ডিবি পরিচয়ে গ্রেপ্তারের পর মিলল লাশ

Slider জাতীয়

83837_b1

 

পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করাই কাল হয়ে দাঁড়ায় ব্যবসায়ী মোমেন বক্সের। পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে মামলা দায়েরের পরই ডিবি পরিচয়ে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এর তিন দিন পরেই রাজধানীর পল্লবী এলাকায় লাশ পাওয়া যায় তার। এ ঘটনার পর আবারও পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করতে ভয় পাচ্ছে মোমেনের পরিবার।
গত ৮ই জুলাই মোহাম্মদপুরের তাজমহল সড়ক থেকে ডিবি পরিচয়ে অপহরণ করা হয় মোমেন বক্সকে। অপহরণের প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবী মতিউর রহমান। ওই আইনজীবীর সি ব্লকের তাজমহল সড়কের ৭/৪ নম্বর বাড়ির সামনেই ঘটে এ ঘটনা। আইনজীবীর বরাত দিয়ে মোহাম্মদপুর থানার এসআই মাসুদ পারভেজ ও নিহতের স্বজনরা জানান, মোমেন বক্সকে বিদায় জানাতে গেইট পর্যন্ত গিয়েছিলেন তিনি। ওই গেইটের কাছাকাছি সড়কেই মোমেন বক্সের গাড়ির সামনে ছাই রঙের একটি হাইয়েছ গাড়ি থামে। ওই গাড়ি থেকে চার যুবক বের হয়েই নিজেদের ডিবির লোক পরিচয় দিয়ে মোমেন বক্স ও তার গাড়ি চালক সোহেলকে হ্যান্ডকাপ পরায়। পরে মুখে কালো কাপড় বেঁধে টেনে তাদের গাড়িতে তোলে নিয়ে যায়। মতিউর রহমান জানিয়েছেন, এতো দ্রুত ঘটনা ঘটেছে যে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি। তারা চারজন ছিল। বয়স ৩০ থেকে ৩২ বছর হবে। চুল ছোট ছিল তাদের।
মোমেনের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, কিছু সময়ের মধ্যেই আইনজীবী মতিউর রহমান ফোনে বিষয়টি তাদের জানান। তারপরই ডিবি ও র‌্যাবে খোঁজ নেন তারা। কিন্তু কারও কাছেই মোমেন বক্সের কোন সন্ধান পাননি। পরদিন সকাল ১১টায় মোমেনের ভাগ্নে মনোয়ার হোসেন সুমনকে কল করেন মোমেন বক্সের গাড়ি চালক সোহেল। তিনি ওই সময়ে জানান, তাকে অপহরণের পর ভোরে বসুন্ধরা এলাকা সংলগ্ন তিনশ ফিট রাস্তায় ফেলে গেছে দুর্বৃত্তরা। ফোন পেয়ে তাকে উদ্ধার করে মোহাম্মদপুর থানায় নিয়ে যান মোমেন বক্সের পরিবারের সদস্যরা। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, থানায় সোহেলকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন ওসি। এ সময় সোহেলের কথায় গড়মিল পাওয়া যায়। তিনি প্রথমে ভোরে দুর্বৃত্তরা তাকে ফেলে গেছে জানালেও ওসির কাছে স্বীকার করেন, দুর্বৃত্তদের ভয়ে তিনি মিথ্যা বলেছেন। মূলত অপহরণের প্রায় দুই ঘণ্টা পরে তাকে ছেড়ে দেয় তারা। এরপরেই সন্দেহমূলকভাবে সোহেলকে আটক করে পুলিশ। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সোহেল পুলিশকে জানিয়েছেন গাড়িতে তোলার পরই বেদম প্রহার করা হয়েছে মোমেনকে। এমনকি তাকেও মারধর করা হয়েছে বলে জানান সোহেল। সোহেলকে ছেড়ে দেয়ার আগে তাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে দুর্বৃত্তরা বলেছে, তুই মিরপুরে যাবি না। হুমকিতে ভয় পেয়েই ছেড়ে দেয়ার পরও মোমেনের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি তিনি। রোববার ভোরে লোকমুখে লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে পল্লবী থানায় যোগাযোগ করেন মোমেনের পরিবারের সদস্যরা। পরবর্তীতে মোমেনের লাশ শনাক্ত করেন তারা।
মোমেন বক্স একজন ব্যবসায়ী। পৈতৃক সূত্রেই কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক তিনি। ডিবি পুলিশ পরিচয়ে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর তার লাশ উদ্ধারের ঘটনায়  দেশব্যাপী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। কারা, কেন তাকে হত্যা করেছে এই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে জনমনে। গতকাল সরজমিনে মোমেন বক্সের বাড়িতে গেলে দেখা যায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। বাড়ির আঙিনায় পারিবারিক কবরস্থানেই দাফন করা হয়েছে মোমেন বক্সকে। বাড়ির আঙিনায় বসেই কথা হয় মোমেন বক্সের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। শোকে নিস্তব্ধ মোমেন বক্সের স্ত্রী নার্গিস আক্তার। তিনি কোন কথা বলতে পারছিলেন না। কান্নার মতো করে চিৎকার করছিলেন কখনও কখনও। নার্গিস আক্তার বলছিলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে মামলাটাই কাল হলোরে। পুলিশ আমার স্বামীকে কেড়ে নিছে। মোমেন বক্সের ভাগ্নির জামাই মুহাম্মদ মিনাল জানান, গত ২৮শে জুন নিহতের ভাগ্নি লাবনী আক্তার বাদি হয়ে পল্লবী থানার এসআই জাহিদুল ইসলাম ও জুবায়ের হোসেনসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চাঁদাবাজির মামলা করেন। সূত্রে জানা গেছে, ১২ই মে বুড়িরটেক এলাকায় মোমেন বক্সের জমি দখলের চেষ্টা চালায় আলী নগর এলাকার শাইনুদ্দিন ও তার লোকজন। সূত্রমতে, শাইনুদ্দিন মোমেন বক্সের আত্মীয়। এ ঘটনায় মোমেন বক্সের ভাগ্নে রাজিব গুরুতর আহত হয়। পরবর্তীতে ঘটনাস্থল থেকে আধা কিলোমিটার দূরে চঞ্চল নামক কলেজছাত্রের লাশ উদ্ধার হয়। এরপরেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে মোমেন বক্সের ভাগ্নির জামাই মিনালকে গ্রেপ্তার করেন এসআই জাহিদ। ওই সময়ে তিনি এক লাখ টাকা উৎকোচ দাবি করেন। অন্যথায় তাকে চঞ্চল হত্যা মামলায় জড়ানো হবে বলে হুমকি দেন। টাকা দিতে দেরি হলে তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে রিমান্ডের আগে উৎকোচ দাবি করেন এসআই জাহিদ। ওই সমেয় বাধ্য হয়ে ৫০ হাজার টাকা উৎকোচ দেয়া হয়। মিনাল জানান, চঞ্চল সম্পর্কে কিছুই জানতেন না তারা। চঞ্চল বা তার স্বজনরা তাদের প্রতিপক্ষও না। অথচ এই মামলাতেই শেষ পর্যন্ত মোমেন বক্সসহ তাদের জড়ানো হয়। এতে প্রতিপক্ষ ও পুলিশের ইন্ধন ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, উৎকোচ আদায়ের জন্যই আমাদেরকে মামলায় জড়ানোর ভয় দেখাতো পুলিশ। তিনি জানান, এসআই জাহিদ ৫০ হাজার টাকা উৎকোচ পাওয়ার পর তার পিতা আহমেদুর সর্দারকে গ্রেপ্তার করে উৎকোচ দাবি করে পল্লবী থানার এসআই জুবায়ের হোসেন। তাৎক্ষণিকভাবে এসআই জুবায়েরকে নগদ ২১ হাজার টাকা দিলে  থানায় নিয়ে যাওয়ার আগেই ছেড়ে দেয়া হয় তাকে। মিনাল জানান, এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েই পুলিশের দুই এসআই ও অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা করেন তার স্ত্রী লাবনী আক্তার।
লাবনী জানান, মামলা দায়েরের পরই পুলিশ হয়তো তার মামাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু তা যাতে কেউ বুঝতে না পারে এজন্য অভিনয়ও করেছেন এসআই জাহিদ। লাবনী জানান, মামলা দায়েরের পর এসআই জাহিদ তাদের বাড়িতে যান। কৃতকর্মের জন্য মোমেন বক্সের বৃদ্ধা মায়ের কাছে ক্ষমা চান। এ সময় জাহিদ বলেছিলেন, উপরের নির্দেশে মোমেন বক্সের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হয়েছে।
এসব বিষয়ে এসআই জুবায়ের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, গ্রেপ্তার করলেই যদি মামলা হয়ে যায় তাহলেতো কোন অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে পারবে না পুলিশ। তিনি জানান, চাঁদাবাজির অভিযোগ ভিত্তিহীন। অন্যদিকে এ বিষয়ে এসআই জাহিদের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, বর্তমানে ডিবিতে রয়েছেন তিনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দাদন ফকির বলেন, দিনের বেলায় প্রকাশ্যে একজনকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। সেখানে একজন আইনজীবী প্রত্যক্ষদর্শী রয়েছেন। তিনি নিশ্চয়ই চিনতে পারবেন কারা তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে।
মোমেন বক্সের পরিবারের সদস্যরা জানান, ৮ই জুলাই সকালে নিজের নোয়া গাড়ি নিয়ে চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের উদ্দেশ্যে বের হন মোমিন বক্স। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ছোট ভাই আতিক বক্স, এলাকার দুই ব্যক্তি হায়দার ও শহীদ। গাড়ি চালাচ্ছিলেন সোহেল। সকাল ৯টার পরেই আদালতে পৌঁছেন তারা। পরে সোহেলকে নিয়ে মোহাম্মদপুরে তাজমহল সড়কে আইনজীবী মতিউর রহমানের বাসায় যান। নিহত মোমেন বক্সের দুই সন্তান রয়েছে। গত রোববার সকালে কালশীর বাউনিয়া বাঁধ সড়কের একটি সেতুর নিচে নালা থেকে মোমেন বক্সের লাশ উদ্ধার করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *