রাজধানীর পুরান ঢাকার বাসিন্দা এমদাদুল হক মারা যান গত ৯ মার্চ রাতে। পরদিন সকালে মরদেহসহ স্বজনরা আজিমপুর কবরস্থানে নিয়ে আসেন। জানিয়ে রাখায় কবর খোঁড়ার কাজ শুরু হয়েছিল আগেই।
মরদেহ আনার পর প্রথমে দিতে হয় দাফনের জন্য সিটি কর্পোরেশনের নিবন্ধন ফি ১ হাজার টাকা। এরপর কবরের বাঁশ ও চাটাই বাবদ ৭০৮ টাকা।
এরপর কবরস্থানের একটা সিন্ডিকেট মরদেহ দাফন নিয়ে শুরু করে একরকম বাণিজ্য। তাদের কবলে পড়ে এমদাদুল হককে দাফন করতে স্বজনদের খরচ হয় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টাকা।
কোথায় কবর হবে– সামনের দিকে ভালো জায়গায় নাকি ভেতরের দিকে, এসব নিয়েও চলে দর কষাকষি। যদিও এখানেই শেষ নয়! দাফনের পর কবরের পরিচর্যার নামে শুরু হয় বাণিজ্যের আরেক অধ্যায়। এজন্য স্বজনদের কাছ থেকে মাসে মাসে আদায় করে নেওয়া হয় বড় অঙ্কের বকশিশের টাকা।
রাজধানীর কোথাও কেউ মারা গেলে স্বজনরা যে কবরস্থানে তাকে দাফন করতে চান, সেখানে আগে থেকে জানাতে হয়। এরপর শুরু হয় কবর খোঁড়ার কাজ। ভালো জায়গায় কবর দিতে চাইলে গুনতে হয় অতিরিক্ত টাকা। অন্যথায় ভেতরের দিকে যেমন-তেমন স্থানে কবর দিয়ে দেওয়া হয়
আজিমপুর কবরস্থানে এমদাদুল হককে দাফন করতে গিয়ে এমন বিড়ম্বনায় পড়ার অভিজ্ঞতা ঢাকা পোস্টের কাছে বর্ণনা করেন তার ভাতিজা নিলয় আহমেদ।
তিনি বলেন, ভাবতে অবাক লাগে মরদেহ দাফন নিয়ে কবরস্থানে এমনভাবে মানুষ বাণিজ্য করতে পারে! এটা পুরোটাই অমানবিক। যখন কোনো কবর নতুন করে দেওয়া হয় তখন এখানকার পরিচর্যাকারীরা এসে ঘিরে ধরে। সেই কবর পরিচর্যা করার নামে প্রতিমাসে স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে তারা। এভাবে কবরস্থানে দাফন থেকে শুরু করে পদে পদে বাণিজ্য করে এখানকার লোকজন।
মা মারা গেছেন আজ ৬ মাস। এখানে কবর দিতে অতিরিক্ত টাকা তো খরচ হয়েছেই। পাশাপাশি প্রতিমাসে এখনো টাকা দিয়ে যেতে হচ্ছে। কবরস্থানে এক শ্রেণির মানুষ আছে যারা কবর পরিচর্যার নামে কবরবাসীর স্বজনদের জিম্মি করে রেখেছে
গুলশানের বাসিন্দা ইসরাত জাহান
ঢাকায় প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস। বিশাল সংখ্যক মানুষের এ ভূমির দুই সিটি কর্পোরেশনের অধীনে কবরস্থানের নির্ধারিত জায়গা রয়েছে ৯টি। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় তিনটি, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় রয়েছে ছয়টি। তবে এসব কবরস্থানে নতুন করে আর জায়গা বাড়ানোর সুযোগ নেই।
পাশাপাশি স্থান স্বল্পতার কারণে কবর সংরক্ষণের ব্যবস্থাও সীমিত। চাইলেই কবর সংরক্ষণের জন্য স্থায়ী জায়গা পাওয়া যায় না। নির্ধারিত সাধারণ জায়গায় স্বজনদের কবর দিতে হয়। নির্দিষ্ট চার্জ দিয়ে বিভিন্ন মেয়াদে কবর সংরক্ষণ করা যায়। তবে, জায়গা পর্যাপ্ত না হওয়ায় সবাই এ সুযোগ পান না। একটি সাধারণ কবর ১৮ থেকে ২০ মাস থাকে। এরপর সেখানে নতুন কাউকে কবর দেওয়া হয়।
রাজধানীর কোথাও কেউ মারা গেলে স্বজনরা যে কবরস্থানে তাকে দাফন করতে চান, সেখানে আগে থেকে জানাতে হয়। এরপর শুরু হয় কবর খোঁড়ার কাজ। ভালো জায়গায় কবর দিতে চাইলে গুনতে হয় অতিরিক্ত টাকা। অন্যথায় ভেতরের দিকে যেমন-তেমন স্থানে কবর দিয়ে দেওয়া হয়।
রাজধানীর প্রতিটি কবরস্থান এলাকা ভেদে দুই সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন। এখানকার দাফনের নিবন্ধন ফি শুধু নেয় সিটি কর্পোরেশন। বাকি কাজের জন্য প্রতিটি কবরস্থান ইজারা দেওয়া আছে তৃতীয় পক্ষকে। একটি মরদেহ কবরস্থানে আসার পর নিবন্ধন ফি হিসেবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনকে দিতে হয় ১০০০ টাকা আর উত্তর সিটি কর্পোরেশনকে দিতে হয় ৫০০ টাকা। অসাধুদের বাণিজ্য শুরু হয় এরপর থেকে। কোথায় কবরটি হবে তার ওপর নির্ভর করে শুরু হয় প্রথম ধাপের বাণিজ্য।
রাজধানীর বকশীবাজার এলাকার বাসিন্দা আব্দুল ওয়াদুদ তার বাবার মরদেহ দাফন করেছেন আজিমপুর কবরস্থানে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৮ মাস আগে আমার বাবা মারা যাওয়ার পর আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করি। তখন থেকেই বুঝেছি এখানে কবর নিয়ে কেমন বাণিজ্য চলে। প্রথমে এসে নিবন্ধনের টাকাসহ ২০০০ টাকা দিতে হয়েছে। এরপর তারা কবরস্থান ভালো জায়গায় দিয়ে দেওয়ার কথা বলে অতিরিক্ত কয়েক হাজার টাকা দাবি করে। আমরা সেটাতে রাজি না হলে, শুধু কবর খোঁড়া, বাঁশ চাটাই, দাফন বাবদ আমার কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা নেয়। অথচ সিটি কর্পোরেশনের হিসেবে সর্বোচ্চ ১৮০০ টাকা লাগার কথা। যেহেতু মরদেহ সামনে তাই আমরা আর দরদাম করিনি। এটাকে তারা সুযোগ হিসেবে নেয়, জিম্মি করে এভাবে তারা স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে।
‘এছাড়া কবর রক্ষণাবেক্ষণ করবে এমন আশ্বাস দিয়ে তারা প্রতি মাসে এক দুই হাজার টাকা করে চেয়ে বসে। না দিলে কবর অপরিচ্ছন্ন হয়ে থাকে। এখানে বহিরাগত অনেক মানুষ আছে যারা কবর রক্ষণাবেক্ষণের নামে বাণিজ্য করছে।’
এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আজিমপুর কবরস্থানের সহকারী লাইনম্যান আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, কবর নিয়ে কোনো বাণিজ্য আমরা করি না। সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত ফি আমরা গ্রহণ করি। সঙ্গে কবর খোঁড়া, বাঁশ, চাটাইয়ের দাম নিই। আমরা কোন লাইনে নতুন কবর হবে সেটা ঠিক করে দিই। কিন্তু দাফন করতে আসা স্বজনরা যদি যারা কবর খোঁড়ে তাদের বকশিশ দেয় তাহলে সেখানে আমাদের কিছু বলার নেই। মৃতের স্বজনরা খুশি হয়ে কর্মীদের টাকা দিলে এটা তো আর বাণিজ্য হয় না।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বে থাকা সহকারী সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা সাইদুর রহমান বলেন, সাধারণ কবরের জন্য আমাদের নির্ধারিত ফি এক হাজার টাকা। পাশাপাশি খবর খোঁড়া, বাঁশ চাটাইয়ের যে খরচ পড়ে তাও নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। এর বাইরে কোনো চার্জ আমাদের নেই। এছাড়া নির্দিষ্ট চার্জ দিয়ে বিভিন্ন বছর মেয়াদি কবর সংরক্ষণ করা যায়। তবে জায়গা পর্যাপ্ত না থাকায় সবাই এ সুযোগ নিতে পারেন না।
ড্যাপের আওতায় থাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় আশপাশে যেসব নিচু জায়গা আছে, সেগুলো অধিগ্রহণের মাধ্যমে কিছুটা ভরাট করে কবরস্থান করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে জমিগুলো ব্যক্তি মালিকানায় থাকায় আমরা সেটা অধিগ্রহণের মাধ্যমে সেখানে কবরস্থানের জন্য বরাদ্দ করব
