মানবিক গল্প: দেলোয়ার হোসেনও পুলিশ

Slider বাংলার মুখোমুখি সামাজিক যোগাযোগ সঙ্গী

deluar

 

 

 

 

 

কবি শাহান সাহাবুদ্দিন

গ্রামবাংলা ডেস্ক: পুলিশের বিরুদ্ধে   নিরাপত্তা দেয়ার  দায়িত্ব পালনের সময় অমানবিক আচরণ করার অভিযোগ চিরায়ত। তবে সব মানুষের মত সব পুলিশ যে এক নয় তা প্রমান করলেন গাজীপুর সদর থানাধীন হোতাপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল দেলোয়ার হোসেন। ছেলে ধরার মিথ্যা অভিযোগে জনতার হাতে আটক হওয়া একজন ৩০ বছরী নারীকে তার একমাত্র শিশু সন্তান সহ উদ্ধার করার পর পুলিশ ফাঁড়িতে মা ছেলের মাতৃত্ব বন্ধনের কিছু স্পর্শ কাতর মানবিক মুহুর্তে  একজন পুলিশ দেলোয়ার হোসেন, যে মানবিক আচরণ করেছেন তা উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ওই দূর্লভ চিত্র নিজের রং তুলিতে এঁকে গল্পে আকারে উপস্থাপন করেছেন কবি শাহান সাহাবুদ্দিন। তার নিজস্ব ফেইসবুক একাউন্ট থেকে সংগ্রহ করে হুবহু পাঠকের জন্য তা তুলে ধরা হলো।

এ এস আই রিয়াজ ভাই বললেন, দেশি, আপনাকেই মনে মনে খুঁজছি। সৌভাগ্যক্রমে পেয়ে গেছি। আর নয়তো ফোন দিতাম। আসুন। দৃশ্যটা দেখুন। আপনার ভেতরটা হু হু করে কাঁদবে। আমি ফাঁড়ির ভেতরে ঢুকলাম। দৃশ্যটা দেখলাম।

একজন মা ফ্লোরে বসে গোগ্রাসে ভাত গিলছেন। মনে হচ্ছে দীর্ঘ দীর্ঘ সময় ধরে তিনি অভুক্ত। মলিন মুখ। উশখু খুশকু চুল। পরনে গ্রামীণ চেক শাড়ি। শ্যামবর্ণের মুখ পাণ্ডুর বর্ণ ধারণ করেছে। এটা ক্ষুধায়, নাকী বেদনায় বুঝা যাচ্ছেনা। কোলে মুখ গুঁজে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে একটি শিশু। গায়ে গেঞ্জি। পরনে হাফ প্যান্ট। এঁদের সামনে জুসের বোতল, পানির গ্লাস। লম্বা ফর্সা মতো একজন যুবক পাশের রুম থেকে গরুর গোস্ত নিয়ে এসে যত্ন করে পাতে ঢেলে দিয়ে বললেন, পেট ভরে খান। মা তাকিয়ে ও দেখার প্রয়োজন মনে করেলন না আপ্যায়ন কারীর মুখের দিকে। তিনি খাওয়াটাকেই জরুরী মনে করছেন। রিয়াজ জানালেন, এঁদেরকে নিয়ে আসা হয়েছে সদর উপজেলার পিরুজালি ইউনিয়নের সরকার পাড়া থেকে। রিয়াজ ভাইয়ের সঙ্গে ছিলেন হাবিলদার মোস্তফা ভাই। চিরোকালের অতি উৎসাহী আম জনতা মা টিকে ছেলে ধরা আখ্যায়িত করে গণ ধুলাইয়ের ব্যাবস্থা করার মধ্য দিয়ে চেয়েছিলেন মহৎ কর্ম সম্পাদনের। কোনো ভাবেই যুবতী মা বুঝাতে পারছিলেন না তিনি ছেলে ধরা নন। শিশুটি তাঁরই সন্তান। রিয়াজ ভাই ও মোস্তফা ভাই শিশুটির মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। বাঙলা ইংরেজি মিলিয়ে মা যা বললেন তার সব কথার মর্ম উদ্ধার করতে ব্যর্থ হলেও রিয়াজ ও মোস্তফা এটা বুঝতে পারেন মা যুবতীটি কথা বলতে গিয়ে মাঝে মধ্যেই খেই হারিয়ে ফেলছেন,প্রসঙ্গ রেখে ঢুকে যাচ্ছেন অপ্রাসঙ্গিক বিষয় আশয়ে। কিছুটা সংলগ্ন, কিছুটা অসংলগ্ন কথার বয়ানে যা পাওয়া যায় তাঁর সার সংক্ষেপ এরকম। মা যুবতিটীর নাম অজান্তা। বয়স আনুমানিক ৩০। শিশুটির নাম অন্তর। বয়স ২। ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানার চরকলী গ্রামে এঁদের নিবাস। এক ধরণের বেদনা থেকে অজান্তা ছিটকে পরে জীবনের বিপরীতে। যে জীবনটা ফাঁড়ির পুব দিকের রহস্যময় আলো আধারির মতো।

ma-sele

 

 

 

 

 

 

 

 

