।। মোল্লা তানিয়া ইসলাম তমা ।।
প্রখর রোদের তপ্ত ঝাঁজে খেটে খাওয়া মানুষের দেহের ঘামে দেশের জমিন হয় উর্বর, তার বুকে ফলে সোনালি ফসল। দেশ রূপান্তরিত হয় রূপবতী-গুণবতীরূপে সবার কাছে। তাদের ট্যাক্সের টাকায় যেমন একদিকে পুরো দেশের মানুষের ভাগ্য ফেরে, অন্যদিকে একটি নতুন মেধাবী প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য তাদেরই সন্তানরা পড়াশোনা করে। এই মেধাবী নতুন প্রজন্ম যদি পথ হারায়, তাহলে পুরো দেশই পথ হারায় । প্রতিনিয়ত পড়াশোনা, গবেষণা ও আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে দেশকে গড়ার কাজ করে ছাত্রসমাজ। এজন্য তাদের একটি সুন্দর পরিবেশের দরকার হয়, ভালো একটি শিক্ষাব্যবস্থার দরকার হয়, গবেষণা প্রযুক্তির প্রয়োজন হয়। এসব কিছু সময়মতো ছাত্ররা পেলে তারা এগোয়, তারা এগিয়ে গেলে দেশও এগিয়ে যায়। একজন ছাত্র এসব অধিকার সরকার ও মনোনীত কর্তৃপক্ষের কাছে আদায় করে নেয়। যখনই কোনো অনিয়ম দেখে তখনই অনিয়ম ভেঙে নিয়মের মধ্যে শিক্ষা-কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার জন্য সংঘবদ্ধ ছাত্রসমাজের প্রয়োজন হয়। এই সংঘবদ্ধভাবে অধিকার আদায়ের নাম যদি ছাত্ররাজনীতি হয়, তবে এমন ছাত্ররাজনীতিই দেশ গড়ার কাজে অনিবার্য হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। শুধু শিক্ষার অধিকার আদায়ে নয়, বরং দেশের যেকোনো সংকটে ছাত্রসমাজের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয় । সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার অধিকার আদায়ের ছাত্র রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে । বিশেষ করে ১৯৪৭ দেশভাগের পরে বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তানের দ্বারা শোষণের শিকার হয়। নানাভাবে তারা তৎকালীন পশ্চিম বাংলাকে শোষণ করে পশ্চিম পাকিস্তানকে সমৃদ্ধশালী করে। ৪৭ থেকে ৫২ এরমধ্যে নানাভাবে তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার হনন করে পশ্চিম পাকিস্তান । যে কারণে পূর্ব বাংলার মানুষের ওপরে জোর করে উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়। তৎকালীন ছাত্রসমাজকে নিজেদের মাতৃভাষা রক্ষার জন্য বিদ্রোহ করতে হয়। যে কারণে বাংলা ভাষার প্রশ্নে ছাত্রসমাজ এক বিন্দু ছাড় দেয়নি। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার বিজয় পরবর্তীকালে মহান স্বাধীনতার যুদ্ধের অনুপ্রেরণা ও অর্জনের পথ সুগম করে। সেই সঙ্গে ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলন, ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটাবিরোধী ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রসমাজ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমাদের দেশে ছাত্র রাজনীতির যেসব অর্জন আছে, তা বিশ্বের আর কোনো দেশে নেই । শিক্ষার অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক আন্দোলনগুলোর মধ্যে অন্যতম ১৯৬২ শিক্ষা আন্দোলন। যে আন্দোলনকে ছাত্রসমাজের ঐতিহাসিক অর্জন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তৎকালীন শরিফ শিক্ষা কমিশনের শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ রাজপথে নামতে বাধ্য হয়। স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের মাত্র ২ মাস পর ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। শরিফ কমিশন নামে খ্যাত এসএম শরিফের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশন ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। এতে শিক্ষা বিষয়ে যেসব প্রস্তাবনা ছিল তা প্রকারান্তরে শিক্ষা সংকোচনের পক্ষে গিয়েছিল। আইয়ুব খান দেশে সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ছাত্র সংগঠনগুলো ১৪৪ ধারা জারি থাকা সত্ত্বেও দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচির ডাক দেয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে দমাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা লেলিয়ে দেয় পুলিশ বাহিনী। তারই একপর্যায়ে ১৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট মোড়ে ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে মোস্তফা, বাবুল, ওয়াজিউল্লাহ প্রমুখ শহীদ হন। এ রকম প্রতিটি আন্দোলনে বাংলার ছাত্রসমাজ তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে। যেমনিভাবে বহির্বিশ্বের দিকে যদি তাকিয়ে দেখি, তাহলেও আমরা ছাত্রসমাজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখতে পাব। পৃথিবীতে বাংলাদেশ ছাত্রসমাজের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন এবং ঐতিহাসিক অনেক অর্জনের গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস অন্য কোনো দেশের ছাত্রসমাজের নেই । বাংলাদেশে ষাটের দশক থেকে শুরু করে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ছাত্র রাজনীতির গতিপথ ঠিক ছিল। ছাত্র রাজনীতি ছিল, অধিকার আদায়ের অন্যতম মাধ্যম এমনটিই মনে করত সাধারণ মানুষ। তাই দেশের যেকোনো সংকটে সাধারণ মানুষ ছাত্রসমাজের দিকে তাকিয়ে থাকত। কালক্রমে সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ছাত্রসমাজ ভুলতে বসেছে। ৬২ শিক্ষা আন্দোলনের ইতিহাস ঐতিহ্য পুরোটাই আজকের ছাত্রসমাজ ভুলে গেছে। যাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা শিক্ষার অধিকার ফিরে পেয়েছি, সেই আত্মত্যাগীদের ভুলে গিয়েছি। ঐতিহাসিক অধিকার আদায়ের দিবসগুলোতে অল্প কিছু সংগঠন কর্মসূচি গ্রহণ করলেও ব্যাপক আকারে সেগুলো নিয়ে চর্চা চোখে পড়ে না। আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ঐতিহ্য ও অর্জন সম্পর্কে বার্তা পৌঁছাতেও ব্যর্থ হয়েছি। বিশেষ করে ছাত্র সংগঠনগুলোর এই গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলোতে নিশ্চুপ থাকা সাধারণ মানুষকে হতাশ করেছে। করোনাভাইরাসের অজুহাতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় ধ্বংসের পথে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস ও হল খোলার দাবিতে আন্দোলন চলছে। অথচ সেখানে বড় ছাত্র সংগঠনগুলোর কোনো ভূমিকা লক্ষ করা যাচ্ছে না; যা সত্যিই হতাশাজনক। ছাত্র রাজনীতিকে বলা হয় নেতৃত্ব তৈরির বাতিঘর। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। দেশে চলমান বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচার, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় এবং সর্বোপরি ছাত্রদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আওয়াজ তুলতে ছাত্র রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই। খুব হতাশা ও দুঃখ নিয়ে বলতে হয়, ছাত্র রাজনীতি তার গৌরব হারিয়ে ফেলেছে। ছাত্রসমাজ অতীত ইতিহাস ভুলে পথভ্রষ্ট হয়েছে। এক সময় ছাত্র রাজনীতি করা ছিল অতি গৌরবের। যারা ছাত্র রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ছিল, সমাজে তাদের আলাদা কদর ছিল। দেশের মানুষ জানত, এই ছাত্রসমাজ নিজেদের স্বার্থ বলি দিয়ে দেশ ও দশের স্বার্থে রাজনীতি করে। বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন। আমাদের ছাত্রসমাজের অধিকাংশই ছাত্র রাজনীতি বিমুখ। ছাত্র রাজনীতি যেন তাদের কাছে একটা জঞ্জাল ও আতঙ্কের নাম। ছাত্রনেতাদের ছাত্র ও শিক্ষক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ ভয় পায়। যারা ছাত্র রাজনীতি করে, তাদের নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্নভাবে ভয় দেখিয়ে অনেকটা জোরপূর্বক ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করা হয়। আর যারা স্বেচ্ছায় ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের অধিকাংশই নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে তৎপর থাকে। এরা ছাত্রদের অধিকার আদায়ের জন্য নয়, বরং নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করে। যখনই যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে, সেই দলের ছাত্র সংগঠন সারা দেশে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, মাদক ব্যবসা, খুন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে দেশজুড়ে একটা অরাজকতা সৃষ্টি করে। তাদের কর্মকান্ডে মূল রাজনৈতিক দল পর্যন্ত বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, ছাত্র রাজনীতির সংজ্ঞা হচ্ছে, ‘ছাত্রদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা তোলা, এজেন্ডা হিসেবে গ্রহণ করানো এবং সেই এজেন্ডার পক্ষে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে কর্তৃপক্ষকে চাপ দিতে পরিচালিত রাজনৈতিক কর্মকান্ডকে ছাত্র রাজনীতি বলা যায়।’ আর বর্তমান ছাত্র রাজনীতির প্রেক্ষাপটে সংজ্ঞাটা হবে এমন ‘জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় কোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্র শাখা হিসেবে ছাত্রদের মধ্যে সেই দলের সমর্থন তৈরি করা, নেতৃত্ব তৈরি করা এবং সেই দলের স্বার্থে ছাত্রদের ব্যবহার করাকে ছাত্র রাজনীতি বলা যায় । ছাত্র রাজনীতির উদ্দেশ্য কখনো রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া নয়। ছাত্রছাত্রীদের অধিকার-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কাজ করা হলো ছাত্র নেতাদের কাজ। কিন্তু বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্র রাজনীতিকে ক্ষমতায় ঠিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। যার ফলে ছাত্রনেতারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক দলগুলো এই অপরাধের প্রশ্রয়ই দিচ্ছে এবং রাজনৈতিকভাবে তাদের সমর্থন করছে। ফলে ছাত্র রাজনীতির গতিপথ পাল্টে ক্ষমতায় যাওয়া সিঁড়িতে পরিণিত হয়েছে। মেধাবীরা ছাত্র রাজনীতি বিমুখ হচ্ছে। অযোগ্য মেধাহীন মানুষ নেতৃত্বে আসছে। যে কারণে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই মেধাবীদের ছাত্র রাজনীতিতে ফিরাতে লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি পরিহার করতে হবে এবং ছাত্র সংগঠনগুলোকে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করার স্বাধীনতা দিতে হবে। রাজনীতিতে হারানো গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলো ফিরে আসুক, অধিকার আদায়ের অন্যতম হাতিয়ার হোক আমাদের ছাত্রসমাজ সেই প্রত্যাশা রইল।