ডলার সঙ্কটে অস্থিরতা

Slider অর্থ ও বাণিজ্য


জরুরি প্রয়োজনে পণ্য আমদানিতে ডলার সংগ্রহ করতে বিপাকে পড়ে গেছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে ১২৮ টাকা দরে। অথচ ডলারের সর্বোচ্চ দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১১০ টাকা। বাড়তি দরে ডলার কিনে পণ্য আমদানি করতে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। আর এ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের মূল্যও বেড়ে যাচ্ছে। এতে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তারও মুনাফার হার কমে যাচ্ছে।

কথাগুলো বলেছেন একজন ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা। বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডলারের সর্বোচ্চ দাম ১১০ টাকা রাখা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এ দরে কোথাও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ক্ষেত্রবিশেষে প্রতি ডলারে ১২০ টাকা থেকে ১৩০ টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করতে হচ্ছে। আর এর কারণ হিসেবে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে রেমিট্যান্স আহরণ করতে তাদের ১১৮ থেকে ১২৬ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হচ্ছে। আর বাড়তি দামে ডলার আহরণ করে বাড়তি দামে বিক্রি না করলে ব্যাংক লোকসানের মুখে পড়বে। এ লোকসানের ভাগীদার কে হবেন। এ কারণেই ডলারের বাজারে অস্থিরতা কাটছে না।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আহরণে সর্বোচ্চ দর বেঁধে দিয়েছিল ব্যাংকারদের শীর্ষ সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) এবং বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা)। বলা হয়েছিল রেমিট্যান্স আহরণে ব্যাংকগুলো ডলারের সর্বোচ্চ দাম ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা দেবে। এর বাইরে ব্যাংকগুলো নিজস্ব তহবিল থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা দিতে পারে। সে হিসেবে ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সের ডলারে দাম সর্বোচ্চ ১১২ টাকা ২৪ পয়সা পর্যন্ত দিতে পারে। কিন্তু এ দর বেশির ভাগ ব্যাংকই মানছে না। ক্ষেত্রবিশেষে রেমিট্যান্স আহরণে ১১৮ টাকা থেকে ১২৬ টাকা পর্যন্ত দরে রেমিট্যান্স আহরণ করেছে। আর এ কারণেই গত ডিসেম্বের শেষে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯৯ কোটি ডলার, যা আগের মাসে অর্থাৎ নভেম্বরে এসেছিল ১৯৩ কোটি ডলার। আর এ সুবাদে ছয় মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে ২ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে শৃঙ্খলা আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় এবিবি ও বাফেদা ডলারের দর নির্ধারণ করে দেয়। এক্ষেত্রে যেসব ব্যাংক তাদের সিদ্ধান্ত অমান্য করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংগঠন দু’টি থেকে একাধিকবার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অনুরোধ করা হয়। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দরে রেমিট্যান্স আহরণ করার দায়ে ১০টি ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কঠোর অবস্থানের কারণে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এতে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যায়। এতে কমে যায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ডলারের জন্য ব্যাংকগুলোতে হাহাকার পড়ে যায়। অনেক ব্যাংক বকেয়া এলসির দায় পরিশোধ করতে না পারায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দ্বারস্থ হয়। কিন্তু রিজার্ভ কমে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেসরকারি কোনো ব্যাংকের সহযোগিতা করেনি বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন। বাধ্য হয়ে এবিবি ও বাফেদার সিদ্ধান্ত অমান্য করে বেশি দামে রেমিট্যান্স আহরণ করে বেশির ভাগ ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেকটা দেখেও না দেখার ভান করে থাকে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কেউ কম দামে রেমিট্যান্স আহরণ করছে, আবার কেউ বেশি দরে রেমিট্যান্স আহরণ করছে। যারা বেশি দরে রেমিট্যান্স আহরণ করছে তারা আবার বেশি দরে গ্রাহকের কাছে বেশি দরে ডলার বিক্রি করছে। আবার যারা কম দরে রেমিট্যান্স আহরণ করছে তারা কম দরে ডলার বিক্রি করছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল হওয়ার পরিবর্তে মূলত বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। এতে একদিকে পণ্যের আমদানি ব্যয় বাড়ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে মূল্যস্ফীতি। অপরদিকে, নিয়ম পরিপালন করতে গিয়ে কিছু ব্যাংক বেকায়দায় পড়ে গেছে। তারা রেমিট্যান্স আহরণে পিছিয়ে পড়ায় ডলার সঙ্কটে পড়েছে। গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী ডলার সরবরাহ করতে পারছেন না। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান ভুক্তভোগী ব্যাংকাররা।

এদিকে, ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার চালুর বিষয়ে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি (একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকে ডলারের দাম ওঠানামা) সম্পর্কে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে আপাতত এই পদ্ধতি চালু করা হবে। আইএমএফের চাপ থাকা সত্ত্বেও এখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের বিপরীতে টাকার বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করবে না। গত বুধবার বিকেলে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈঠকে এ বার্তা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বাফেদার চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আফজাল করিমের নেতৃত্বে সংগঠনের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে বলা হয়, ডলারের দাম কোনোভাবেই অস্থিতিশীল হতে দেয়া যাবে না। স্থিতিশীল রাখতেই ক্রলিং পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে ডলারের দাম একটি সীমার মধ্যে থেকে ওঠানামা করবে। ডলারের দাম বৃদ্ধির ঊর্ধ্বসীমা থাকবে, একই সাথে কমারও সীমা থাকবে। এ দু’টি সীমা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বাফেদা থেকে বেঁধে দেয়া হবে। ওই সীমার মধ্যে থেকেই চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে ডলারের দাম ওঠানামা করবে। ওই সীমার বাইরে যেতে পারবে না। প্রতি সপ্তাহে এই সীমা সামান্য পরিমাণে বাড়তে বা কমতে পারে। ফলে বাজারের সাথে সমন্বয় রেখে এর দামও ওঠানামা করবে। এ পদ্ধতি ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়েসহ আরো কিছু দেশে চালু করা হয়েছে। আইএমএফের কাছেও এ ব্যাপারে ভালো তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। ওইসব উৎস থেকে ব্যাংকগুলোকে তথ্য সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরকে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।

বৈঠকে বলা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম ১১০ টাকার মধ্যেই রাখতে চায়। তবে চাহিদা বেশি হলে কিছুটা বাড়তে দিতে পারে। আবার চাহিদা কমলে এর দামও কমাতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগাম হিসাব অনুযায়ী, আগামীতে ডলারের সরবরাহ বাড়বে। এদিকে চাহিদা ধীরে ধীরে কমে আসছে। স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের চাপ কমে আসছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *