ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজা

Slider সারাবিশ্ব


‘আমরা কোথায় যাব? এখানে কি এমন একটি নিরাপদ, নিরিবিলি ও শান্ত জায়গা আছে?’ গাজার রিমাল এলাকায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের বাসিন্দারা আমাকে এ কথা জিজ্ঞেস করেন। আমি আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সাত ঘণ্টা কাটিয়েছে এখানে। কারণ, ইসরাইলি বাহিনী আরেক-দফা বিমান হামলা চালিয়েছে।

শনিবার ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের হামলার জবাবে গাজায় একের পর এক বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল।

ইসরাইলি বিমান হামলায় গাজার আবাসিক ভবন, টেলিফোন কোম্পানির অফিস এবং ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব গাজাসহ সবকিছুর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

সোমবার সারারাত ধরে ফাইটার জেট থেকে ফেলা বোমার বিকট আওয়াজ চমারাত্মক আতঙ্ক তৈরি করেছে। শিশুরা ভয়ে চিৎকার করছিল, কেউ এক মুহূর্ত ঘুমাতে পারেনি।

রিমাল গাজার অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত। ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যারা ধনাঢ্য তারা রিমাল এলাকায় বসবাস করেন। রিমাল এলাকার বাসিন্দারা সোমবার রাতের কথা বহুদিন ভুলতে পারবে না।

রাতের আঁধার কাটিয়ে যখন মঙ্গলবার ভোরের আলো ফুটে উঠেছে তখন বিমান হামলার তীব্রতা কমে আসে। এরপর মানুষ ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহতা দেখতে পেয়েছে।

দক্ষিণ-পশ্চিমের এই এলাকাটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর সাথে সংযোগকারী সব রাস্তা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

আমি যখন বিভিন্ন জায়গা ঘুরছিলাম, তখন আমার কাছে মনে হয়েছিল যেন ভূমিকম্প হয়েছে। চারিদিকে ধ্বংসস্তূপ, ভাঙা কাঁচ, এবং বিচ্ছিন্ন হওয়া তার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ধ্বংসের মাত্রা এতোটাই বেশি ছিল যে কিছু বিল্ডিং দেখে আমি একেবারেই চিনতে পারিনি।

‘আমি সব হারিয়েছি। আমার অ্যাপার্টমেন্টে পাঁচ সন্তান বসবাস করতো। এই ভবনটিতে আমার অ্যাপার্টমেন্ট ছিল। এই ভবনের নিচে আমার একটি দোকান ছিল। সেটিও ধ্বংস হয়ে গেছে,’ শিশু কন্যাকে কোলে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব কথা বলছিলেন মোহাম্মদ আবু আল-কাস।

‘আমরা কোথায় যাব? আমরা ঘরবাড়ি হারিয়েছি। আমাদের থাকার কোনো জায়গা নেই, কোনো কাজ নেই।’

‘আমার বাসা এবং আমার মুদি দোকান কি সামরিক স্থাপনা?’ ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর প্রতি এ প্রশ্ন ছুঁড়ে তিনি বলেন, তারা সবসময় মিথ্যা কথা বলে।

ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সোমবার রাতে গাজায় ইসরাইলি বিমান হামলায় অন্তত ৩০০ মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের দুই-তৃতীয়াংশ বেসামরিক নাগরিক। বহু বছরের মধ্যে এটা ছিল গাজার জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সময়।

গাজার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত ঘনবসতিপূর্ণ জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে হামলায় অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছেন।
ইসরাইলের সামরিক বাহিনী দাবি করছে, সেখানে একজন হামাস কমান্ডারের বাড়ি নিশানা করেছিল তারা। কিন্তু এই হামলায় আশপাশের বাজার এবং বাড়িতে অনেকে নিহত হয়েছে।

গভীর মানবিক সঙ্কট
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, গত শনিবার থেকে এখনো পর্যন্ত গাজায় নিহতের সংখ্যা ৯০০ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ২৬০টি শিশু। আরো সাড়ে চার হাজার আহত হয়েছে।

ঘনবসতিপূর্ণ ছোট গাজায় এমনিতেই মানবিক সঙ্কট আছে। ইসরাইলের এই হামলার মাধ্যমে সেটি আরো গভীর হয়েছে।

হামাসের হামলার পর ইসরায়েল গাজায় সর্বাত্মক অবরোধ দিয়েছে। সেখানে সব ধরনের সরবরাহ বন্ধ করে দেবার পর গাজার ২২ লাখ মানুষের জন্য খাদ্য, জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও পানি দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।

শনিবারের হামলায় ১ হাজার ইসরায়েলি মারা গেছে। এছাড়া আরো দেড়শ থেকে ২০০ ইসরাইলি জিম্মি করে গাজায় নিয়ে এসেছে হামাস।

‘আপনি চিন্তা করতে পারেন যে ২১ শতকে আমরা বিদ্যুৎ ও পানি ছাড়া বসবাস করছি? আমার শিশু সন্তানের ন্যাপি শেষ হয়ে গেছে এবং ওর জন্য মাত্র আধা বোতল দুধ আছে,’ বলছিলেন ওয়াদ আল-মাঘরাবি।

‘আমার শিশু সন্তান কি ইসরায়েলে আক্রমণ করেছিল,’ প্রশ্ন তোলেন তিনি।

গাজার সবচেয়ে বড় সুপার মার্কেটের বাইরে বেশ কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে তারা যা পারছে কিছু খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করে রাখতে চাইছে।

গাজার দক্ষিণাঞ্চলে অধিকাংশ সবজি ও ফল উৎপাদন হয়। জ্বালানি তেলের তীব্র সঙ্কট হওয়ার কারণে সেখান থেকে সবজি ও ফল উত্তরাঞ্চলে পরিবহন করা বেশ কঠিন হয়ে গেছে।

এখনো পর্যন্ত মিশর থেকে কোনো খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ আসেনি। ২০০৭ সালে হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নেবার পর থেকে ইসরাইলের পাশাপাশি মিশরও নিরাপত্তার জন্য মিশর তাদের সীমান্ত বন্ধ রেখেছে।

রাফা ক্রসিং দিয়ে গাজা থেকে মিশরে পালিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। রাফা ক্রসিং দিয়ে প্রতিদিন ৪০০ ব্যক্তিকে গাজার ভেতরে ঢোকা এবং বের হবার অনুমতি দেয়া হয়। সোম ও মঙ্গলবার ফিলিস্তিনের অংশে প্রবেশ পথে বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। ফলে এ পথে আসা-যাওয়া বন্ধ হয়েছে বলে জানান ফিলিস্তিনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

২ লাখের বেশি মানুষ যারা বাড়ি ঘর ছেড়েছে, তারা জাতিসঙ্ঘ পরিচালিত স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে ভয়ে পালিয়েছে আবার অনেকে বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যাবার কারণে আশ্রয় নিয়েছে।

গাজার অনেক বাসিন্দা বিল্ডিং-এর নিচে বেসমেন্টে আশ্রয় নিয়েছে। তবে বোমা হামলার কারণে ভবন ধসে পড়লে তারা বেসমেন্টে আটকে যাবেন। সোমবার রাতে একটি ভবনের বেসমেন্টে ৩০টি পরিবার আটকা পড়েছে।

‘আগের যুদ্ধগুলোতে শহরের এই অংশটি ছিল সবচেয়ে নিরাপদ,’ বলছিলেন রিমাল এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ আল-মাঘরাবি। কিন্তু সোমবার ইসরাইলি বোমা হামলায় দেখা যাচ্ছে যে এখন আর কোথাও নিরাপদ নয়।

সূত্র : বিবিসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *