তমিজীর জনপ্রতিনিধির খায়েস পূরণ না হওয়াই ক্ষোভের কারণ!

Slider ফুলজান বিবির বাংলা


সাম্প্রতিক সময়ে দেশের টক অব দ্য টাউন হল হক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আদম তমিজী হকের ডিজিটাল অভিযোগ। কখনো মন্ত্রী কখনো এমপি আবার কখনো নেতা এমনকি খোঁদ প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও ক্ষোভ ঝাড়ছেন তিনি। এখন বিদেশে অবস্থান করে প্রায় প্রতিদিনই তমিজী হক ব্যাক্তি প্রতিষ্ঠান দল এমনকি সরকারের বিরুদ্ধেও বক্তব্য দিচ্ছেন। টঙ্গীতে অবস্থিত তার কারখানা থেকে এক হাজার কোটি টাকা লুটের অভিযোগ তার। কোন ব্যাক্তি ক্ষতিগ্রস্থ হলে আইনের আশ্রয় নিবেন। কিন্তু তিনি তা না করে দেশের বাইরে গিয়ে সরকারকে কেন হুমকি দিচ্ছেন এবং তার এই হুমকি বিরোধী দলের খোঁড়াকে যোগান আসা কর্মকান্ডের পিছনে কি কারণ তা অনুসন্ধান করে পাওয়া গেছে নানা ধরণের তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ৭৭ বছরের পুরনো হক গ্রুপ বাংলাদেশে একটি সুনামী প্রতিষ্ঠান। ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত বাংলাদেশী নাগরিক আদম তমিজী হক। এখন থেকে তের বছর আগে তিনি হক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নেন। টঙ্গীতে অবস্থিত হক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান হক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ব্যবসায়িক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি জড়িয়ে যান জনসেবায়। ২০১৭ সালে আদম তমিজী হক কখনো ঢাকার এমপি, কখনো ঢাকা উত্তরের মেয়র আবার কখনো গাজীপুর সিটির মেয়র হওয়ার চেষ্টা করেন তমিজী হক। তমিজী হকের এই ইচ্ছার হালে পানি দিতে বিভিন্ন দলের একাধিক নেতা তমিজী হকের সাথে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন কর্মকান্ডে তাকে যুক্ত করেন। বাংলাদেশ আওয়ামী তাঁতীলীগ ঢাকা উত্তরের উপদেষ্টা হওয়ায় জনপ্রতিনিধির খায়েস পূরণে যারা হালে পানি দেন তাদের মধ্যে আওয়ামীলীগের নেতাই বেশী। এর সাথে বিএনপি ও ইসলামীক দলের পরোক্ষ সহযোগীতাও থাকতে পারে।

জনসেবা করার জন্য মানিবক সোসাইটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন তমিজী হক। এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে জনপ্রতিনিধি হওয়ার যোগ্য করে তোলার চেষ্টা করেন। ২০১৮ সালে গাজীপুর সিটি নির্বাচনের পর মেয়র হন আওয়ামীলীগের তখনকার গাজীপুর মহানগরের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম। আওয়ামীলীগের আভ্যন্তরীন কোন্দলের কারণে জাহাঙ্গীর বিরোধী হিসেবে মাঠে পরিচিত থাকা যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, তার চাচা গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সাবেক সহসভাপতি মতিউর রহমান মতি ও আওয়ামীলীগ নেতা কাউন্সিলর নুরুল হক নুরু সহ একটি গ্রুপ জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে মাঠে নামেন। বঙ্গবন্ধুকে কট্যুক্তি করার অভিযোগে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে রাজপথ যখন উত্তাল তখন আদম তমিজী হককে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন প্রতিমন্ত্রী গ্রুপ। আদম তমিজী হক জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্তও করেন।

