ড. আবদুল লতিফ মাসুম
দুর্ভিক্ষ বা আকাল হলো কোনো এলাকায় ব্যাপক খাদ্যঘাটতি। এর অপর নাম মন্বন্তর। শুধু খাদ্য ঘাটতিই নয়, দুর্ভিক্ষ একটি সামগ্রিক অবস্থা। এ অবস্থায় শাসনব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে। সামাজিক বন্ধন হয় শিথিল। যোগাযোগ ব্যবস্থা হয় বিপর্যস্ত। খাদ্যসামগ্রী বিপণনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। পরিবহনব্যবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছে। আর এসবের মূলে থাকে সরকারের ব্যর্থতা। সাধারণত ফসলহানি, যুদ্ধ, ষড়যন্ত্র ও একচেটিয়া পুঁজির কারসাজিতে দুর্ভিক্ষ হয়। একটি দায়িত্বশীল সরকারের অদক্ষতা, অযোগ্যতা ও অপরাধপ্রবণতা দুর্ভিক্ষের কারণ হতে পারে। অনেক সময় দল বা গোষ্ঠীর অর্থলোলুপতা ও দুর্নীতি সরকারের নীতিগত ব্যর্থতা, ইত্যাদি কারণে দুর্ভিক্ষ হয়। ধনিক ও বণিক শ্রেণীর বাজারে একক নিয়ন্ত্রণ দুর্ভিক্ষ অবস্থাকে বিস্তৃত করে।
এ ধরনের অবস্থা বোঝানোর জন্য সিন্ডিকেট, লুম্পেন বুর্জোয়া ও মাফিয়া বলা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এ ধরনের দল বা গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করার জন্য যে টার্মটি জুুতসই মনে করা হয় তা হচ্ছে- ‘দুঃশাসনের দুষ্টচক্র’ ‘The Vicious Circle of Oligarchy’. পৃথিবীর ইতিহাসে সংঘটিত দুর্ভিক্ষ বা মন্বন্তরের কারণ যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তা আকাল বা খাদ্যঘাটতির চেয়ে সরকার বা কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর দুর্নীতি ও দুঃশাসনকে দায়ী করা হয়। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, গবাদিপশুর মড়ক, পোকার আক্রমণ, ইত্যাদি কারণেও দুর্ভিক্ষ হয়। আজকের যুগে এসব কারণের প্রতিকার ও প্রতিবিধান সম্ভব। কিন্তু সরকার যদি গণমুখী না হয়, কেবল তাঁবেদার হয় শোষকগোষ্ঠীর, তাহলে দুর্ভিক্ষ বা মন্বন্তর অনিবার্য হয়ে ওঠে।
গাঙ্গেয় বদ্বীপ বাংলাদেশ প্রাচীনকাল থেকেই সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা অভিধায় অভিষিক্ত। কিন্তু এখানেও দুর্ভিক্ষ হয়েছে অনেকবার, যেমন- ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১৭৭০), পঞ্চাশের মন্বন্তর (১৯৪৩), ১৯৭৪ সালের কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। আমাদের স্মৃতিতে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ আজো বেদনায়ক। সত্তরের দশকের শুরুতে বিশ্বব্যাপী খাদ্যঘাটতি দেখা দেয়। তবে বাংলাদেশে অন্যান্য দেশের মতো খাদ্যঘাটতি মুখ্য ছিল না, তখন দেশটি স্বাধীনতা লাভের ঐতিহাসিক রূপান্তর পর্যায় অতিক্রম করছিল। ওই দুর্ভিক্ষের মুখ্য কারণ দুর্বল খাদ্যবণ্টন ব্যবস্থাপনা। ১৯৭১ সালের পর, প্রধানত মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিধ্বস্ত অর্থনীতি ও সামাজিক বিপর্যয়ের কারণে, দেশের ব্যাপক সংখ্যক মানুষের জীবনযাত্রার মান নিচে নেমে যায়। জাতিসঙ্ঘের তথ্য মতে- কৃষি, অন্যান্য স্থাবর সম্পদ (বিশেষত পরিবহন খাত), পুনর্বাসনের হিসাবসহ বস্তুগত ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১.২ বিলিয়ন ডলার।
ভারত থেকে প্রত্যাগত শরণার্থী ও অন্যান্য ভাসমান মানুষদের ইতোমধ্যে পুনর্বাসিত করা হলেও, সাধারণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পিছিয়ে পড়ে। প্রকৃত আয় ও কর্মসংস্থানের অধোগতি অব্যাহত থাকে। এ চরম অবস্থার শিকার হয়েছিলেন শিল্পশ্রমিক, ক্ষুদ্র কৃষক, কৃষিশ্রমিক ও নিম্ন বেতনভুক মানুষ। এ সময়ও আজকের মতো ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। এখন যেমন, তখনো তেমন। কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগের লোকেরা লুটপাটে মেতে ওঠে। তাদের দুর্নীতি ও চুরির কারণে পুরো উৎপাদনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। খাদ্যশস্য মজুদ, সরকারি খাদ্য সংগ্রহে ব্যর্থতা ও ধান-চাল-পাটের গুদামে আগুন, অর্থাৎ- প্রকারান্তরে খাদ্যশস্য নিঃশেষ হয়ে যায়। ব্যবসায়-বাণিজ্য ও আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে একদল আকস্মিক লাইসেন্স পারমিটধারীর আবির্ভাব হয়। প্রকৃত ব্যবসায়বিমুখ এসব কৃত্রিম ব্যবসায়ীর তখন নাম দেয়া হয় ‘ব্রিফকেস বিজনেসম্যান’। তারা শুধুই লাইসেন্স পারমিট বিক্রি করে ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দুরবস্থার সৃষ্টি করেন। আরেক দল লোক চোরাকারবারি করে দেশের খাদ্যশস্য প্রতিবেশী দেশে পাচার করে। সে সময় এদেরও উপনাম দেয়া হয় ‘ম্যানছেরু মিয়া’।
ছেরু মিয়া নামধারী রাজনৈতিক চোরাকারবারিরা বন্দরে, সমুদ্রে ও সীমান্তে দেশের সম্পদ অপর দেশে পৌঁছে দিয়ে নিজেদের ভাগ্য বদল করে। এসব কারণে জানুয়ারি ১৯৭৪-এ দেখা দেয় অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা। বছরের মধ্যভাগে কিছু লঙ্গরখানা চালু করে অন্নহীন মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়। ওই বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ অবস্থা চরমে পৌঁছে। রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট জেলা সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উল্লেখ্য, ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষেও ওই জেলাগুলোই মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছিল। ১৯৭৪-এর জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত স্থায়ী ওই দুর্ভিক্ষের চিত্র ছিল ১৮৬৬, ১৯৪৩ ও ১৯৭০-এর দুর্ভিক্ষের মতোই ভয়াবহ। খাদ্যের সন্ধানে গ্রামের মানুষজন শহরে ভিড় জমায়, বহু পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং গ্রাম থেকে মূলোৎপাটিত হয়। ব্যাপক সংখ্যক মানুষ তাদের ভিটেমাটি ও সর্বস্ব বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। বিপদগ্রস্ত মানুষের জমি বিক্রয় ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা। এ দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় সরকারি ব্যবস্থাপনা তেমন কার্যকর ছিল না। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে সাহায্য পাঠানোর অনুরোধ করতে সরকার বিলম্ব করে। ১৯৭৩-এর তেল সঙ্কটের কারণে বৈদেশিক মুদ্রায় ঘাটতি দেখা দেয়ায় সরকারের পক্ষে খাদ্য আমদানি দুষ্কর হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে চালের অস্বাভাবিক উচ্চমূল্য, স্বল্পমেয়াদি ঋণ সংগ্রহে সমস্যা ওই দুর্ভিক্ষ মোকাবেলার কাজ আরো জটিল করে তোলে।
১৯৭৪ সালের সেই দুঃসহ স্মৃতি মনে করিয়ে দিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা গত ৮ ডিসেম্বর সকালে নিজ নির্বাচনী এলাকা কোটালিপাড়ায় এ দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা বলেন। ফেসবুক লাইভে তার এ বক্তব্য প্রচারিত হয়। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ‘বিএনপি আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চের দিকে দেশের এমন অবস্থা করবে যাতে দুর্ভিক্ষ হয়। এতে বিদেশী প্ররোচনাও আছে।’ বিএনপি যাতে জ্বালাও-পোড়াও করতে না পারে, সে জন্য আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের তিনি সজাগ থাকতে বলেন। তিনি আরো বলেন, ‘তারা (বিএনপি) এত দিন বলেছে, নির্বাচন হতে দেবে না। এখন যখন মনে করছে নির্বাচন হয়ে যাবে; তাহলে কী করা যাবে? আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের দিকে বাংলাদেশে এমন অবস্থা করবে, দুর্ভিক্ষ ঘটাবে। এটি হচ্ছে তাদের পরবর্তী পরিকল্পনা। এটি শুধু দেশের না, বিদেশী প্ররোচনাও আছে। যেভাবেই হোক দুর্ভিক্ষ ঘটাতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা কাদের হাতে পড়েছি। তারা এতদিন বলেছে, ইলেকশন হতে দেবে না। … শিডিউল ঘোষণা করতে পারবে না। আমরা শিডিউল ঘোষণা করলাম। এখন বলছে, ইলেকশনের দিন ভোটাররা যাতে যেতে না পারে।’
তিনি বলেন, ‘ভোটারদের অধিকার কেড়ে নেয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। তারা জ্বালাও-পোড়াও করতে পারে। তার জন্য প্রতিটি এলাকার সব কর্মীকে সজাগ থাকতে হবে। যারা আগুন দিতে যাবে তাদেরকে ধরে পুলিশে দিতে হবে।’ উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীর দুর্ভিক্ষের খোয়াব নতুন নয়। ২০২২ সালের ১৪ অক্টোবর বিবিসি বাংলা নিউজে প্রচারিত প্রতিবেদনে বলা হয়- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছেন। দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে তিনি বৈশ্বিক পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় প্রস্তুতি নেয়ার কথাও বলেন। এর আগে সেনাবাহিনীর এক অনুষ্ঠানে দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গটি আবারো উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ যাতে দুর্ভিক্ষের শিকার না হয়, সে জন্য খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রতি ইঞ্চি জমি উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করতে হবে। এ সময় বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, শেখ হাসিনা কি নিজে থেকেই দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন নাকি সত্যিই দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে?
জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এরই মধ্যে সতর্ক করে বলেছে, ২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫টি দেশে তীব্র খাদ্যঘাটতি দেখা দিতে পারে। বিশ^ খাদ্য পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর প্রধানমন্ত্রীর সতর্কবার্তা অমূলক ছিল না। ২০২৩-২৪ সাল নাগাদ বৈশ্বিক খাদ্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আন্তর্জাতিক খাদ্য সংস্থা (ফাও) একই রকমের সতর্কবাণী উচ্চারণ করছিল। গত বছর আর এ বছরে প্রধানমন্ত্রীর সতর্কবাণীর পার্থক্য হচ্ছে এই যে, তিনি গত বছর বিশ্ব খাদ্যঘাটতির কথা উল্লেখ করেছিলেন। আর এ বছর খাদ্যঘাটতির জন্য নয়; বরং বিএনপি দেশে দুর্ভিক্ষ ঘটানোর ষড়যন্ত্র করছে বলে উল্লেখ করেন। গতবার প্রধানমন্ত্রী খাদ্যঘাটতি প্রশ্নে বৈদেশিক প্ররোচনার কথা বলেননি। এবার কিন্তু বললেন।
দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষেই দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার এ উদ্বিগ্নতা যথার্থ। এবারের বক্তব্যটি যেকোনো নাগরিকের কাছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হতে পারে। এখন দেশে রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে। নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক চলছে। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের প্রতিবাদ সত্ত্বেও তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। বিএনপি রাজনৈতিকভাবে এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। আওয়ামী লীগ খালি মাঠে গোল দেয়ার পাঁয়তারা কষছে। তারা ডামি ক্যান্ডিডেট দিয়ে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখানোর চেষ্টা করছেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনবিরোধী আন্দোলনে রয়েছে। সব কিছুকে অগ্রাহ্য করে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করার অনড় সিদ্ধান্তে রয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় রয়েছে। নির্বাচন কমিশন থেকে সব প্রথা ও প্রতিষ্ঠান তাদের জবরদখলে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনী সরকারকে তোয়াক্কা না করে আগের মতোই সরকার পরিচালনা করছেন। সব ক্ষেত্রেই তার শতভাগ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। অপর দিকে, বিএনপি মামলা-হামলা, নিপীড়ন-নির্যাতনের কারণে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাহলে এ অবস্থায় বিএনপি দুর্ভিক্ষ ঘটানোর কি কোনো ক্ষমতা রাখে? বিএনপির প্রায় সব শীর্ষ নেতা কারাগারে রয়েছেন। দেশের সব অঞ্চলের নেতাকর্মী পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থীরা ইতোমধ্যেই সুপারসনিক গতিতে দণ্ডিত হয়েছেন। এই নিঃশেষ ও প্রায় নিষিদ্ধ বিএনপি কী করে দুর্ভিক্ষ ঘটানোর নীল নকশা আঁটছে?
বাংলাদেশে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর প্রবাদবাক্য আছে। আরো প্রবাদ আছে- যত দোষ সব নন্দ ঘোষ। প্রধানমন্ত্রীর ওই অনুযোগের জবাব দিতে এসব প্রবাদবাক্য যথেষ্ট নয়। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক বক্তব্য সম্পর্কে বিশ্লেষকদের মন্তব্য এরকম : তিনি ম্যাকিয়াভেলিয়ান পলিটিক্সে সিদ্ধ। ম্যাকিয়াভেলি সম্পর্কে বলা হয়- তিনি শাসককে ‘শেয়ালের মতো ধূর্ত ও সিংহের মতো সাহসী’ হতে বলেছেন। তার মতে, ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য নিপীড়ন-নির্যাতন, প্রতারণা-প্রচারণা ও শঠতা কোনো অন্যায় নয়। ভারতীয় আরেকজন প্রাচীন রাষ্ট্রচিন্তক চাণক্য একই ভাষায় শাসককে সমস্ত অন্যায়-অনিয়ম করার অধিকার দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আসলে নিজের অলক্ষ্যে সত্য কথাই বলেছেন। বিগত ১৫ বছরে দেশকে যেভাবে উন্নয়নের নামে লুটপাট করেছেন, কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন এবং যেভাবে দুষ্টচক্রের মাধ্যমে বাজারে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন, সে অবস্থায় দেশে দুর্ভিক্ষ ঘটবে না কি দুধের নহর বইবে?
নিজেদের ব্যর্থতার দায় অন্যের ঘাড়ে তুলে দেয়ার উদাহরণও আওয়ামী লীগ সরকারের নতুন নয়। ১৯৭৪ সালে যখন দুর্ভিক্ষ ঘটে তখন নিজেদের অক্ষমতা, অযোগ্যতা, অন্যায়-অপকর্ম ও দুর্নীতিকে না দেখে দূরের দেশকে দায়ী করেছিলেন। বলা হয়, ১৯৭৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পিএল-৪৮০ খাদ্যসহায়তার আওতায় বাংলাদেশে খাদ্য সাহায্যের সিদ্ধান্ত নেয়। তারা নাকি খাদ্যভর্তি জাহাজও পাঠায়। পরে যখন জানা যায়, বাংলাদেশ কিউবায় পাট রফতানি করেছে আর এর বিনিময়ে চিনি আমদানি করেছে, তখন ওই জাহাজ ফিরে যায়। মার্কিন আইন অনুযায়ী, শত্রুদেশের সাথে সম্পর্ক থাকলে ওই খাদ্য সাহায্য পাওয়ার অধিকার রাখে না সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র। কিউবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও তাদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিরূপে প্রতিভাত হয়েছে ১৯৬২ সালের মিসাইল ক্রাইসিস থেকে। মার্কিন খাদ্য সাহায্য ফিরে যাওয়ার ঘটনাটি সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য নেই। যদি তা ফিরে গিয়েও থাকে, সে ব্যর্থতা কার- মার্কিনিদের নাকি বাংলাদেশের। নিশ্চয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দায় ঠেকেনি বৈরী বাংলাদেশকে সাহায্য দেয়ার। আর তা চাইতে হলে বন্ধুত্ব ও মিত্রতার বিনিময়ে তা চাইতে হবে।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ আর ২০২৪ সালের সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের মধ্যে অপূর্ব মিল রয়েছে। সে সময়ও ক্ষমতাসীন ছিল আওয়ামী লীগ, এবারো তারা ক্ষমতায়। এবার প্রধানমন্ত্রী বিদেশী শক্তির প্ররোচনার কথা বলেছেন। ইঙ্গিতটি স্পষ্টতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। এতদিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যেভাবে যে ভাষায় তারা হেস্তনেস্ত করেছে তাদের থেকে খাদ্য সাহায্য পাওয়ার অধিকার কি তারা রাখে? ১৯৭৪ সালেও তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে গালি দিয়েছে। অবশ্য এখনকার মতো নগ্ন ভাষায় নয়। যাই হোক, দুর্ভিক্ষ একটি বাস্তব আশঙ্কা। বিআইডিএসের বার্ষিক সম্মেলনে বলা হয়েছে, মার্কিন সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা এলে আশঙ্কা বাড়বে খাদ্য নিরাপত্তায়। ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে যদি কোনো নিষেধাজ্ঞা আসে যার কারণে খাদ্যসহায়তা বন্ধ হয়ে যায়, তার জন্য সরকারের অনুসৃত নীতিমালা ও পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতাই দায়ী।
মূলত অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক দুরবস্থা, রিজার্ভের করুণ দশা ও বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের নিদারুণ ব্যর্থতা সত্য সত্যই একটি দুর্ভিক্ষের অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আগামী দুই-এক মাসে এটি আরো প্রবল হবে। তা ছাড়া সমাগত সাজানো নির্বাচন অবশেষে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি-মার্চের দিকে আরেকটি গণ-আন্দোলন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের কারণ হতে পারে। এখন আওয়ামী কৌশল অনুযায়ী, আগে থেকেই বলে কয়ে নিজেদের ব্যর্থতার দায় বিএনপির উপর চাপিয়ে নিজেদের দায় এড়াতে চায়। সরকারে আছে ১৫ বছর ধরে আর এখন বলছে বিএনপি দুর্ভিক্ষ ঘটাবে। বিএনপি যদি আওয়ামী লীগের চেয়ে সক্ষম হয়ে থাকে, ক্ষমতার আড়াই মাইলের মধ্যে না থেকেও দুর্ভিক্ষ ঘটাতে পারে, তাহলে বিএনপির সক্ষমতার প্রমাণ বহন করে নাকি?
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, সরকার দেশের সমস্ত সম্পদ লুটপাট করে রাজকোষ শেষ করেছে। আমদানি করার মতো ডলার নেই। এলসি বন্ধ। সব টাকা বিদেশে পাচার করেছে। ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণের পাহাড় আর ১৫ বিলিয়ন ডলারের তলানিতে রিজার্ভ নামিয়ে এখন কমেডি করছেন রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিএনপি মার্চের দিকে দেশে দুর্ভিক্ষ ঘটাবে কোটালিপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, বিনাভোটে ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে দেশকে উন্নয়নের গল্প শুনিয়ে আর দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার গলাবাজি করে এখন বলছেন দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করবে বিএনপি! কী হাস্যকর কথা!
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]