‘ভাই পথের ফকির হয়ে গেছি। পকেটে মাত্র ২৪০ টাকা আছে। চাঁদ রাতে বিক্রির পর দোকানে সব মালামাল রেখে গিয়েছিলাম। আমার চারটা দোকান ছিল। আর আজ এসে দেখি কিছুই নাই। সবাইকে জানিয়ে দোকান উচ্ছেদ করা উচিত ছিল। আমার মতো শত শত মানুষ গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে গিয়েছে। তারা এসে দেখবে তাদের দোকান ও মালামাল কিছুই নাই। এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে আমাদের কী গতি হবে সেটা আল্লাহ জানেন।’
কথাগুলো বলছিলেন বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ী মো. আনোয়ার হোসেন। অস্থায়ী মার্কেটের জায়গায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নতুন বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করা হবে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জানিয়ে দোকান উচ্ছেদ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন আনোয়ার হোসেন।
অবশ্য এমন অভিযোগ তার একার নয়। মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রায় ৩০ জনের মতো ব্যবসায়ী উপস্থিত হয়ে এমন অভিযোগ করেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বঙ্গবাজারের অস্থায়ী মার্কেটের সব জিনিসপত্র এরই মধ্যে অপসারণ করা হয়েছে। কেবলমাত্র পুরো মাঠজুড়ে বাঁশের কাঠামো রয়েছে। উচ্ছেদের দায়িত্ব পালন করছে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (এনডিই)। ভেকুর সাহায্যে সামনের দিক থেকে বাঁশের ও কাঠ দিয়ে তৈরি করা অস্থায়ী দোকান ভেঙে এক পাশে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর সেসব বাঁশ ও কাঠ স্থানীয় ভাসমান মানুষজন যে যেভাবে পারছে নিয়ে যাচ্ছে। রিকশা, ভ্যানগাড়ি এমনকি সিএনজির উপরে তুলেও বাঁশ নিয়ে যেতে দেখা যায়।
ভেকু চালক রাজন মিয়া বলেন, ব্যবসায়ীদের তাদের যাবতীয় জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়। আর উচ্ছেদের বিষয়টি হুট করে হয়নি। আগে থেকেই জানানো হয়েছিল। ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সরে যাওয়ার আল্টিমেটাম ছিল। নিয়ম মেনেই গতকাল থেকে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
পুনর্বাসনে সরকারের সহায়তা চান বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা
বর্তমান পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে নিজেদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে সরকারের পুনর্বাসন সহায়তা প্রত্যাশা করছেন বঙ্গবাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা।
জাহিদুল ইসলাম রানা নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, আমাদের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা না করেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়াটা অযৌক্তিক। আমাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা না হলে পরিবার পরিজন নিয়ে কীভাবে জীবন ধারণ করব? মালিক সমিতি আমাদের সঙ্গে কোন ধরনের যোগাযোগ করেনি। আপনারাই বলেন, যদি আমরা জানতাম যে এই সময়ে উচ্ছেদ করা হবে তাহলে কি নিজেদের জিনিসপত্র দোকানে রেখে চলে যেতাম? তাছাড়া আগুনে পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি আমরা। এখনো ক্ষতিগ্রস্ত হলাম আমরা। অথচ আমাদের আর্থিক অনুদান দেওয়া হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা পাইনি। এখন আবার আমাদের না জানিয়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে। সবদিক দিয়েই আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে।
হাবিবুর রহমান নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ঈদকে সামনে রেখে আমরা দোকান ডেকোরেশন করেছিলাম। মার্কেটের সিকিউরিটি গার্ড যারা ছিল তারা আমাদের বলেছিল, এখন উচ্ছেদ করা হবে না। সেই ভরসায় আমরা সব কিছু রেখে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে গিয়েছি। এর মধ্যে খবর পেলাম দোকান ভেঙে ফেলা হচ্ছে। আজকে এসে দেখি কিছুই নেই। তাহলে আমার দোকানের এই মালপত্র কোথায় গেল? আমরা কার কাছে গেলে এর বিচার পাব? আমাদের এখন একটাই আশা যেন আগুনের ক্ষতিপূরণ আমাদের হাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক। অথবা এই মার্কেটে আমাদের দোকান বরাদ্দ দেয়া হোক। ক্ষতি হয়েছে আমাদের অথচ সুযোগ পাচ্ছে মার্কেটের মালিকরা। আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।
অনুদানের টাকা জমা রয়েছে, এক টাকাও খরচ করা হয়নি : মালিক সমিতি
সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বঙ্গবাজারে আসেন মালিক সমিতির নেতারা। এ সময় কমিটির সদস্য জিএম আতিকুল ইসলাম বলেন, আলাপ-আলোচনা করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মেয়রের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা ব্যবসায়ীদের বারবার এই বিষয়টি বলেছি। এমনকি আমরা চিঠিও দিয়েছি তাদের কাছে। এখানে যা কিছু করা হচ্ছে সব ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই করা হচ্ছে। আর অনুদান যেগুলো এসেছে সেটি একটি অ্যাকাউন্টে সব জমা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আরও অনুদান দেবেন। তারপর মেয়র ব্যবসায়ীদের ডেকে এই অর্থ বুঝিয়ে দেবেন। আমরা চিন্তা করছি বিকল্পভাবে তাদের (ব্যবসায়ীদেরকে) অন্যান্য মার্কেটে স্থানান্তর করার জন্য। তারা যেন ব্যবসা করতে পারে সেজন্য অন্যান্য মার্কেটে তাদের দোকান নিয়ে দেব।
মালামাল লুটের বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের আগেই সতর্ক করা হয়েছে যে ঈদের পরেই কাজ শুরু হবে। এমন কোন ঘটনা ঘটেনি।
এ সময় মালিক সমিতির সদস্য শাহ আলম বলেন, তাদের (ব্যবসায়ীদের) আগে থেকেই জানানো হয়েছে যে, এই জায়গাগুলো সিটি কর্পোরেশনকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। তারা যেন আগেভাগেই তাদের মালামাল সরিয়ে নেন। এটি একবার-দুইবার নয় অনেকবার বলা হয়েছে। এখন তারা মিথ্যা কথা বলছেন। এসব অভিযোগ আপনাদের (সাংবাদিকদের) কাছে করে। তারা আমাদের কিছু বলে না। আমাদের সামনে তাদের এসব অভিযোগ উত্থাপন করুক। যখন উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে তখন কোথাও কোন মালামাল ছিল না।
এ সময় উপস্থিত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মালিক সমিতির নেতাদের কথা কাটাকাটি হলে কিছুটা উত্তেজনাও তৈরি হয়। এক পর্যায়ে মালিক সমিতির নেতারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৪ এপ্রিল ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয় রাজধানীর সবচেয়ে পুরনো ও জনপ্রিয় পাইকারি কাপড়ের মার্কেট বঙ্গবাজার। পরে এই মার্কেটের আধুনিক রূপদান এবং সেখানে ব্যবসায়িক পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ নেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। পরিকল্পনা অনু্যায়ী ‘বঙ্গবাজার পাইকারি নগর বিপণিবিতান’ ভবন নির্মাণের কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১০ তলাবিশিষ্ট আধুনিক এ ভবনে থাকবে বেজমেন্ট ও গ্রাউন্ড ফ্লোর। গ্রাউন্ড ফ্লোরে মোট ৩৮৪টি, প্রথম তলায় ৩৬৬টি, দ্বিতীয় তলায় ৩৯৭টি, তৃতীয় তলায় ৩৮৭টি, চতুর্থ তলায় ৪০৪টি, পঞ্চম তলায় ৩৮৭টি, ষষ্ঠ তলায় ৪০৪টি ও সপ্তম তলায় ৩১৩টি দোকান থাকবে। এছাড়া, অষ্টম তলায় দোকান মালিক সমিতির অফিস, কর্মচারী ও নিরাপত্তাকর্মীদের আবাসনের ব্যবস্থা রাখা হবে। ভবনের পার্কিংয়ে একসঙ্গে প্রায় ১৮৫টি গাড়ি ও ১১০টি মোটরসাইকেল পার্কিং করা যাবে। ভবনটিতে ২২টি খাবারের দোকান রাখা হবে। সেই সঙ্গে নকশায় আরও ৮১টির বেশি দোকান রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতিটি দোকানের আয়তন হবে ৮০-১০০ স্কয়ার ফুট।