বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সশস্ত্র বাহিনীসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হলেও দেশ জুড়ে নানা সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
এর মধ্যেই শুক্রবার রাতে ঢাকায় ট্রেনে আগুন দেয়া ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে ভোটকেন্দ্রে হামলাসহ বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো বলছে ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচনি প্রচার শুরুর পর থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৮ দিনে ১৫৬টি জায়গায় নির্বাচনি সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। আর এতে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের।
এদিকে শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শনিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত সারা দেশে পরিবহন ও বিদ্যালয়ে ১৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে ফায়ার সার্ভিস এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে।
যদিও এবারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে সশস্ত্র বাহিনীর ৪০ হাজারের বেশি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। পাশাপাশি কাজ শুরু করেছে বিজিবি, র্যাব ও পুলিশসহ সবগুলো বাহিনীর সদস্যরাই।
অন্যদিকে ঢাকায় শুক্রবার মধ্যরাত থেকে মোটরসাইকেল এবং শনিবার মধ্যরাত থেকে আরো কিছু যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পুলিশ।
এরপরেও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কেউ নাশকতার চেষ্টা করলে তার ফল ভালো হবে না বলে সতর্ক করেছে পুলিশের আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
নাশকতা বিষয়ে তথ্য দেয়ার জন্য ২০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে।
ব্যালট পেপার বাদে অন্যান্য নির্বাচনি সরঞ্জাম শনিবার সকাল ১১টা থেকে কেন্দ্রে সরবরাহ শুরু হয়েছে। ব্যালট পেপার যাবে রোববার সকালে।
উল্লেখ্য, ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন ও অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে শনিবার সকাল ৬টা থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টার হরতাল পালন করছে বিএনপি।
ফলে একদিকে হরতাল, অন্যদিকে কর্তৃপক্ষের নানা বিধিনিষেধ দুই মিলিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশেই অত্যন্ত সীমিত যানবাহন চলাচল দেখা গেছে।
সারাদেশে সহিংসতা
শুক্রবার রাতে ঢাকায় ট্রেনে আগুনের ঘটনায় চারজন মারা গেছে। আহত হয়েছে অন্তত আটজন। এ ঘটনায় পুলিশ কয়েক জনকে আটক করেছে।
এছাড়া পিরোজপুরে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতায় একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
যদিও পিরোজপুরের রিটার্নিং অফিসার মো: জাহেদুর রহমান বলছে পারিবারিক বিরোধে ওই ব্যক্তি মারা গেছেন।
একইসাথে নৌকার নির্বাচনী ক্যাম্পে মোটরসাইকেল বহর নিয়ে হামলার ঘটনায় মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিক নাসির উদ্দিন উজ্জ্বল।
এছাড়া চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, পটিয়া ও আগ্রাবাদে ক্যাম্প ভাংচুর ও হামলার ঘটনা ঘটেছে।
চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে এবং এ ঘটনায় থানায় জিডি হওয়ার কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার শাকিলা সোলতানা।
এর বাইরে ফেনী, রাজশাহী ও নোয়াখালীতে ভোট কেন্দ্র ও কিছু প্রার্থীর ক্যাম্প পুড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কক্সবাজারের রামুতে একটি বৌদ্ধ মন্দিরের কাঠের সিড়িতে শুক্রবার রাতে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে এর সাথে নির্বাচনের কোন যোগসূত্র আছে কিনা, তা নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ।
ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র ও নিরাপত্তার যত আয়োজন
আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন শুক্রবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং কেউ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করলে তারা কঠোর ব্যবস্থা নেবেন।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে রোববারের ভোটের জন্য সারাদেশে মোট ভোটকেন্দ্র ৪২ হাজার ২৪টি।
এর মধ্যে ২৩ হাজার ১৩৩টি কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করে এসব কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাড়তি ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে কমিশন।
মূলত প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, র্যাব, পুলিশ, আর্মড পুলিশ ও আনসার ব্যাটালিয়নের সদস্যরা মোবাইল টিম ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করতে শুরু করেছে গত ২৯ ডিসেম্বর থেকেই।
এছাড়া নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনসহ সহিংসতা রোধে প্রতিটি এলাকায় পর্যাপ্ত সংখ্যক জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোতায়েন করেছে কমিশন।
কমিশনের তথ্য অনুযায়ী মোবাইল কোর্ট আইনের আওতায় প্রতিটি উপজেলা ও জেলা সদরের পৌরসভায় একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করছেন।
এর বাইরে ঢাকায় ২৬ জন, চট্টগ্রামে ১০, খুলনায় ৬, গাজীপুরে ৪ ও অন্য সিটিতে তিনজন করে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়েছে।
পাশাপাশি ৫-৯ জানুয়ারি ৩০০ আসনে ৬৫৩ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করছেন, যারা নির্বাচন উপলক্ষে সংঘটিত অপরাধসমূহ আমলে নেয়া ও তা সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে বিচার সম্পন্ন করবেন।
ভোটগ্রহণের দিন ছাড়াও এর আগের ও পরের দুই দিন করে এসব ম্যাজিস্ট্রেটরা কাজ করবেন, যার মূল উদ্দেশ্যে হলো ভোটকে কেন্দ্র করে কোন ধরনের সহিংসতা যেন না হতে পারে।
আর ভোটের দিনে মেট্রোপলিটন এলাকায় প্রতিটি ভোটকেন্দ্র অস্ত্রসহ তিনজন পুলিশ ও ১২ জন আনসার কাজ করবেন।
আর এর বাইরের এলাকায় প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে অস্ত্রসহ দু’জন পুলিশ ও ১২ জন আনসার সদস্য কাজ করবেন। তবে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোকে একজন করে সশস্ত্র পুলিশ বেশী থাকবে।
মেজর জেনারেল একেএম আমিনুল হক বলেছেন আনসার ব্যাটালিয়ন এর একটি করে স্ট্রাইকিং টিম নির্বাচনী পরিবেশ অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ রাখতে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার পরিকল্পনা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করছে।
মোবাইল টিম ও স্ট্রাইকিং ফোর্স
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে এবার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে ৩৮ হাজার ১৫৪ জন সেনা সদস্য এবং ২ হাজার ৮২৭ নৌ বাহিনী সদস্য নিয়োজিত থাকছে যারা একজন ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে তাদের দায়িত্ব পালন করবে।
সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য গত ৩ জানুয়ারিই নির্বাচনি এলাকাগুলোতে পৌঁছে গেছে।
এছাড়াও বিজিবি বা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের ৪৪ হাজার ১৯২ জন, কোস্টগার্ডের ২ হাজার ৩৫৫ জন, র্যাবের ৬০০ টিম, পুলিশের ১ লাখ ৭৪ হাজার ৭৬৭জন ও আনসার ব্যাটালিয়নের মোট ৫ লাখ ১৪ হাজার ২৮৮ জন ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকাগুলোতে দায়িত্ব পালন করবে।
এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বা ডিএমপি নির্বাচন ঘিরে কিছু যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, যা শনিবার থেকে কার্যকর হয়েছে।
ডিএমপির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে শুক্রবার রাত থেকে সোমবার রাত পর্যন্ত মোটর সাইকেল চলাচল বন্ধ থাকবে।
পাশাপাশি শনিবার মধ্যরাত থেকে রোববার মধ্যরাত পর্যন্ত ট্যাক্সি ক্যাব, পিকআপ, মাইক্রোবাস ও ট্রাক চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকবে।
তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, প্রশাসন ও অনুমতিপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক ছাড়াও জরুরি সেবা কাজে নিয়োজিত যানবাহন যেমন ওষুধ, স্বাস্থ্য-চিকিৎসা এবং এ ধরনের কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি ও সংবাদপত্র বহনকারী সব ধরনের যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা শিথিল থাকবে।
নির্বাচন কমিশন আগেই জানিয়েছে যে স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’-এর আওতায় সশস্ত্র বাহিনী নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবে।
অর্থাৎ রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের সাথে পরামর্শ করে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা।
মূলত তারা নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন নোডাল পয়েন্টে অবস্থান করবে। কোনো সঙ্কটের ক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে সাথে নিয়ে তারা ঘটনাস্থলে যাবে।
সূত্র : বিবিসি