বা চার্জ দিতে হবে না।
নতুন আইনে কোনো ঋণসীমা রাখা হয়নি, এতে যেকোনো পরিমাণ লেনদেন করা যাবে।
সূত্র : বিবিসি