গাজাভিত্তিক ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের আকস্মিক হামলায় হতভম্ব হয়ে পড়েছে ইসরাইল। আর অত্যন্ত ফলপ্রসূ হামলাটি চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সমীকরণ বদলে দিয়েছে হামাস। এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। শনিবার ইসরাইলি পাল্টা হামলায় অনেক বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হলেও সেটাকে আমলে না নিয়ে ইসরাইলে হামাসের হামলায় তারা উল্লাস প্রকাশ করেছে। এমনকি এক গর্বিত বাবা তার মেয়ে কাঁধে নিয়েও আনন্দ প্রকাশ করছে। অন্যদিকে ইসরাইলিরা পুরোপুরি শোকাভিভূত হয়ে পড়েছে।
আল জাজিরার সিনিয়র রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা বলেছেন, হামাকের বিস্ময়কর হামলাটি মধ্যপ্রাচ্যে এবং বিশ্বে এর সাথে সম্পৃক্তদের ওপর প্রবল প্রভাব ফেলবে।
তিনি বলেন, ‘মাত্র ১০ ঘণ্টায় ইসরাইল ও মধ্যপ্রাচ্যকে হতবিহবল করে দিয়েছে তারা। এই নাটকীয় ১০ ঘণ্টা এই অঞ্চলের জন্য সমীকরণ বদলে দিয়েছে।
তিনি বলেন, এই ঘটনা ফিলিস্তিনি ও ইসরাইল উভয়ের সামরিক ও রাজনৈতিক হিসাব বদলে দিয়েছে। ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে না ইসরাইলকে শত্রু গণ্য করবে, তা নিয়ে তারা নতুন করে চিন্তা করবে।
বিবিসি নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিবেদক ফ্রাঙ্ক গার্ডনার মনে করেন ইসরাইলের সামনে এখন দুটি উপায় খোলা রয়েছে: একটা বিশেষ উদ্ধার আভিযানে নামা অথবা অপেক্ষা করা এবং সমঝোতায় আসা। কিন্তু দুই দিকেই ঝুঁকি রয়েছে।
সম্ভবত পশ্চিম তীরে তোলা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক ব্যক্তি তার মেয়েকে কাঁধে নিয়ে উল্লাস প্রকাশ করছে। মেয়েটি এক হাতে পিস্তল এবং অপর হাতে একটি অ্যাসাল্ট রাইফেল দোলাচ্ছে। তার আশপাশে বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনি আনন্দ প্রকাশ করছে।
গাজাতেও একই ধরনের দৃশ্য দেখা গেছে।
করা হবে না তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করা হবে, তা নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু হবে।
হামাসের সদস্যরা নজিরবিহীন শনিবার সকালে নজিরবিহীন হামলা শুরু করে। তারা প্রথমবারের মতো ইসরাইলের ভেতরে প্রবেশ করে। রকেট নিক্ষেপের পাশাপাশি সমুদ্র, স্থলপথ এবং প্যারাগ্লাইড করে অস্ত্রধারীরা ইসরাইলে ঢুকে পড়ে।
রকেট হামলার জবাবে ইসরাইল হামাসের বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলের দাবি তারা হামাসের ১৭টি সেনা কম্পাউন্ডে হামলা করেছে। ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স আইডিএফ তাদের নিজস্ব সামাজিক মাধ্যম এক্সে জানিয়েছে, তারা এখন পর্যন্ত ১৭টি সেনা কম্পাউন্ড আর হামাসের অপারেশনের চারটি হেডকোয়ার্টারে হামলা করেছে তারা।
এর আগে হামলা শুরুর ঘোষণা দিয়ে হামাস নেতা মোহাম্মদ দেইফ বলেছেন, ‘আমরা বলতে চাই, যথেষ্ট হয়েছে।’
অন্যদিকে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, দখলদার সৈন্য এবং সেটলাররা যে আতঙ্ক তৈরি করেছে সেখান থেকে ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকার রয়েছে নিজেদের রক্ষা করার।
রকেট হামলার পর ইসরাইল হাজার হাজার সংরক্ষিত সেনাদের তলব করেছে। ইসরায়েলের গণমাধ্যম বলছেন, দক্ষিণ ইসরাইলের বিভিন্ন জায়গায় ফিলিস্তিনী বন্দুকধারীদের লড়াই হচ্ছে।
হামাস দাবি করেছে, তারা অন্তত ৩৫ জন ইসরাইলিকে বন্দি করেছে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ইসরাইলের সামরিক মুখপাত্র কোন মন্তব্য করেনি।
ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, তাদের উপর আক্রমণ করে হামাস ‘অনেক বড়’ ভুল করেছে।
ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘প্রতিটি জায়গায় ইসরাইলি সৈন্যরা তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এবং ইসরাইল রাষ্ট্র এতে জয়ী হবে।’
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায় ফিলিস্তিনি অস্ত্রধারীরা ইসরাইলের শহর সদেরতের রাস্তায় পথচারীকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করছে।
এছাড়া অনলাইনে আরেক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সদেরতের রাস্তায় একদল সশস্ত্র ফিলিস্তিনি নিজেদের কালো পোশাকে ঢেকে পিক আপ ট্রাকে করে যাচ্ছে। এছাড়া তাদের ইসরাইলি সৈন্যের সাথেও গুলি বিনিময় করতে দেখা যায়। গাজা থেকে এই শহরের দূরত্ব মাত্র এক মাইল।
ইহুদিদের বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠান সুকত শেষ হবার পরপরই শনিবার ভোর থেকে হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজা অঞ্চল থেকে রকেট হামলা শুরু হয়। হামাস মিডিয়ার মাধ্যমে এক সিনিয়র সেনা কমান্ডার ইসরাইলের বিরুদ্ধে এই অপারেশন শুরুর ঘোষণা দেন, তিনি প্রত্যেক ফিলিস্তিনিকে সবখানে থেকে যুদ্ধে নামার আহবান জানান।