ড্যাপ পরিচালক আশরাফুল ইসলাম
পরিচর্যার নামে জিম্মি হচ্ছেন স্বজনরা
ধানমন্ডির বাসিন্দা মকিদুর রহমান তার মাকে ৮ মাস আগে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করেন। সেই সময় অতিরিক্ত ৬ হাজার টাকা দিয়ে নির্ধারিত স্থানের একটু সামনের দিকে মায়ের কবরের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। তিনি এসেছিলেন তার মায়ের কবর জিয়ারত করতে।
মকিদুর রহমান বলেন, দাফন কাজ হওয়ার পরে যখন আবার কবরস্থানে কবরের কাছে গেলাম, তখন দুজন লোক এসে আমাকে বলল আমরা এই সারিতে যতগুলো কবর আছে সেগুলোর পরিচর্যা করি। ঘাস লাগাই, পানি দিই, কবর পরিষ্কার করি—প্রতিটি লাইনেই ভিন্ন ভিন্ন লোক পরিচর্যা করে। তারা বলে, প্রতি মাসে খুশি হয়ে টাকা দিলে তারা আমার মায়ের কবরটি পরিচর্যা করবে। আমিও রাজি হয়ে যাই। এখন প্রতি মাসে তারা দেড় দুই হাজার টাকা দাবি করে বসে। আর দিতে দেরি হলে আবার কল করে, বিকাশে টাকা চায়। মাঝে মাঝে আমাকে দুর্বল করার জন্য বলে আপনার মায়ের কবরে নতুন কবর বসবে। আমাদের টাকা দেন যতদিন রাখা যায় রাখব।
মকিদুর রহমানের অভিযোগের সূত্র ধরে কথা হয় আজিমপুর কবরস্থানের পরিচর্যাকারী হালিম আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা কোনো মানুষের কাছ থেকে জোর করে টাকা নিই না। তারা খুশি হয়ে যা দেয় তাই রাখি। তবে আমরা জীবিকার জন্য আর অন্য কোন কাজ করি না, আমাদের কাজই হলো কবর পরিষ্কার করা। আমাদের পূর্ব পুরুষরাও একই কাজ করে গেছেন। কবরস্থানে যতগুলো কবর আছে সেই কবরগুলো ভাগ করে নিই আমরা। একেকজন একেক লাইন ধরে কবর পরিচর্যা করে। যারা কবর দিতে আসেন তাদের ছেলে মেয়ে, ভাইদের আমরা ভালোভাবে অনুরোধ করে বলি। আপনার স্বজনের এই কবর আমরা প্রতিদিন পরিচর্যা করব, ঘাস লাগাব, পানি দেব, পরিষ্কার রাখব। তখন তারা খুশি হয়ে বকশিশ দেয় মাসে মাসে। এটাই আমাদের আয়।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কবরস্থানের দায়িত্বে থাকা সহকারী সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা এনায়েত হোসেন বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন কবরে নাগরিকরা নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে দাফন করতে পারেন। নির্দিষ্ট সময় শেষে কবরের ওপর পুনরায় কবর দেওয়া হয়। জায়গা সংকটের কারণে আমরা কবর সংরক্ষণ না করতে অনুরোধ জানাই সবাইকে।
বসবাসকারী মানুষের তুলনায় রাজধানীতে কবরস্থানের জায়গা সংকট থাকায় এক কবরের ওপরই নির্দিষ্ট সময় পরপর নতুন করে অন্য কারো কবর বসানো হয়। এভাবে কবরের ওপর কবর বসতে থাকে নিয়মিত।
রাজধানীর বনানী কবরস্থানে বাবার কবর জিয়ারত করতে এসেছেন মোফাজ্জল হোসেন। তিনি বলেন, তিন বছর আগে আমার বাবা মারা যাওয়ার পর তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করি। সেই থেকে মোটামুটি দেড় বছর পর্যন্ত কবর ছিল। এরপর সেই কবরের ওপর অন্য একজনের কবর বসানো হয়েছে। যদিও নতুন নামের পাশে আমার বাবার নামও ছোট একটা সাইনবোর্ডে লেখা আছে। তারপরও আসি কবরে, জিয়ারত করি, দোয়া করি। মনে মনে ভেবে নিই এখানেই আমার বাবার কবর। ছোট একটা নেম প্লেট আর পরিচর্যার নামে এখানকার পরিচর্যাকারীরা আমার কাছ থেকে প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে নেন।
রাজধানীতে আসলেই কবরের জায়গার সংকট রয়েছে। তবে সিটি কর্পোরেশনের আওতায় যেসব নতুন ওয়ার্ড আছে সেগুলোতে উন্নয়ন কাজের সময় নির্দিষ্ট নির্দিষ্ট জায়গায় যদি কবর স্থানের জন্য জায়গা রাখা হয় তাহলে এই সংকট কিছুটা হলেও কমে আসবে
নগর পরিকল্পনাবিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান
উচ্চ মূল্যে কবর সংরক্ষণ
যদিও জায়গা সংকটের কারণে কবর সংরক্ষণকে নিরুৎসাহিত করছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। তবুও উচ্চ মূল্য পরিশোধ করে যে কেউ তাদের স্বজনদের কবর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সংরক্ষণ করতে পারেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতায় থাকা কবরস্থানগুলোতে ১০, ১৫, ২০ বা ২৫ বছর মেয়াদে কবর সংরক্ষণের সীমিত সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে গুনতে হয় যথাক্রমে ৫, ১০, ১৫ ও ২০ লাখ থেকে ৪৫ লাখ টাকা পর্যন্ত।
অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আওতায় থাকা ছয়টি কবরস্থানে অগ্রিম কবর সংরক্ষণ বন্ধ রয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ও স্থান প্রাপ্যতা সাপেক্ষে এসব কবরস্থানে বিভিন্ন মেয়াদে কবর সংরক্ষণের সীমিত ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া কবর সংরক্ষণকে নিরুৎসাহিত করতে গত বছর কবর সংরক্ষণের ফি বাড়িয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন।
ডিএনসিসির আওতায় থাকা উত্তরা ও বনানী কবরস্থানে আগে ১৫ বছরের জন্য কবর সংরক্ষণ করতে ২৪ লাখ টাকা এবং ২৫ বছরের জন্য লাগত ৪৫ লাখ টাকা। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, বনানী কবরস্থানে ১৫ বছরের জন্য কবর সংরক্ষণ করতে লাগবে ১ কোটি টাকা আর ২৫ বছরের জন্য গুনতে হবে দেড় কোটি টাকা।
একইভাবে উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর কবরস্থানে ১৫ বছরের জন্য ৭৫ লাখ টাকা আর ২৫ বছরের জন্য এক কোটি টাকা, উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর কবরস্থানে ১৫ বছরের জন্য ৫০ লাখ আর ২৫ বছরের জন্য ৭৫ লাখ টাকা, উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টর কবরস্থানে ১৫ বছরের জন্য ৩০ লাখ আর ২৫ বছর বছরের জন্য ৫০ লাখ টাকা সংরক্ষণ ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।
মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী করবস্থানে ১৫ বছরের জন্য ২০ লাখ এবং ২৫ বছরের জন্য ৩০ লাখ টাকা, রায়েরবাজার স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন কবরস্থানে ১৫ বছরের জন্য ১০ লাখ এবং ২৫ বছরের জন্য ১৫ লাখ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।
ঢাকায় প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস। বিশাল সংখ্যক মানুষের এ ভূমির দুই সিটি করপোরেশনের অধীনে কবরস্থানের নির্ধারিত জায়গা রয়েছে ৯টি। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় তিনটি, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় রয়েছে ছয়টি। তবে এসব কবরস্থানে নতুন করে আর জায়গা বাড়ানোর সুযোগ নেই
কবর নিয়ে বাণিজ্যে অতিষ্ঠ স্বজনরা
রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে সম্প্রতি বড় ভাইকে কবর দিয়েছেন হাজারীবাগের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম। কবরস্থানের অব্যবস্থাপনা ও বাণিজ্য নিয়ে তিনি বলেন, আমার বড় ভাইকে কবর দেওয়ার সময় আজিমপুর কবরস্থানে খরচ হয়েছে প্রায় ৬ হাজার টাকা। অথচ সিটি কর্পোরেশনের হিসেব অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১৮০০ টাকা খরচ হওয়ার কথা। আগে এক সময় এই টাকাও লাগত না। মৃত মানুষকে দাফন করার সময় সমানে মরদেহ রেখে এমন বাণিজ্য সামাজিক অবক্ষয় ছাড়া আর কিছুই নয়।
তিনি আরও বলেন, যতই ইজারা দেওয়া হোক কবরস্থানের তত্ত্বাবধায়ক তো সিটি কর্পোরেশন। এমন সব বাণিজ্য, অব্যবস্থাপনা যে করবস্থানে চলছে, এই বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনেরই তো ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
রাজধানীর বনানী কবরস্থানে মায়ের কবর জিয়ারত করতে এসে একই রকম অভিযোগ করেন গুলশানের বাসিন্দা ইসরাত জাহান। তিনি বলেন, মা মারা গেছেন আজ ৬ মাস। এখানে কবর দিতে অতিরিক্ত টাকা তো খরচ হয়েছেই। পাশাপাশি প্রতিমাসে এখনো টাকা দিয়ে যেতে হচ্ছে। কবরস্থানে এক শ্রেণির মানুষ আছে যারা কবর পরিচর্যার নামে কবরবাসীর স্বজনদের জিম্মি করে রেখেছে।
তিনি বলেন, তারা হুমকি দেয় আপনার মায়ের কবরে অন্য কবর বসবে, আমাদের টাকা দেন, আমি কবর রাখার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। এছাড়া তারা কবর পরিষ্কার রাখা, পরিচর্যা করার নামে জোর করে টাকা নেয় প্রতি মাসে। এরা অবশ্য সিটি কর্পোরেশনের লোক না, কিন্তু ভেতরে তারা সিন্ডিকেট করে রেখেছে। যেহেতু মায়ের কবর একটা অনুভূতির বিষয় তাই প্রতি মাসে বাধ্য হয়ে এদের টাকা দিতে হয়। কোনো মাসে আসতে দেরি হলে তারা কল করে, টাকা নেয় বিকাশে।
কোথায় কবর হবে– সামনের দিকে ভালো জায়গায় নাকি ভেতরের দিকে, এসব নিয়েও চলে দর কষাকষি। যদিও এখানেই শেষ নয়! দাফনের পর কবরের পরিচর্যার নামে শুরু হয় বাণিজ্যের আরেক অধ্যায়। এজন্য স্বজনদের কাছ থেকে মাসে মাসে আদায় করে নেওয়া হয় বড় অঙ্কের বকশিশের টাকা
এদিকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) নতুন করে কবরস্থানের উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়টি এসেছে। সেক্ষেত্রে রাজধানীতে নতুন করে কবরস্থান নির্মাণ করা হবে।
এ বিষয়ে ড্যাপ পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ড্যাপে কবরস্থানের জন্য কিছু কিছু জায়গা আমরা চিহ্নিত করেছি। তবে চিহ্নিত করা জায়গা বেশির ভাগ ব্যক্তি মালিকানায়। ড্যাপের আওতায় থাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় আশপাশে যেসব নিচু জায়গা আছে, সেগুলো অধিগ্রহণের মাধ্যমে কিছুটা ভরাট করে কবরস্থান করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে জমিগুলো ব্যক্তি মালিকানায় থাকায় আমরা সেটা অধিগ্রহণের মাধ্যমে সেখানে কবরস্থানের জন্য বরাদ্দ করব।
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, রাজধানীতে আসলেই কবরের জায়গার সংকট রয়েছে। তবে সিটি কর্পোরেশনের আওতায় যেসব নতুন ওয়ার্ড আছে সেগুলোতে উন্নয়ন কাজের সময় নির্দিষ্ট নির্দিষ্ট জায়গায় যদি কবরস্থানের জন্য জায়গা রাখা হয় তাহলে এই সংকট কিছুটা হলেও কমে আসবে।