শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামালসহ সামগ্রিক পণ্য আমদানি প্রতি মাসে ৮৫০ কোটি ডলারে উঠেছিল। কিন্তু দুই বছরের ব্যবধানে সেই পণ্য আমদানি এখন ৫০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে গেছে। পণ্য আমদানি ভয়াবহ আকারে কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ ডলার সঙ্কট। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ডলার সঙ্কটের কারণে তারা কাক্সিক্ষত হারে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ কাঁচামাল আমদানি করতে পারছেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চাহিদার এক-তৃতীয়াংশও এলসি খোলা যাচ্ছে না। কাক্সিক্ষত হারে এলসি খুলতে না পারায় শিল্পের উৎপাদন অনেক ক্ষেত্রেই অর্ধেকে নেমে গেছে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় এক দিকে স্থানীয় বাজারে এর প্রভাব পড়ছে, তেমনি প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। লোকসানের ধকল কাটাতে না পেরে অনেক প্রতিষ্ঠান থেকেই শ্রমিক ছাঁটাই করতে হচ্ছে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় কমে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে ব্যাংকের ওপর। ব্যাংক বিনিয়োগ নিয়ে গড়ে উঠা শিল্প কারখানাগুলো থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা যাচ্ছে না। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান নতুনভাবে পণ্য আমদানি করতে পারছে না। একপর্যায়ে তারা রুগ্ণ শিল্পের কাতারে শামিল হচ্ছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা মো: আজিজুল ইসলাম এ বিষয়ে গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, পণ্য আমদানি কমলে শিল্পের উৎপাদন কমে যায়। আর শিল্পের উৎপাদন কমলে পণ্য সরবরাহ কমে যায়। এতে বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতি। অপর দিকে পণ্য আমদানি বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ পণ্যের কাঁচামাল আমদানি কমলে নতুন নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন হয় না। অপর দিকে বিদ্যমান শিল্পকারখানার উৎপাদন কমে যায়। এতে দুই ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। একটি হলো আমাদের শ্রম বাজারে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে। বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য বর্ধিত কর্মসংস্থানের প্রয়োজন হয়। সেখানে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে না উঠলে বর্ধিত হারে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয় না। উপরন্তু বিদ্যমান শিল্পকারখানার উৎপাদন কমে গেলে মালিকরা শ্রমিক ছাঁটাই করতে থাকে। সবমিলেই কর্মসংস্থানের জায়গা কমে যায়। এতে বেড়ে যায় বেকারত্বের হার। তিনি মনে করেন, যে হারে পণ্য আমদানি কমছে, তা অব্যহাত থাকলে সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে মোটেও সন্তোষজনক ফল বয়ে আনবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ৮৪৩ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছিল। পণ্য আমদানির প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২০২০ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় প্রায় ৫৭ শতাংশ। ঠিক এক বছর পর অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ৬০৪ কোটি ২৯ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়। এতে দেখা যায়, ওই বছরের ডিসেম্বরে পণ্য আমদানির প্রবৃদ্ধি হয় ঋণাত্মক ২৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরে পণ্য আমদানি কমে যায় ৮৫ শতাংশের ওপরে। পণ্য আমদানির এ ধারাবাহিকতার দিকে তাকালে দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বরে তা আরো কমে হয় ৪৮৫ কোটি ডলার। প্রবৃদ্ধি হয় ঋণাত্মক ১৩.১৮ শতাংশ। অর্থাৎ দুই বছরের ব্যবধানে পণ্য আমদানি কমে যায় প্রায় ১০০ শতাংশ।
খাতভিত্তিক পণ্য আমদানির চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কর্মসংস্থানের সাথে সরাসরি জড়িত শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির প্রবৃদ্ধি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) হয়েছিল সাড়ে ৬৭ শতাংশ, আর শিল্পের কাঁচামাল আমদানির প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬০ দশমিক ৩১ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির প্রবৃদ্ধি হয় ঋণাত্মক ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানির প্রবৃদ্ধি হয় ঋণাত্মক ১৭.০২ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানির প্রবৃদ্ধি হয় ঋণাত্মক ২৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং কাঁচামাল আমদানির প্রবৃদ্ধি হয় ১০.০৯ শতাংশ।
শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামালসহ সামগ্রিক আমদানি ধারাবাহিকভাবে কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে ডলার সঙ্কটকে মনে করছেন ব্যাংকাররা। তারা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা জিএফআইসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে প্রতি বছরই দেশ থেকে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের তথ্য দিয়ে থাকে। পাশাপাশি রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কাক্সিক্ষত হারে আসছে না।
কিন্তু ব্যয় দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার (বিএফআইইউ) এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশ থেকে অর্থ পাচার কোনোভাবেই থামছে না, বরং দিন দিন তা বেড়েই চলছে। বেশিরভাগ অর্থ পাচার হচ্ছে আমদানি-রফতানির আড়ালে। সংস্থাটি বলেছে, দেশ থেকে অর্থপাচারের ৮০-৮৫ শতাংশই হচ্ছে আমদানি-রফতানির আড়ালে। ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে ‘আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসের’ মাধ্যমে এসব অর্থপাচার হয়। সবমিলেই সামগ্রিক ডলার সঙ্কট বেড়ে গেছে। ডলার সঙ্কটের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল প্রায় ৪৬ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে হয় ৩৫.৪৪ বিলিয়ন ডলার, চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি তা আরো কমে হয় ২৫.৩২ বিলিয়ন ডলার। তবে, আন্তর্জাতিক হিসেব পদ্ধতিতে (বিপিএম-৬) অনুযায়ী ওই দিন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২০.১৯ বিলিয়ন ডলার। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৫ বিলিয়নের ঘরে নেমে গেছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, আগে ডলার সঙ্কট মেটানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করত। কিন্তু এখন আর কোনো সহযোগিতা করা হয় না। এর ফলে ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। এতে এক দিকে তাদের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে আয়। ফলে তারা ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না। বাধ্য হয়ে অনেকেই শ্রমিক ছাঁটাই করছে। অপর দিকে ব্যাংকের অর্থ ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছে না। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। সবমিলেই সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।