রয়টার্স জানিয়েছে, ইসরাইলি টিভি চ্যানেল রেশেত থার্টিন প্রতিবেদন করেছে যে ফিলিস্তিনি জঙ্গীরা দক্ষিণের শহর ওফাকিমে ইসরাইলিদের বন্দী করে রেখেছ।
সামাজিক মাধ্যমে এ খবর আগেই ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। অসমর্থিত কিছু ভিডিওতে দেখা যায় ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলের বেসামরিক নাগরিকদের ধরে মোটর বাইকে করে গাজার দিকে বন্দী অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে।
তবে হামাসের এক মুখপাত্র আল জাজিরাকে জানান, ‘তারা হোস্টেজ নয় বরং যুদ্ধ বনী।’
ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি।
এরইমধ্যে হামাসের সামরিক অংশ, দ্য কাসিম ব্রিগেড একটা ভিডিও প্রকাশ করেছে যাতে দেখা যাচ্ছে, অন্তত তিনজন ইসরাইলিকে বেসামরিক পোশাকে বন্দ্বী অবস্থায় রেখেছে তারা এবং দাবি করা হয়েছে এই তিনজন ইসরায়েলি সৈন্য।
অন্যদিকে গাজায় সক্রিয় ইসলামিক জিহাদ গ্রুপও দাবি করেছে তারা ‘অসংখ্য’ ইসরাইলি সৈন্যদের বন্দ্বী করেছে।
এরইমধ্যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। সংস্থার কূটনীতি প্রধান জোসেপ বোরেল এটাকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে বন্দ্বীদের মুক্তি দাবি করেছেন।
নিরাপত্তাবিষয়ক বিবিসি সংবাদদাতা ফ্রাঙ্ক গার্ডনার বলেছেন, এটা ইসরাইলি গোয়েন্দা ব্যর্থতা। এরইমধ্যে গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্তও শুরু করেছে ইসরাইলি সরকার, যে কিভাবে হামাসের এত বড় পরিকল্পিত হামলা তাদের নজর এড়িয়ে গেল।
ইসরাইলের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড় এবং দক্ষ। তারা দেশের ভেতরে এবং বাইরে কাজ করে।
ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গ্রুপগুলোর ভেতরেই ইসরাইলি গোয়েন্দারা রয়েছে। এছাড়া সশস্ত্র গ্রুপগুলোর সাথে মিশে আছে। এছাড়া লেবানন, সিরিয়া এবং অন্যান্য জায়গায়ও ইসরায়েলি গোয়েন্দারা সক্রিয়।
অতীতে বিভিন্ন সময় সুনির্দিষ্ট ড্রোন হামালা এবং মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং-এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীর নেতাদের হত্যা করেছিল ইসরাইল। এটা সম্ভব হয়েছিল গোয়েন্দা তথ্যের কারণে।
বিভিন্ন রিপোর্ট সূত্রে বিবিসি জানতে পেরেছে যে ইরান এই ফিলিস্তিনি হামলার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
ইরানের সংবাদ সংস্থা আইএসএনএ-র খবর দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনির উপদেষ্টা ইসরায়েলের উপর ফিলিস্তিনি হামলার পক্ষে কথা বলেছেন।
রহিম সাফাভি বলেছেন, ‘আমরা ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের অভিনন্দন জানাই, যতক্ষণ ফিলিস্তিন ও জেরুজালেমের স্বাধীনতা না আসে আমরা ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের পাশে থাকবো।’
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র শুরুতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এই হামলার নিন্দা জানিয়ে দুই পক্ষকেই সহিংসতা বন্ধের আহবান জানায়। পরবর্তীতে এক বিবৃতিতে দেশটির ডিফেন্স সেক্রেটারি লয়েড অস্টিন বলেন ইসরায়েলের নিরাপত্তা রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
‘আমি গভীরভাবে ইসরায়েলের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। আগামী দিনগুলোতে ইসরায়েলের নিরাপত্তা রক্ষা এবং সহিংসতা ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড থেকে দেশটির বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষায় আমাদের প্রতিরক্ষা বিভাগ কাজ করবে।’
এদিকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ইসরাইলের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেন, ‘আমি সকাল বেলা ইসরায়েলি নাগরিকদের উপর হামাস সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর হামলার খবরে মর্মাহত। ইসরায়েলের তাদের নিজেদের রক্ষা করার সবরকম অধিকার আছে।’
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ তীব্র ভাষায় এই হামলার সমালোচনা করে বলেছেন, ‘আমি ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের প্রতি আমার পূর্ণ সমবেদনা জানাই।’
জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘নিরীহ বেসামরিক লোকদের উপর সহিংসতা ও রকেট হামলা এখনি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।’
তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে ইউরোপিয়ান কমিশনও। সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেয়েন এই হামলাকে ‘জঘন্য সন্ত্রাসী হামলা’ বলে বর্ণনা করেছেন।
রাশিয়ার ডেপুটি পররাষ্ট্র মন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া হলো, ‘আমরা সবসময় সবার সংযত আচরণ আশা করি।’
সূত্র : আল জাজিরা, বিবিসি, রয়টার্স এবং অন্যান্য