রিয়াজ ভাই জানালেন অজন্তার গ্রামের বাড়ির চেয়ারম্যান কে ফোন দিয়ে এঁদের বিস্তারিত তথ্য জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে অভিভাবকরা সবিস্তারে জেনে চেয়ারম্যান সহ রওনা দিয়েছেন গাজীপুরের উদ্দেশে।
আমরা যখন কথা বলছি এর এক ফাঁকে শিশু অন্তর জেগে গেছে। একটু আগেও যিনি পরম মমতায় ভাত মাংস সহ প্লেট এগিয়ে দিয়েছিলেন সে যুবকটি শিশুটিকে কাছে টেনে নিলেন। বললেন, জুস খেয়ে নাও বাবু।
শিশুটি জুস খেতে খেতে রুমের চারদিকে চোখ বুলায়। উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে দেখতে থাকে ঘর ভর্তি পুলিশ সহ নানা কিসিমের লোকজনকে। সেকি মনে মনে তখন এটা ভাবছে সন্ধার আগে আগে দেখা এতো এতো লোক গুলো এখনকার লোকদের মতো হলে কী এমন ভুল হতো?
ইতোমধ্যে একে একে রুম থেকে অনেকেই চলে গেছেন। এক ধরণের শূন্যতা বিরাজ করছে এখানে। আমি শেখ এমদাদ মেম্বার মামার মোবাইল ফোনে তুলতে থাকি বহুমাত্রিক স্থিরচিত্র।
আমি কী যেনো ভেবে বাইরে চলে আসি। একবার তাকাই আকাশের দিকে। আরেকবার নক্ষত্রের। মনে পড়ে কবি জীবনানন্দকে। মনে পড়ে বেদনার পানে চেয়ে নক্ষত্রের পানে তাকানোর কবিকে। ফের ফাঁড়িতে ঢুকি। চমকে উঠি আমি। একটু আগে একাধিক মহত্তম ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া ফর্সা লম্বা যুবক এবার ক্যালেন্ডারের পাতা কেটে শিশুটির জন্য নানা কৌশল ও বুদ্ধিদীপ্ত ভঙ্গী ও আঙ্গিকে বানাচ্ছেন ফুল। যে ফুলের সুনির্দিষ্ট নাম দিতে আমি ব্যর্থ হয়ে ভাবলাম এটা হয়তো মানবিক ফুল। যে ফুলটি কেবল অন্তরের হাতেই মানাবে। ফুলের ভেতরটা পিরামিডের মতো। বাইরে শাপলার বাকল। ফুলটি একটা লাঠির মাথায় স্থাপন করেই যুবকটি এগিয়ে দিলেন অন্তরের হাতে। অনবদ্য এই দৃশ্যটি ছোটো ভাই আলমগীরের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি। আমার ভেতর থেকে গোপন দীর্ঘশ্বাস বাইরে এসে বাতাসে মিলিয়ে যায়। চোখ ছল ছল করতে থাকে। অন্তরের আদুরে মুখে, কপালে বাবা বলে আমি চুমু খেয়ে মানবিক ফুলের কর্তা যুবক দেলোয়ার ভাইকে বলি আপনাকে এই মুহূর্তে পুলিশ ফাঁড়ির অপারেটর মনে হচ্ছেনা। মনে হচ্ছে মহাত্মা সুলতান ছফার অতি মানবীয় উপলদ্ধির উত্তরসূরি আপনি। আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করবোনা। দীর্ঘকাল বেঁচে থাকুন। বাঁচুন বিপন্ন শিশুদের জন্য।
দেলোয়ার ভাই বললেন, শিশুদের মুখ তাঁকে বিপুল ভাবে ভাবায়। গ্রামের বাড়িতে গেলে শিশুরাই নাকী হয়ে উঠে তাঁর নিত্য সঙ্গী। কী মাঠে, কী ঘাটে, কী আঙিনায়। এঁদের ঠিকানা হয় দেলোয়ারের ঘাড়, হাত, মাথা ও বুক!
ফাঁড়ি থেকে বেরিয়ে মধ্য রাতের আকাশ, নক্ষত্র,চেনা অচেনা বিচিত্র সব মানুষের মুখ ও শাল বনের পিন পতন নিরবতাকে সঙ্গী করে বাড়ির পথে হাঁটতে থাকি। আমার পরিবেশ প্রতিবেশ জনপদ আকাশ নক্ষত্র অসম্ভব সুন্দর হয়ে চোখে ধরা দেয়। ভাবি, এরকম একজন দেলোয়ার বা রিয়াজ বা মোস্তফা কেনো রাজনের অন্তর্ভেদী আর্তনাদের সময় আশে পাশে থাকেনি। যদি থাকতো, রাজনের মতো তরতাজা ফুলের কলি পৃথিবীর প্রতি, মানুষের প্রতি বিপুল ঘৃণা ছুঁড়ে দিয়ে অভিমানে বেদনায় অকালে এমন করে বিদায় নিতে পারতোনা।

তাহলে চকিদার ময়না মিয়া,মোহিত আলম, কামরুল ইসলামরা ও মানুষ; মানুষ রিয়াজ, মোস্তফা দেলোয়ার ও! পুলিশের লোক আলমগীর হোসেন, আমিনুল ইসলামরা ও যেমন, পুলিশের লোক রিয়াজ, দেলোয়ার প্রমুখ ও !
এক মানুষের ভেতরে কতো বিচিত্র মানুষের বসবাস! এক পুলিশ বিভাগে কতো বিচিত্র পুলিশ, পুলিশের মন!

আমি বাড়ির গেটে গিয়ে ডাকি, মা! পিছনে মানবিক বাগান হয়ে হাসতে থাকে হোতাপাড়া পুলিশ ফাঁড়ি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *