বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের আরজুমনি স্কুল সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা মুদি দোকানি খলিলুর রহমান আবেদন করেছিলেন সিটি কর্পোরেশনের স্বল্প আয়ের আবাসন প্রকল্পের প্লট বরাদ্দ চেয়ে। কিন্তু তিনি প্লট পাননি। স্ত্রী ও সন্তানের নামে দুটি প্লট পেয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর হোসেন। ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নিউ ভাটিখানা এলাকায় তার নিজস্ব চারতলা ভবন রয়েছে।
খলিলুর রহমান বলেন, প্লটের আবেদনের ক্ষেত্রে প্রথম শর্তই ছিল- যিনি সিটি এলাকায় কোনো বাড়ি, ঘর, ফ্ল্যাট বা আবাসিক জমির মালিক তিনি আবেদনের অযোগ্য। অথচ সাদিক আব্দুল্লাহ যে ২৪০ জনকে প্লট বরাদ্দ দিয়েছেন তাদের সবার এই নগরীতে বাড়ি, গাড়ি, সম্পত্তি রয়েছে।
শুধু খলিলুর রহমান নয়, এমন হাজারো স্বল্প আয়ের বাসিন্দাদের অভিযোগ আবাসন প্রকল্পের অনিয়ম নিয়ে। মূলত নামে স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য আবাসন প্রকল্প হলেও স্বল্প আয়ের মানুষদের প্লট না দিয়ে ধনাঢ্য-কোটিপতিদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর সবগুলো প্লট পেয়েছেন বিদায়ী মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারী রাজনৈতিক কর্মী, নগর ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ছাত্রলীগ নেতা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-সাংবাদিক সংগঠনের লোকেরা। তাদের নিজস্ব জমি, বাড়ি ও সম্পত্তি রয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, খয়ের খাঁদের পুরস্কৃত করতে বিদায়বেলায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন মেয়র সাদিক।
জানা গেছে, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ময়লাখোলা এলাকার ১১ একর জমি ২০১৩ সালে অধিগ্রহণ করেন সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামালের পরিষদ। তিনি আবাসন প্রকল্পের উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। ২০১৮ সালে মেয়র নির্বাচিত হয়ে আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নে হাত দেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদিক আব্দুল্লাহ।
নগর ভবন থেকে জানা গেছে, নিম্নআয়ের মানুষের জন্য উদ্যোগ নেওয়া এই আবাসন প্রকল্পে মোট ২৪০টি প্লট নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে ২ দশমিক ৮৭ শতাংশের ১৩০টি, ২ দশমিক ৪৮ শতাংশের ৪৮টি, ২ দশমিক ৯৮ শতাংশের ৪০টি এবং ৩ শতাংশের ১২টি প্লট। প্রতি শতাংশের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৬ হাজার ৪৩১ টাকা।
প্লট বরাদ্দের বিজ্ঞপ্তি ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। এতে স্বল্প আয়ের মানুষের বসবাসের সুবিধার জন্য ১০ বছরে কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য সুবিধায় প্লট বরাদ্দের বিষয়ে বলা হয়। প্লট বরাদ্দের আবেদন চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিলেও ২০২৩ সালের শুরুতে প্লট বরাদ্দের লটারি প্রক্রিয়া শেষ করা হয় অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে। তবে মেয়রের দায়িত্ব হস্তান্তরের আগে প্লট বুঝে নিতে প্লটপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা প্লটের মোট মূল্যের ২৫ শতাংশ হারে প্রথম কিস্তি পরিশোধ করে বালু ফেলে স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেন। আর তখনই বেড়িয়ে আসে থলের বিড়াল।
