চলতি বছরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের তিনটি শ্রেণীতে নতুন এই কারিকুলাম চালু হলেও আগামী শিক্ষাবর্ষে আরো কয়েকটি শ্রেণীতে বাস্তবায়ন করা হবে নতুন কারিকুলাম। এ নিয়ে ইতোমধ্যে অভিভাবকদের মধ্যে তীব্র নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। অনেক ভালো শিক্ষার্থীরাও এখন নিয়মিত পড়ার টেবিলে আর বসছে না। পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ণ না থাকায় অধিকাংশ ছাত্র ছাত্রীর বইয়ের সাথে তৈরি হয়েছে দূরত্ব। এ নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে যেন অভিযোগের কোনো অন্ত নেই। ফলে দেশের বাস্তবতার আলোকে পাঠ্যসূচি প্রণয়ন এবং পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নেরও দাবি জানিয়েছেন অভিভাবকদের অনেকে।
এ দিকে চলতি বছর থেকে দেশে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলসহ একাধিক দাবিতে মাঠে নেমেছেন অভিভাবকরা। তাদের দাবি বাস্তবায়নে ইতিমধ্যে বেশ কিছু কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়েছে। এ কর্মসূচির অংশ হিসেবেই গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনের সড়কে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। তাদের এ আন্দোলনের সংহতি জানিয়েছেন শিক্ষকরাও। সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের ব্যানারে এ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। সারা দেশে স্কুলে স্কুলে একই কর্মসূচি পালিত হবে বলে জানা গেছে। এর আগে গত ১৩ অক্টোবর নতুন শিক্ষা কারিকুলাম সংস্কারসহ ৭ দফা দাবি জানিয়েছে শিক্ষা আন্দোলন সম্মিলিত অভিভাবক ফোরাম। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধনও করেছেন ফোরামের নেতারা। মানববন্ধনে অংশ নিয়ে অভিভাবকদের অনেকেই বলেছেন, নতুন শিক্ষা কারিকুলাম সংস্কার করতে হবে। এছাড়া আগের পরীক্ষা পদ্ধতিও ফিরিয়ে আনতে হবে। এতে মেধা যাচাই হবে নম্বরের ভিত্তিতে। আর সব ব্যবহারিক বিষয় স্কুল থেকে সম্পন্ন করতে হবে। নতুন কারিকুলাম পরিবর্তন করতে হবে এবং যে কোনো পরিবর্তন পরিমার্জন করতে হলে ওই কমিটিতে অভিভাবক প্রতিনিধি রাখতে হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ভিকারুন্ননিসা স্কুলের সামনে কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে অকেন অভিভাবকই তাদের অসন্তোষের বিষয়ে ক্ষুুুুুুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। অভিভাবকরা বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেই। চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়তে হবে আটটি বিষয়। নতুন শিক্ষাক্রমে তাত্ত্বিক বিষয়ের চেয়ে শিখনকালীন মূল্যায়নকে বেশি জোর দেয়া হয়েছে। তুলে দেয়া হয়েছে সাময়িক পরীক্ষাও। অভিভাবকরা জানান, পরীক্ষা পদ্ধতি না থাকায় ছাত্রছাত্রীরা অধ্যয়নমুখী হচ্ছে না। বইয়ের সাথে দূরত্ব বেড়ে তারা এখন নানা ধরনের ডিভাইসমুখী হচ্ছে।
অন্যদিকে শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে নতুন শিক্ষাক্রমে সবচেয়ে বড় সমস্যা দলগত কার্যক্রমে। দেখা যাচ্ছে স্কুল থেকে প্রদত্ত দলগত কাজটি করতে হচ্ছে স্কুল পিরিয়ডের পর। যে কারণে ছাত্রছাত্রীদেরকে বন্ধু-বান্ধবীর বাসায় বা অন্য কোথাও একত্রিত হয়ে তা সম্পন্ন করতে হচ্ছে। এতে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে ছাত্রছাত্রী অভিভাবক উভয়কেই। অধিকাংশ অভিভাবক স্কুল ছুটির পর তার সন্তানকে অন্য কারো বাসায় নিয়ে যেতে আগ্রহী নয় এবং স্বাচ্ছন্দবোধ করেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক নয়া দিগন্তকে জানান, নতুন এই কারিকুলাম প্রকৃত আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী নয়। তবে কয়েকটি ধাপে ধাপে এবং শিক্ষকদের শতভাগ প্রশিক্ষণের আওতায় আনার পর যদি বাস্তবায়ন শুরু হতো তবে কিছুটা সহজ হতো। কিন্তু এখন তো অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনার একেবারে বাইরেই চলে যাচ্ছে। একজন শিক্ষক জানান, ছাত্রছাত্রীদের বাড়ির কাজ দেয়া হলে এই কাজ তারা নিজেরা করছে না। বাসার বড় বোন কিংবা মায়েরাই হাতের কাজ করে দিচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীদের শিখন ফল শূন্য। এভাবে আসলে কোনো শিক্ষা কার্যক্রম চলতে পারে না। তবে অনেক শিক্ষকই তাদের চাকরির ভয়ে নতুন এই শিক্ষাক্রম নিয়ে নেতিবাচক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
এর আগে অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি একাধিক অনুষ্ঠানেই জানিয়েছেন নতুন শিক্ষাক্রম আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও প্রবর্তন করা হয়েছে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই কারিকুলাম বাস্তবায়ন করতে পারলে আমাদের শিক্ষার্থীরাও এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। অন্যদিকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র জানিয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রশিক্ষণের বাইরে থাকা সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। তখন নতুন এই কারিকুলাম বাস্তবায়ন আরো সহজ হবে। উল্লেখ্য, এর আগে চলতি বছর থেকেই তিনটি শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হয়েছে। নতুন এই শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে ২য়, ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণীতে। আগামী বছর প্রথম ৩য়, ৪র্থ, ৮ম এবং নবম শ্রেণীতে যুক্ত হচ্ছে এটি। ২০২৫ সালে যুক্ত হবে ৫ম ও দশম শ্রেণী। ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে যুক্ত হবে দ্বাদশ শ্রেণী।
বর্তমান শিক্ষাক্রমে নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখা থাকলেও নতুন এই শিক্ষাক্রমে মাধ্যমিক পর্যন্ত থাকছে না কোনো বিভাগ বিভাজন। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীর সবাইকে পড়তে হবে ১০টি অভিন্ন বিষয়। বর্তমানে নবম ও দশম শ্রেণীর পাঠ্যসূচি মিলিয়ে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু নতুন কারিকুলামে কেবল দশম শ্রেণীর পাঠ্যসূচির ওপর অনুষ্ঠিত হবে এসএসসি পরীক্ষা।
অভিভকরা বলছেন, শহরের সচেতন অভিভাবকরা এই শিক্ষা উপকরণের জোগান দিতে পারলেও মফস্বল এলাকার অভিভাবকরা এগুলোর জোগান দিতে পারছেন না। ফলে দরিদ্র পরিবারের ছাত্রছাত্রীরা ঝরে পড়া আগের তুলনায় অনেক বেশি। গত ৯ মাসের বিভিন্ন জরিপ বলছে গ্রামের স্কুলগুলিতে এই শিক্ষাক্রম ১০% ও সফল হয়নি। এমতাবস্থায় এই শিক্ষাক্রম সংস্কার বা বাতিলের দাবি তাদের।
নতুন কারিকুলাম বাতিলের দাবিতে ৮ দফা দাবি জানানো হয়েছে সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের পক্ষ থেকে। দাবিগুলো হলো- নতুন কারিকুলাম সংস্কার বা বাতিল করতে হবে; ৫০/৬০ নম্বরে অন্তত ২ সাময়িক লিখিত পরীক্ষা চালু রাখতে হবে; নবম শ্রেণীতে বিভাগ রাখতে হবে; ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুর্ভুজ ইত্যাদি ইন্ডিকেটর বাতিল করে নম্বর ও গ্রেড ভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি রাখতে হবে।