জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর। এই তিন মাস ইলিশের ভরা মৌসুম বলা হয়। তবে শুরুতে সাগরে আশানুরূপ ইলিশ না পেলেও মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে কাঙ্খিত ইলিশের দেখা পেয়েছে জেলেরা। কিন্তু শেষের দিকে পর্যাপ্ত ইলিশ পাচ্ছে না। আর এ কারণে পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর এলাকার খুচরা বাজার ও পাইকারি মোকামে ইলিশের সরবরাহ কম। যার ফলে মাছের দাম চড়া! এ জন্য নিম্ন আয়ের মানুষদের কাছে ‘জাতীয় মাছটি’ শুধু নামেই শোভা পাচ্ছে। আর মধ্যম আয়ের মানুষ বাজার ঘুরে ঘুরে দর কষাকষি করে এ মাছের স্বাদ নিচ্ছে। তাও নামমাত্র। ইলিশের সরবরাহ কম থাকায় দাম বেশির কারণ হিসেবে দেখছে বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, ইলিশের দাম পাইকারি বাজারে উঠানামা করে। আকার ভেদে বিক্রি হয়। ঐতিহ্যবাহী ইলিশের বড় পাইকারি মোকাম ঢাকার সোয়ারীঘাট। বাজার পরিস্থিতি নিয়ে আজ কথা হয় সোয়ারীঘাটের নাঈম ফিসের পরিচালক মো: সাদ্দাম হোসেন সৈকতের সাথে। তিনি ইলিশের আকার ভেদে বিক্রির বাজার মূল্য জানালেন। এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ ১৩৫০ টাকা, এক কেজি ইলিশ ১২৫০-১৩০০ টাকা, ৬০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১০০০-১২০০ টাকা, ৪০০ থেকে ৫৫০ গ্রামের ইলিশ ৮৫০-৯০০ টাকা এবং জাটকা বিক্রি হয় ৫০০-৬২০ টাকা দরে। আর ইলিশের ওজন দুই কেজি হলে তা বিক্রি হয় ২০০০ টাকায়। পাইকারি বাজারে ইলিশের দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও খুচরা বাজারে দ্বিগুন। কোন উপায় না দেখে কেউ কেউ মাছের রাজাকে ছুঁয়ে দেখেছেন। কেউ বা অন্য প্রজাতির মাছ কিনে বাড়ি ফিরেছেন।
সোয়ারীঘাটের আরেক পাইকারি আড়তদার জানালেন, গত কয়েকদিন ধরে ঘাটে ইলিশ সরবরাহ কম। কিন্তু খুচরা ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি বেশি। যা ইলিশ আসে তারা কাড়াকাড়ি করে নিয়ে যায়। তারা খুচরা বাজারে বেশি দামে বিক্রি করতে পারে। আমরা যে দরে বিক্রি করি তা সবই জেলেরা পায়। আমরা শুধু কমিশন রাখি।
ইলিশের দাম নিয়ে পায়রা বন্দর এলাকার দিনমজুর মোশাররফ সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা ইলিশ বলতে জাটকা মাছকে চিনি। এই মাছ আমাদের ইলিশের স্বাদ দেয়। এহন ইলিশের মৌসুম। এই সময়ে সবাই চায় বড় মাছ খাইতে। হে আর পারি কই। একটা বড় মাছের টাকা দিয়া দুই কেজি গরুর গোশত কেনা যায়। অত টাকা রোজগার নাই। আর শখ মিটাতে পারি না।’
ফল ব্যবসায়ী হাসান বলেন, ‘মহিপুর-আলিপুর থেকে ট্রাক ভরে মাছ মোকামে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে তো খুচরা মাছ বেচে না। তাই খুচরা বাজার থেকে মাছ কেনতে হয়। এহন যে মাছের দাম তার চেয়ে বড় ইলিশ দেখেই শান্তি।
তিনি জানান, তার বাড়িতে চাচতো ভাইয়ের ট্রলার সাগরে মাছ ধরে। অবরোধের সময়ে বাড়ির সব ঘরে একটা-দুইটা করে ইলিশ দেয়। তখন বড় মাছ খাবো।
খুচরা মাছ ব্যবসায়ীরা বললেন, বাজার যখন যেমন আমরা তেমন বেচি। এখন তো সব কিছুর দাম বেশি। বেশি টাকায় মাছ কেনা হলে, বেশি টাকায় বেচি। আর কম কেনা পড়লে কম টাকায় বেচা হয়।
মহিপুর মৎস্য বন্দরের আড়তদারদের সাথে কথা বলে জানা গেল, নিত্যপণ্যের দাম বেশি হওয়ায় জেলেদের দৈনন্দিন খরচ বেড়েছে। এখন মাছ ধরা পড়ছে কম। জেলেরা হিমশিম খাচ্ছে। ইলিশ পর্যাপ্ত ধরা পড়লে তখন দাম কমবে। এখনো জেলেরা ঋণী। তার ওপর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হবে এ মাস শেষেই। মাছ না থাকায় মৎস্য সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পটুয়াখালীতে ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৫৭ হাজার ৯৬৬ দশমিক ৫৫ মেট্রিক টন ও ২০২২-২৩ সনে ৭২ হাজার ৬৩ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ, একোয়াকালচার ও মেরিন সায়েন্স অনুষদের সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘বিগত বছরের তুলনায় এ বছর মাছের প্রাপ্যতা অনেক কম। গণমাধ্যমে দেখলাম সাগরে বিচ্ছিন্নভাবে দুই একজন জেলে ইলিশ পেয়েছে অথচ বাস্তবে ভিন্ন। সবাই যে ইলিশ পেয়েছে বিষয়টি- এমন নয়। ইলিশের জোগান কম থাকার কারণে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। উপকূলে অবৈধ জালের ব্যবহার, জাটকা নিধন এবং ডুবোচরের কারণে ইলিশ কম পাওয়া গেছে। আমি আশঙ্কা করছি, এভাবে যদি জাটকা ধরা পড়ে তাহলে সামনের বছরেও ইলিশের প্রাপ্যতায় ঝুঁকি রয়েছে।’