অসমর্থিত সূত্র বলছে, জাহাঙ্গীর আলমকে নামিয়ে আদম তমিজী হককে গাজীপুর সিটির মেয়র বানানো হবে এমন আশ্বাস পেয়েছিলেন আদম তমিজী হক। সারা জীবনের খায়েস জনপ্রতিনিধি হওয়ার আশ^াস পেয়ে অনেকটা আবেগ প্রবণ হয়ে যান আদম তমিজী। ২০১৮ ও ২০২৩ এর দুটি নির্বাচনে গাজীপুর সিটির মেয়র হওয়ার কোন সুযোগ তৈরী না হওয়ার ক্ষোভ ছিল তার।

গাজীপুর সিটিকরপোরেশন এলাকায় জনসেবা ও মানবসেবা করতে গিয়ে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালেন তমিজী হক। ব্যাক্তি সংগঠন ও বিভিন্ন অসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ান তিনি। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক খাও -দাও সংস্কৃতি পেয়ে বসে তাকে। ফলে দুই হাতে টাকা বিতরণ শুরু করেন আদম তমিজি হক। তার এই সকল কর্মকান্ডে বেশী জড়িয়ে পড়েন প্রতিমন্ত্রী গ্রুপ। কয়েকভাগে বিভক্ত গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের একটি শক্তিশালী পক্ষের সমর্থন পেয়ে তমিজী হক জনসেবার নামে টাকা বিতরণ সেবায় মগ্ন হয়ে যায়। তখনকার সময়ে গাজীপুরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হক বিস্কুট ছিল আপ্যায়নের প্রধান খাবার।

সূত্র বলছে, স্বপ্নের ঘোরে আদম তমিজী হক গাজীপুর সিটির মেয়র হয়েছেন অনেকবার। রাতে দিনে তিনি শুধু গাজীপুরের মেয়র হয়ে গেছেন প্রায় এমন ধারণা জন্ম নেয় তমিজীর। গাজীপুর সিটি মেয়র হওয়ার লোভে পড়ে ২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কোটি কোটি টাকা খরচ করেন তমিজী হক। সূত্রমতে, তমিজী হকের মেয়র হওয়ার স্বপ্ন পূরণের জন্য মানব সেবার কাজে টাকা খরচের ক্ষেত্রে অনেক সময় অনেক নামী দামী নেতাদের তদ্বিরও ছিল। সব মিলিয়ে গাজীপুর আওয়ামীলীগের একাংশের সমর্থনে তমিজি হক বিপুল অংকের টাকা মাঠে খরচ করেন। এই খরচের পরিমান কত তা বলা মুশকিল হলেও অংকটা ছোট নয় এটা সঠিক।

দায়িত্বশীল সূত্রমতে, তমিজী হকের মানবসেবার সময় টঙ্গীর কারখানার জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন মুশফিকুর রহমান। এই মুশফিকুর রহমানের হাত দিয়েই যাবতীয় খরচ হয়েছে। খরচ করতে করতে কত টাকা খরচ হয়েছে তা আদম তমিজী জানতে পারেন এই কয়েকদিন আগে। এই খবর জেনে মুশফিকুর রহমানকে অফিসে আটকে মারধর করা হয়। এই খবর পেয়ে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের চাচা মতিউর রহমান মতি লোকজন নিয়ে বুধবার(১৩ সেপ্টেম্বর) রাতে টঙ্গীর অফিসে গিয়ে মুশফিকুর রহমানকে জিম্মায় ছাড়িয়ে আনেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একাধিক ভিডিওতে মুশফিকুরকে ছাড়িয়ে আনার সময় ওই অফিসে মতিউর রহমান মতিকে দেখা গেছে। মতিউর রহমান মতির সাথে ওই অফিসে অনেক পুলিশকেও দেখা গেছে। এরপর তমিজী হক নিজের ফেসবুক লাইভে ও স্ট্যাটাসে রাসেল প্রতিমন্ত্রী, তার চাচা ও কাউন্সিলর নুরুল হক নুরুর বিরুদ্ধে এক হাজার কোটি টাকা লুটের অভিযোগ করেন। একই সাথে শনিবার বেলা ২টায় টঙ্গীতে সাংবাদিক সম্মেলন আহবান করেন তমিজী হক। এদিকে শুক্রবার রাত থেকে টঙ্গী আওয়ামীলীগ দফায় দফায় মিছিল করে প্রতিমন্ত্রীকে কট্যুক্তি করার অভিযোগে তমিজী হকের বিচার দাবী করেন। পরিস্থিত উত্তপ্ত হলে শনিবার তমিজী হক টঙ্গীতে আসেননি। আর তমিজী হকের বিচার দাবীতে আওয়ামীলীগ শনিবার বিকেলে টঙ্গী পূর্ব থানা ঘেরাও করে।আর রবিবার দুপুরে তমিজী হক সৌদিআরবের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন।

সোমবার দুপুর পর্যন্ত তমিজী হক আবারো ফেসবুকে সাতবার লাইভে আসেন ও চারটি স্ট্যাটাস দেন। এই সকল স্ট্যাটাস ও লাইভে তিনি আবারো আগের অভিযোগ পুন:ব্যক্ত করেন। তবে এবার তমিজী হক আওয়ামীলীগ সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে কট্যুক্তি করতেও ছাড়েননি। তিনি নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তার অবস্থান জানান দিয়ে বলেন, আমি ইসলামীক লোক। তাই আওয়ামীলীগ এখন আর আমাকে পছন্দ করেন না। এসব স্ট্যাটাসে তমিজি হক হুসিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, ঢাকার গুলশানে আমার দুই স্ত্রী ও পাঁচ সন্তান রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে তমিজী হক বলেন, পারলে আমার স্ত্রী সন্তানকে কিছু কর। একই সঙ্গে তিনি আবারো তার লুট হওয়া এক হাজার কোটি টাকা রাসেল এমপির কাছে ফেরত চান। তিনি আল্লাহর কাছে বিচার দিতে সৌদিআরব হজে গেছেন বলে দাবী করেন। আর তার কর্মী ব্যাংক ও সাপ্লাইয়ার্সদের টাকার জন্য রাসেল প্রতিমন্ত্রীর নিকট যেতে বলেন।

এই সকল বিষয়ে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেছেন, একটি অনলাইনে আমার নমিশেন নিশ্চিত হয়েছে বলে খবর আসার পর থেকেই তমিজী হক মিথ্যা বানোয়াট অভিযোগ করছেন। তার চাচা মতিউর রহমান মতি বলেন, তমিজী হক একজন সাইকো। বুধবার রাতে তমিজী হকের অফিসে গিয়েছিলেন স্বীকার করে মতি বলেন, একজন মানুষকে কয়েকদিন ধরে আটকিয়ে মারধর করে মেরে ফেলা হচ্ছে এই সংবাদ পেয়ে একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আমাকে সেখানে গিয়ে তাকে উদ্ধার করতে হয়েছে। মতি এবং কাউন্সিলর নুরু তাদের বিরুদ্ধে তমিজী হকের আনা অভিযোগ মিথ্যা বানোয়াট দাবী করে বলেন, তমিজীকে দিয়ে অন্য কেউ এই কাজ করাচ্ছে। মতিউর রহমান মতি তাদের একই দলের প্রতিপক্ষ সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে ষড়যন্ত্রের জন্য দায়ী করেন। জাহাঙ্গীর আলম তমিজী হক দিয়ে অপ্রচার চালাচ্ছেন বলে মতিউর রহমান মতির অভিযোগ।

অভিযোগ প্রসঙ্গে বক্তব্য নিতে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে ফোন করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

টঙ্গী পূর্ব থানার পিছনে অবস্থিত হক ইন্ডাস্ট্রিজে গিয়ে দেখা যায়, কারখানা যথারীতি চলছে। টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই সংক্রান্ত কোন অভিযোগ আসেনি। হক গ্রুপেরও কোন সমস্যা নেই। কারখানা চলছে।

একটি গোপন সূত্র বলছে, হক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান থেকে এক হাজার কোটি টাকা লুট ও কারখানা জবরদখল চেষ্টার অভিযোগ এনে হক গ্রুপের পক্ষ থেকে এক বা একাধিক মামলার প্রস্তুতি চলছে। তবে এই বিষয়ে হক গ্রুপের কারো কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *