‘একতরফা’ নির্বাচন বর্জনে ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানানোর পাশাপাশি ভোট ঠেকানোর সর্বাত্মক আন্দোলনে যাচ্ছে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলো। নির্বাচনের দিনসহ এর আগের দুই সপ্তাহকে এজন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। জানা গেছে, এই দুই সপ্তাহ সর্বোচ্চ সাংগঠনিক শক্তি প্রয়োগ করে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এই সময়ে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি শক্তভাবে পালনের পাশাপাশি ভোটারদের এবং ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িতদের বিতর্কিত নির্বাচনের সহযোগী না হওয়ার আহ্বান জানানো হবে।
আন্দোলনের কর্মসূচি প্রণয়নের সাথে জড়িত বিএনপির নেতারা জানিয়েছেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে কার্যত নৌকা ছাড়া আর কোনো মার্কা নেই। অন্য যারা নির্বাচনে আছে, তারা মূলত আওয়ামী লীগের সহযোগী কিংবা ডামি প্রার্থী। সরকারি দল ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে যে কৌশল নিয়েছে, সেটি কোনো কাজে আসবে না।
বিরোধী দলগুলোর সূত্রে জানা গেছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় একদফার আন্দোলন আরো জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি ও যুগপতে থাকা মিত্ররা। এর অংশ হিসেবে চলমান হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি কঠোরভাবে পালন করা হবে। এর পাশাপাশি ভোট বর্জনের ক্যাম্পেইন বাড়ানো হবে।
নেতারা মনে করছেন, জনগণ ভোট প্রত্যাখ্যান করা মানে নির্বাচন অনুষ্ঠানে অসহযোগিতা করা। বিএনপির হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে ভোটারদের উদ্দেশে আজ বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট প্রত্যাখ্যানের এই আহ্বান জানানো হতে পারে। ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে তখন দেশবাসীকে অফিস-আদালতে না যাওয়া, যান চলাচল বন্ধ রাখা, কল-কারখানা বন্ধ রাখা তথা সরকারকে সর্বোতভাবে অসহযোগিতা করার আহ্বান জানাতে পারে বিরোধী দলগুলো।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন বয়কট করে একদফার আন্দোলনে থাকা দলটির এখন মূল টার্গেট ভোট ঠেকানো। এ লক্ষ্য অর্জনে এবার সর্বাত্মক আন্দোলনে যাচ্ছে দলটি। দলের হাইকমান্ড ইতোমধ্যে সংগঠনের সর্বস্তরে আগামী ১৫ দিনের কর্মসূচি পালনে কোনো শিথিলতা না দেখানোর নির্দেশনা দিয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার দেশজুড়ে হরতাল পালনের পর নতুন কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা চলছে। জানা গেছে, হরতাল-অবরোধের পাশাপাশি নির্বাচনের আগে ঢাকায় একটি বড় সমাবেশ করা যায় কি না তা নিয়ে নেতারা আলোচনা করছেন।
জানা গেছে, বিএনপি ‘একতরফা’ ভোট প্রত্যাখ্যানে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে জনসংযোগের কর্মসূচিও দেবে। জনগণকে ভোটদানে নিরুৎসাহিত করতে ব্যাপক ক্যাম্পেইন চালানোর ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে দেশবাসীকে ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে প্রচারপত্র তৈরি করা হচ্ছে। দুই পাতার প্রচারপত্রে একপাতায় বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি এবং অপর পাতায় আসন্ন নির্বাচনকে একতরফা, ডামি নির্বাচন হিসেবে উল্লেখ করে কেন এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করবেন- সে বিষয়গুলো তুলে ধরা হচ্ছে। আগামী শুক্র অথবা শনিবার থেকে এই প্রচারপত্র বিতরণের কাজ শুরু হতে পারে। দ্বাদশ সংসদের ভোটের দিন ৭ জানুয়ারির আগ পর্যন্ত হরতাল-অবরোধের ফাঁকে ফাঁকে সারা দেশে ভোটবিরোধী এই প্রচারপত্র বিলি করা হবে। জানা গেছে, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চসহ অন্যান্য জোট ও দল পৃথক প্রচারপত্র বিলি করবে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ‘প্রহসনের নির্বাচন বর্জন কর, দুঃশাসন হটাও’ আহ্বান সংবলিত প্রচারপত্র তৈরি করে বিলি শুরু করেছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম ইতোমধ্যে একাধিক কর্মসূচি থেকে বর্তমান সরকারের অধীনে ‘একতরফা’ নির্বাচনে অংশ না নিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের ধারণা-বর্তমানে দৃশ্যমান তৎপরতা না থাকলেও বাংলাদেশে একটি অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চাওয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব মোটেও সরেনি। তাই তাদের এখন চেষ্টা হচ্ছে, আসন্ন নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। আর ভোটাররা বর্জন করলেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। একই সাথে ভোটকেন্দ্রে না গেলে বিএনপিবিহীন নির্বাচনের প্রতি ভোটারদের চূড়ান্ত অনাস্থার বিষয়টিও প্রতীয়মান হবে। সেক্ষেত্রে পশ্চিমাসহ আন্তর্জাতিক বিশ্বে নির্বাচন আরো বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এমনটা হলে নির্বাচন করতে পারলেও আওয়ামী লীগের জন্য সরকারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, দেশের দু’টি বড় রাজনৈতিক দলের একটি বিএনপি। সারা দেশে তাদের ব্যাপক জনসমর্থন এবং অসংখ্য নেতাকর্মী-সমর্থক রয়েছেন। তৃণমূলে ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত কর্মী-সমর্থক রয়েছে। দলের সিদ্ধান্তে তারা একতরফা নির্বাচন বয়কট করবে। এখন অন্য দল ও নিরপেক্ষ ভোটারদের ৭ জানুয়ারি ভোটকেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত করা হবে।
জানা গেছে, জনগণকে ভোটদানে নিরুৎসাহিত করতে প্রচারের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি ও মিত্ররা। তাদের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ভোটারদের ভোট বর্জনের আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ছাড়া আগামীতে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, পথসভা, উঠান বৈঠক, পোস্টার, লিফলেট বিতরণের মধ্য দিয়ে জনমতকে সংগঠিত করার পরিকল্পনা করছে দলটি। এ কাজে সারা দেশের জেলা, উপজেলা ও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ত করা হবে। এসব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জনগণকে অব্যাহতভাবে ভোট বর্জনের আহ্বান জানানো হবে। এ ছাড়া এ কাজে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেও ব্যবহার করা হবে, দেয়া হতে পারে একক ও যৌথ বিবৃতি। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞায় সভা-সমাবেশ করতে না পারলে সেক্ষেত্রে ভোট বর্জনে জনগণকে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির পক্ষে থাকার আহ্বান জানানো হতে পারে।
যুগপৎ আন্দোলনের সাথে যুক্ত গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আগামী ৭ জানুয়ারি যে একতরফা, ভাগবাটোয়ার নির্বাচনের আয়োজন চলছে- এরই মধ্যে জনগণের বিপুল অংশ সেটাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমরা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান ও বর্জনের ডাকটা অব্যাহত রাখব। এক দিকে যেমন হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি থাকবে, পাশাপাশি দেশের প্রতিটি ঘরে এই প্রত্যাখ্যানের ডাকটা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করব। এক্ষেত্রে আমরা প্রচারপত্রসহ বিভিন্ন প্রচার উপকরণ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করব। এর পাশাপাশি সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং, পথসভা, উঠান বৈঠক, খণ্ড মিছিলের মতো জনসম্পৃক্ত কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ভোটে না গিয়ে তা চূড়ান্ত বর্জনের জন্য জনগণের কাছে আহ্বান জানানো হবে। সহিংসতা-উসকানিতে পা না দিয়ে যথাসম্ভব শান্তিপূর্ণ পথে আমরা এই তৎপরতা অব্যাহত রাখতে চাই।
তিনি বলেন, মানুষ ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে, ভোট প্রত্যাখ্যান-বর্জন করার মধ্য দিয়েও নির্বাচনের প্রতি তাদের অসহযোগিতা ব্যক্ত করতে পারে। অসহযোগিতার ক্ষেত্র-পরিধি আরো বিস্তৃত হবে কিনা, মাত্রা ও গভীরতা কেমন হবে সেটা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে।
সাইফুল হক বলেন, গত ১৫ বছর ধরে আমরা মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ দেখছি। ভোটের অধিকার নিয়ে যেভাবে নয়-ছয় করা হচ্ছে, যেভাবে আরেকটা নির্বাচন নামক তামাশা মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছে- এমন পরিস্থিতিতে রাজপথে মানুষের গণবিস্ফোরণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে কখন এটা হবে তা এখনই বলতে পারছি না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এটা ঘটবে।
গত সোমবার প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন প্রার্থীরা। এখান থেকে ভোট পর্যন্ত সময়কে চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য ‘মোক্ষম সময়’ হিসেবে বিবেচনা করছে বিএনপি ও শরিকরা। জানা গেছে, আগামীকাল বৃহস্পতিবার আবারো হরতাল-অবরোধের কর্মসূচির ঘোষণা আসতে পারে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে ফের ক্ষমতায় থাকতে একটি একতরফা, পাতানো, ডামি নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা জনগণকে এই নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়েছি। তারা ইতোমধ্যে একতরফা তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে। আমাদের প্রত্যাশা, গণতন্ত্রের স্বার্থে চূড়ান্তভাবে তারা ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন করবে, জনগণ ভোটকেন্দ্রে যাবে না।