ডলার সঙ্কটে যথাসময়ে আমদানি দায় পরিশোধ করতে পারছে না ব্যাংক। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলোতে এ সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। সরকারের প্রয়োজনীয় কেনাকাটায় পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলেছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় ডলারের সংস্থান করতে না পারায় বারবার ব্যয় পরিশোধের তারিখ পরিবর্তন করতে হচ্ছে। এতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাংকের সুনাম যেমন ক্ষুণœ হচ্ছে, পাশাপাশি যথাসময়ে এলসির দায় পরিশোধ করতে না পারায় ব্যাংকগুলোর বাড়তি চার্জ গুনতে হচ্ছে। ফলে পণ্যের আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে মূল্যস্ফীতির ওপর।
তহবিল ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বে রয়েছেন এমন একটি সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, সরকারের নির্দেশে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতার আশ্বাসে সরকারের অতি প্রয়োজনীয় পণ্য যেমন ডিজেল, সার, ভোগ্যপণ্যসহ সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের যন্ত্রাংশ আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়। পণ্য আমদানিও করা হয়। কিন্তু দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে এসে হয় বিপত্তি। ব্যাংকের কাছে প্রয়োজনীয় ডলার নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সহযোগিতা করার কথা থাকলেও যথাসময়ে তা করা হয় না। একটি পণ্যের এলসি খুলতে যে পরিমাণ ব্যয় হয় সহযোগিতা করা হয় তার আশি শতাংশ। তাও একবারে নয়। অল্প অল্প করে করা হয়। বাকি ২০ শতাংশ ব্যাংককে সরবরাহ করতে বলা হয়। যেমন গতকাল একটি ব্যাংকের চাহিদা ছিল প্রায় ৫৫ কোটি ডলার। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সহযোগিতা করা হয়েছে ২ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। এভাবে প্রতিদিন ডলারের যে পরিমাণ চাহিদা হচ্ছে, সরবরাহ করা হচ্ছে খুবই কম। আবার ব্যাংকও প্রয়োজনীয় ডলারের সংস্থান করতে পারছে না। কারণ, রেমিট্যান্স সংগ্রহের কথা বলা হয়েছে প্রতি ডলার ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা দরে। আর বিক্রি করতে বলা হয়েছে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা দরে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই দরে কেউ ডেলার লেনদেন করছে না।
আরেকটি সরকারি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, তার ব্যাংক বাফেদা নির্ধারিত দরেই রেমিট্যান্সের ডলার কিনছে। কিন্তু অন্য ব্যাংকগুলো নানা কৌশলে বেশি দরে রেমিট্যান্স আহরণ করছে। ফলে সরকারি ব্যাংক হওয়ায় নির্ধারিত রেট মানতে গিয়ে রেমিট্যান্স আহরণে পিছিয়ে পড়ছে। আবার অন্য ব্যাংক থেকেও ডলার সংগ্রহ করতে পারছে না। যেমন একটি ইসলামী ব্যাংকের টাকার সঙ্কট মেটাতে ধার দেয়া হয়েছিল। ওই ব্যাংকের কাছে ডলার রয়েছে। তার ব্যাংকের দুর্দশার কথা উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট ইসলামি ব্যাংকের কাছে ডলার চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা রেমিট্যান্স আহরণ করতে প্রতি ডলারের পেছনে ব্যয় করছে ১১৩ টাকা। সুতরাং ডলার পেতে হলে ১১৩ টাকা ৩০ পয়সা দিতে হবে। অথচ ১১০ টাকার বেশি দরে তারা ডলার বিক্রি করতে পারবে না। ১১৩ টাকা ৩০ পয়সা দরে ডলার কিনে ১১০ টাকায় বিক্রি করলে প্রতি ডলারে যে ৩ টাকা ৩০ পয়সা লোকসান হবে এর দায় কে নেবে। তিনি জানান, নির্দেশনা মানতে গিয়ে রেমিট্যান্স আহরণে পিছিয়ে পড়ছে, অপরদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও প্রয়োজনীয় ডলার সহযোগিতা পাচ্ছে না সব মিলেই যথাসময়ে ব্যাংকগুলো এলসির দায় পরিশোধ করতে পারছে না। বাধ্য হয়ে ব্যাংকগুলোর বাড়তি জরিমানা গুনতে হচ্ছে বিদেশী ব্যাংকগুলোর কাছে। অপরদিকে, দীর্ঘ মেয়াদে স্থানীয় ব্যাংকগুলোর সুনাম ক্ষুণœ হচ্ছে। এতে পণ্য আমদানির জন্য নতুন এলসি খুলতে বিদেশী অন্য কোনো ব্যাংকের গ্যারান্টি দিতে হচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোর পণ্য আমদানি খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার আগে ব্যাংকগুলোর ডলারের সংস্থান করতে হয়। অর্থাৎ যখন পণ্য আমদানির দায় পরিশোধ করতে হবে তখন কোন উৎস থেকে এ ডলার আসবে তার আগাম কর্মসূচি থাকতে হয়। কিন্তু ব্যাংকগুলো আগাম এ ধারণা না করেই একের পর এক এলসি খুলছে। যখন দায় পরিশোধের সময় আসছে তখন পড়ছে বেকায়দায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দ্বারস্থ হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আগের মতো রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করতে পারছে না। গত অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে ১৪ বিলিয়নেরও ওপরে ডলার বিক্রি করেছে। এ বছরও ডলার বিক্রি করা হচ্ছে, তবে সরকারের অতি প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির দায় পরিশোধে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। গতকাল বৈদেশিক মুদ্রার নীট রিজার্ভ ২১ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অথচ আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে কমপক্ষে নীট রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার সংরক্ষণ করতে হবে। এ পরিস্থিতিতে একসাথে রিজার্ভ থেকে বেশি পরিমাণ ডলার সরবরাহ করা মোটেও সম্ভব হবে না। ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব উৎস থেকেই ডলার সংস্থান করতে হবে।