ইস্টার্ণ রিফাইনারীর প্রথম ইউনিট। ২০১০ সালে ইস্টার্ণ রিফাইনারীর দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এখনও তা বাস্তবায়ন হয়নি / ফাইল ছবি
নির্মাণকাজ শুরুর আগেই ইস্টার্ণ রিফাইনারীর দ্বিতীয় ইউনিট প্রকল্পে খরচ হয়েছে ১১০০ কোটি টাকা। দেশে জ্বালানি তেল পরিশোধনের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১০ সালে ইস্টার্ণ রিফাইনারীর দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ১৪ বছর পেরিয়ে গেলেও নির্মাণকাজ শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)
দেশের জ্বালানি তেলের একমাত্র সরকারি শোধনাগার ইস্টার্ণ রিফাইনারীর প্রথম ইউনিট (ইআরএল-১) নির্মিত হয় ১৯৬৮ সালে। এটি প্রতি বছর ১৫ লাখ টন ক্রুড অয়েল (অপরিশোধিত তেল) পরিশোধন করতে পারে। বর্তমানে দেশের জ্বালানি তেলের চাহিদা ৯০ থেকে ৯৫ লাখ টন। এর অধিকাংশই আমদানি করা হয় পরিশোধিত অবস্থায়। তবে, এটি খরচের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় বিধায় ক্রুড অয়েল আমদানি করে দেশে পরিশোধের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সে লক্ষ্যে ২০১০ সালে বছরে ৩০ লাখ টন জ্বালানি তেল পরিশোধনের ক্ষমতাসম্পন্ন ইস্টার্ণ রিফাইনারীর দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ নেয় সরকার। যার নির্মাণব্যয় ধরা হয় ১৩ হাজার কোটি টাকা।
পরামর্শক, জমি অধিগ্রহণ, প্রস্তাবনা তৈরিসহ বিভিন্ন খাতে ইতোমধ্যে খরচ হয়েছে ১১০০ কোটি টাকা। সংশোধিত হয়ে বর্তমানে প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ২৩ হাজার ৫৮ কোটি ৯৩ লাখ ৯২ হাজার টাকা। এর মধ্যে সরকারের দেওয়ার কথা ১৬ হাজার ১৪২ কোটি টাকা এবং বিপিসি অর্থায়ন করবে ছয় হাজার ৯১৬ কোটি টাকা। কিন্তু এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি প্রকল্পটি
উদ্যোগ গ্রহণের দীর্ঘ সাত বছর পর প্রকল্পের ফিল্ড কন্ট্রাক্টর হিসেবে ফরাসি প্রতিষ্ঠান টেকনিপের সঙ্গে চুক্তি করে বিপিসি। টেকনিপ প্রকল্পের ডিজাইন তৈরি করে। অন্যদিকে, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট (পিএমসি) হিসেবে ২০১৬ সালে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেডের (ইআইএল) সাথেও চুক্তি করে বিপিসি।
বাস্তবায়ন না হলেও পরামর্শক, জমি অধিগ্রহণ, প্রস্তাবনা তৈরিসহ বিভিন্ন খাতে ইতোমধ্যে খরচ হয়েছে ১১০০ কোটি টাকা / ফাইল ছবি
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, পরামর্শক, জমি অধিগ্রহণ, প্রস্তাবনা তৈরিসহ বিভিন্ন খাতে ইতোমধ্যে খরচ হয়েছে ১১০০ কোটি টাকা। সংশোধিত হয়ে বর্তমানে প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ২৩ হাজার ৫৮ কোটি ৯৩ লাখ ৯২ হাজার টাকা। এর মধ্যে সরকারের দেওয়ার কথা ১৬ হাজার ১৪২ কোটি টাকা এবং বিপিসি অর্থায়ন করবে ছয় হাজার ৯১৬ কোটি টাকা। কিন্তু এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি প্রকল্পটি।
মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, প্রকল্পটির জন্য যথেষ্ট বিনিয়োগ এবং বৈদেশিক ঋণ না পাওয়ায় এটির বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি কোম্পানি বাংলাদেশের তেল পরিশোধনাগার নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করলেও ইস্টার্ন রিফাইনারীর দ্বিতীয় ইউনিটের আকার ছোট হওয়ায় তারা সরে গেছে।
তবে, ইআরএল-২ নির্মাণে যৌথ বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্প গ্রুপ এস আলম। বিগত বছরের আগস্ট মাসে ‘বেসরকারি পর্যায়ে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিপূর্বক মজুত, প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন ও বিপণন নীতিমালা-২০২৩’ প্রণয়ন করে সরকার। নীতিমালায় রিফাইনারী স্থাপনের চূড়ান্ত অনুমোদন প্রাপ্তি/থাকা-সাপেক্ষে বেসরকারি পর্যায়ের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উৎপাদন ও ব্যবসা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে আবেদনের সুযোগ রাখা হয়।
এতগুলো টাকা খরচ হওয়ার পরও প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে না পারা অত্যন্ত দুঃখজনক— বলছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন / ফাইল ছবি
ফলে গত ১২ অক্টোবর পতেঙ্গায় অবস্থিত ইআরএলের জমিতে ৫০ লাখ টন জ্বালানি তেল শোধনাগার নির্মাণের প্রস্তাব দেয় এস আলম গ্রুপ। প্রস্তাবনায় তিন থেকে পাঁচ মিলিয়ন টন সক্ষমতার নতুন রিফাইনারী নির্মাণের আগ্রহের কথা উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া, ওই প্রকল্পে এস আলম গ্রুপ ও ইস্টার্ন রিফাইনারীর মধ্যে ৮০:২০ ইক্যুইটি শেয়ার থাকার কথাও উল্লেখ করা হয়।
এতগুলো টাকা খরচ হয়ে যাওয়ার পরও প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে না পারা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমাদের শোধনাগার লাগবে কি না, এ বিষয়ে শুরু থেকে তারা ভালোভাবে স্টাডি করেনি। স্টাডি করলে প্রজেক্ট বাস্তবায়নের বিভিন্ন বাধা ও ইস্যুগুলো উঠে আসত
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন
গত ৫ ফেব্রুয়ারি জ্বালানি বিভাগ থেকে এক চিঠিতে বিপিসিকে জানানো হয়, এস আলম গ্রুপের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি যৌথ চুক্তির (পিপিপি) ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। যা দেশীয় জ্বালানি কোম্পানির সঙ্গে বেসরকারি খাতের কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রথম অংশগ্রহণ। জ্বালানি বিভাগের নির্দেশনা অনুসারে বিপিসি গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে।
এ প্রসঙ্গে বিপিসির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইস্টার্ণ রিফাইনারীর দ্বিতীয় ইউনিটের ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এ ছাড়া, এস আলম গ্রুপ এ প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে চেয়েছে। এ বিষয়েও চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে মন্ত্রণালয়। আশা করছি দ্রুতই একটি ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন,সম্ভাব্যতা যাচাই না করে প্রজেক্ট বাস্তবায়নের কাজ অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত। আরও বিচার-বিশ্লেষণ করে সরকারের উচিত একটি কার্যকর সিদ্ধান্তে আসা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, এতগুলো টাকা খরচ হয়ে যাওয়ার পরও প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে না পারা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমাদের শোধনাগার লাগবে কি-না, এ বিষয়ে শুরু থেকে তারা ভালোভাবে স্টাডি করেনি। স্টাডি করলে প্রজেক্ট বাস্তবায়নের বিভিন্ন বাধা ও ইস্যুগুলো উঠে আসত।
‘সরকার চেষ্টা করছে এ প্রজেক্টে ফান্ডিং পাওয়ার জন্য। কিন্তু বিদেশি সংস্থাগুলো যখন দেখছে যে এতে ফান্ডিং করা যুক্তিযুক্ত নয়, তখন তারা সরে যাচ্ছে। এখন সমাধান হলো নিজের টাকাতেই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করা। যেহেতু এস আলমও অর্থায়ন করতে চাচ্ছে, সেহেতু সরকারের উচিত বিষয়টি আরও অ্যানালাইসিস করে একটা সমাধানযোগ্য জায়গায় এনে দাঁড় করানো’— জানান এ বিশেষজ্ঞ।