এদিকে নগর ভবন থেকে প্লটপ্রাপ্তদের তালিকার জন্য সম্পত্তি শাখায় যোগাযোগের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাস। তিনি নিজেও প্লট পেয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক মো. আনজুমের বাবা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক ধর্মবিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম প্লট পেয়েছেন। অথচ শহীদ আরজু মনি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাশে পাওয়া প্লটের সামনেই তাদের নিজেদের বাড়ি রয়েছে। শুধু তাই নয়, প্যানেল মেয়র গাজী নাঈমুল হোসেন লিটু, মহানগর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক জিয়াউর রহমান, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুমন সেরনিয়াবাত, মেয়রের ব্যক্তিগত সহকারী ও তার শ্যালক মোস্তফা জামান মিলন, মেয়রের ব্যক্তিগত সহকারী-২ শাহরিয়ার রিজন, ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জিয়াউদ্দিন, চিফ অ্যাসোসর মোয়াজ্জেম হোসেন, প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সানজিদ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা রফিক সেরনিয়াবাত এই প্লট পেয়েছেন।
একসঙ্গে চারটি প্লট পেয়েছেন বেসরকারি একটি স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মালিক উত্তর কাউনিয়া এলাকার বাসিন্দা নাসির উদ্দিন সাথী। এছাড়া মেয়র অনুসারী ১১ জন সাংবাদিক পেয়েছেন প্লট। যাদের সকলেরই নিজস্ব সম্পত্তি রয়েছে নগরীতে।
ঝুমুর বেগম নামে এক বাসিন্দা বলেন, আমার শ্বশুরের ২৬ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আবাসনের প্লট পাওয়ার সুযোগ পেলে আমরা ছিলাম সবার আগে। কিন্তু আমরা আবেদনই করতে পারিনি। সাদিক আব্দুল্লাহ তার নিজের লোকদের নামে প্লট বরাদ্দ দিয়েছেন। সম্পূর্ণরূপে অবৈধভাবে তার লোকদের, যাদের দ্বারা নগরী শাসন করেছেন এই পাঁচ বছর তাদের প্লট দিয়েছে।
রাবেয়া বেগম নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, ড্রেন-রাস্তা করবে এমন আশ্বাস দিয়ে আমাদের জমি অধিগ্রহণ করে নেওয়া হয়। এখন দেখছি কোটিপতিদের প্লট দিচ্ছেন সাদিক আব্দুল্লাহ। অথচ আবাসনের প্লট পাওয়ার কথা গরিব-অসহায়দের। তা না করে ছাত্রলীগ নেতা, সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাদিকের লোকদের প্লট উপহার দিয়েছে।
সিটি কর্পোরেশনের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্লট বরাদ্দে ২০ শতাংশের বেশি মেয়র নিজের হস্তক্ষেপে দিয়েছেন। এছাড়া বাকি ৭৯ শতাংশ প্লট রাজনৈতিক বিবেচনায় দিয়েছেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বরাদ্দপ্রাপ্ত প্লটগুলোতে বালু দিয়ে ভরাট, ইটের দেয়াল তোলা ও দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ তুলে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করলে চলতি বছরের ২৯ আগস্ট আদালত তিন মাসের জন্য স্থিতাবস্থা জারি করেন বলে জানিয়েছেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
তিনি জানান, ৮ মার্চ মেয়রসহ চারজনের বিরুদ্ধে রুল জারি করেন আদালত। কিন্তু রুলের কোনো জবাব দেননি বিবাদীরা। ফলে ২৯ আগস্ট আবাসন প্রকল্পের সব কার্যক্রমের ওপর তিন মাসের স্থিতাবস্থা জারি করেন।
স্থিতাবস্থা জারির পরও কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন বরাদ্দ প্রাপ্তরা। তবে স্থানীয়দের বাধার মুখে পুলিশ গিয়ে তা বন্ধ করে দেন বলে জানিয়েছেন কাউনিয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদুজ্জামান।
এ বিষয়ে কথা বলতে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ ফারুক আহমেদের মুঠোফোনে কল করা হলেও তারা রিসিভ করেননি।
তবে বর্তমান মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ বলেছেন, আমি দায়িত্ব এখনো বুঝে পাইনি। দায়িত্ব গ্রহণের পর আবাসন প্রকল্পের বিষয়ে ওঠা অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত করে দেখা হবে। জমি অধিগ্রহণ এবং প্লট বণ্টনে অনিয়ম পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তাছাড়া যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, প্লট বরাদ্দে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, আগামী ১৩ নভেম্বর মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর শেষ কর্মদিবস। এরপরই দায়িত্ব গ্রহণ করবেন তার আপন চাচা আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ।