আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর প্রধান ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের বৈঠকআইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর প্রধান ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের বৈঠক
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়্ন্ত্রণে রাখতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এক্ষেত্রে সরকারবিরোধীরা নির্বাচনে আসলে এক রকম প্রস্তুতি এবং না আসলে আরেকরকম প্রস্তুতি রয়েছে বলে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছেন বাহিনীগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
সোমবার (৩০ অক্টোবর) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ, র্যাব ছাড়াও সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ড, আনসার ভিডিপি এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তি ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের এক সভায় বাহিনীর পক্ষ থেকে এমন আশ্বাস দেওয়া হয় বলে বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
এদিন সকালে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী চলা এ বৈঠকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ গ্রহণ, বৈধ অস্ত্র প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, নির্বাচনপূর্ব, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন পরবর্তী সম্ভাব্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে করণীয় নির্ধারণ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ন্ত্রণ, নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েনের পরিকল্না প্রণয়ন, ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা ও নির্বাচনি এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।
সূত্র জানায়, বৈঠকে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন ও তফসিল ঘোষণা নিয়ে সম্ভাব্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কী হতে পারে, সে সম্পর্কে বাহিনীর প্রতিনিধিদের কাছে জানতে চান কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। এরপর একে একে সবার বক্তব্য শোনা হয়। এ সময় নির্বাচন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত তুলে ধরেন আলোচকরা। প্রায় সবার বক্তব্যেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও অনুকূলে রয়েছে বলে দাবি করেন। তারা বলেন, অতীতের দুটি নির্বাচন এবং আগামী নির্বাচন পরিস্থিতি এক রকম নয়। সে সময়ের তুলনায় বর্তমানে বাহিনীর জনবল ও দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নত নানা প্রযুক্তির পাশাপাশি বাহিনীর সক্ষমতাও আগের তুলনায় বেড়েছে। সেজন্য নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কার কোনও কারণ নেই। ভোটের আগে বৈধ অস্ত্র জমা এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের পরামর্শ দেন কেউ কেউ। তারা বলেন, আগের দুটি নির্বাচনের আগে এ কার্যক্রম চালানো হয়। এবার সেটি করা উচিত। এ সময় আবার কেউ কেউ বৈধ অস্ত্র উদ্ধারেরও বিরোধিতা করে বলেন— তাহলে ওই ব্যক্তির নিরাপত্তার ঘাটতি হতে পারে। সেজন্য বৈধ অস্ত্র উদ্ধার না করে এসব অস্ত্র যাতে প্রদর্শন করা না হয়, সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া উচিত।
সূত্র জানায়, বৈঠকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়— নির্বাচন কমিশন যদি সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়, তবে বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে। এ ছাড়া বিজিবি ১১০০ প্লাটুন এবং আনসারের পক্ষ থেকে ৬ লাখ সদস্য মোতায়েনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে বলে স্ব স্ব বাহিনীর পক্ষ থেকে জানোনো হয়েছে।
বৈঠকে নির্বাচনের দিন সকালে ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানোর বিরোধিতা করেন বাহিনীর প্রতিনিধিরা। তাদের দাবি, কেন্দ্রগুলোতে আগেই বিপুল সংখ্যক বাহিনী মোতায়েন থাকবে। সেক্ষেত্রে ভোটের দিন ব্যালট পাঠাতে গেলে কিছু সমস্যা হতে পারে। এ সময় ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়— ভোটের দিন ব্যালট পাঠানোর বিষয়টি এখনও আলোচনাধীন। এ বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।
বৈঠকে পুলিশের পক্ষ থেকে আবারও ভোটের দিন সকালে ব্যালট কেন্দ্রে পাঠানোর বিষয়ে বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়। যদিও ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে ইসি এখনেও সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে পরিকল্পনা রয়েছে সকালে ব্যালট পাঠানোর। সূত্র জানায়, পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এবার প্রতি ভোটকেন্দ্রে অস্ত্রসহ দুজন পুলিশ মোতায়েনের চিন্তা রয়েছে। তাই পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এটি করা হলে অনেক লোকবল প্রয়োজন হবে। সেক্ষেত্রে ভোটের দিন সকালে ব্যালট পেপার পাঠাতে গেলে লোকবল সংকট হতে পারে। তবে বৈঠক শেষে ইসির একটি সূত্র জানিয়েছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো নয়, এমন প্রত্যন্ত অঞ্চল ছাড়া অন্যসব কেন্দ্রে সকালে ব্যালট পাঠানোর পরিকল্পনায় ইসি এখনেও অনঢ় রয়েছে।
বৈঠকে পুলিশের পক্ষ থেকে ইসিকে আশ্বস্ত করে বলা হয়, তাঁদের দুই ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। সব দল নির্বাচনে অংশ নিলে এক ধরনের প্রস্ততি রয়েছে। এছাড়াও কোনও দল নির্বাচন ঠেকানোর মতো কর্মসূচি দিলে পরবর্তী করণীয় বিষয়েও তাদের প্রস্তুতি রয়েছে।
বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল ছাড়াও চার কমিশনার আহসান হাবিব খান, মো. আলমগীর, আনিছুর রহমান ও রাশিদা সুলতানা, ইসি সচিব ও কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তাফিজুর রহমান এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে মহাপুলিশ পরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) প্রধান মনিরুল ইসলাম, র্যাবের মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন ও আনসার ও ভিডিপির মহপরিচালক মেজর জেনারেল একেএম আমিনুল হক, সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারের (পিএসও) প্রতিনিধি, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের মহপারিচালকের প্রতিনিধি এবং বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল একেএম নাজমুল হাসান, গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদফতর (এনএসআই)-এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল টিএম জোবায়ের এবং ডিজিএফআইয়ের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম সাংবাদিকদের জানান, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনপূর্ব, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, কোন পদ্ধতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে, নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয় ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়গুলো সভায় আলোচনা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা তাদের তথ্য উপস্থাপন করেছে, বিভিন্ন বাহিনী প্রধান তাদের সক্ষমতা কী আছে, অতীতে তাদের জনবলকে কীভাবে কেন্দ্রে ও অন্য কাজে নিয়োজিত করা হয়েছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে কীভাবে দায়িত্ব পালন করবে, তা তুলে ধরা হয়েছে। ভোটের আগে আগে এ ধরনের আরও অনেক সভা হবে বলেও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন সচিব আলোচনার বিষয় তুলে ধরে বলেন, হরতালের পর একটি বড় রাজনৈতিক দল হরতাল শেষে সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি দিয়েছে।… আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিবেদন মতে, কমিশনের কাছে মনে হয়েছে— এখনও পর্যন্ত পরিবেশ সন্তোষজনক রয়েছে।
তিনি বলেন, গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানরা যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাদের যে প্রতিবেদন, এখনও পর্যন্ত নির্বাচন আয়োজনে বড় ধরনের কোনও প্রতিবন্ধকতা নেই। যেহেতু হরতালের পর তিন দিনের অবরোধ দিয়েছে বিএনপি, সে বিষয়ে তারা সতর্ক রয়েছে, যাতে আইনশৃঙ্খলার কোনও অবনতি না ঘটে।
নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কী ধরনের বার্তা ছিল জানতে চাইলে জাহাংগীর আলম বলেন, কমিশনাররা বক্তব্য শুনেছেন এবং কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। এই আলোকে পরবর্তীকালে পরিপত্র জারি, কেন্দ্রে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী কীভাবে মোতায়েন করা হবে, পরবর্তী সময়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হবে।
সংবিধান অনুযায়ী আগামী ২৯ জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোট হতে হবে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধী জোটের অংশগ্রহণে অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন জানুয়ারির শুরুতে ভোটের আয়োজন করতে চায়। নভেম্বরের প্রথমার্ধের যেকোনও সময় তফফিল ঘোষণা হবে বলেও জানানো হয়েছে।