চাকরির বিধিতে নেই। তবু প্রতিদিনই মধ্যাহ্নভোজের (লাঞ্চ) ভাতা তুলেছেন কর্মকর্তারা। সব মিলিয়ে ৪ কোটি ২৩ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। এ কাণ্ড ঘটেছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে (রাকাব), যা উঠে এসেছে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের অডিট প্রতিবেদনে। এতে এই অর্থ ব্যয়কে আর্থিক ক্ষতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং সুপারিশ করা হয়েছে ব্যয়কৃত এ অর্থ আদায় করার।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় গ্রেড থেকে দশম গ্রেডের কর্মকর্তারা দৈনিক ভিত্তিতে মধ্যাহ্নভোজের ভাতা পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু বিধি লঙ্ঘন করে কর্মকর্তাদের লাঞ্চভাতা হিসেবে এ বিপুল পরিমাণ টাকা দেওয়া হয়েছে। ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে রাকাবের প্রধান কার্যালয় এবং এর আওতাধীন ৪০টি শাখায় এমন ঘটনা ঘটেছে। প্রতিদিনের জন্য জনপ্রতি ২০০ টাকা করে লাঞ্চভাতা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ দুই অর্থবছরে একজন কর্মকর্তা কেবল লাঞ্চভাতাই পেয়েছেন ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা। লাখ টাকারও বেশি লাঞ্চভাতা প্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা অর্ধশতাধিক। তবে উপরোল্লিখিত দুই অর্থবছরে স্রেফ দুদিনের লাঞ্চভাতা হিসাবে ৪০০ টাকা করে তুলেছেন দুই কর্মকর্তা, যা ব্যতিক্রম। প্রতিবেদনটি চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতির কাছে দাখিল করা হয়।
রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নীরঞ্জন চন্দ্র দেবনাথ আমাদের সময়কে বলেন, ‘লাঞ্চভাতা প্রদান নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। এটার আইনি ব্যাখ্যা নিয়ে একটু ভুল বোঝাবুঝি আছে। আইনের মধ্যে থেকেই এ ভাতা দেওয়া হয়েছে। যদিও আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। কাগজপত্র দেখে এ বিষয়ে বলতে হবে। অডিট আপত্তির বিষয়ে আমরা উপযুক্ত জবাব দেব। তা হলে বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের অডিট প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রের বিশেষায়িত এই ব্যাংকের নিরীক্ষাকালে লাঞ্চ সাবসিডি রেজিস্ট্রার ও বিল ভাউচার পর্যালোচনায় ধরা পড়েছে, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় গ্রেড থেকে দশম গ্রেডের কর্মকর্তাদের অনুকূলে প্রত্যেক কর্মদিবসে উপস্থিতির জন্য ২০০ টাকা হারে লাঞ্চভাতা প্রদান করে আসছে। কিন্তু চাকরি (ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান) (বেতন ও ভাতাদি) আদেশ ২০১৫-এর অনুচ্ছেদ ২০ অনুযায়ী ১১তম গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীরা মাসিক ২০০ টাকা হারে টিফিন ভাতা পাবেন। কাজেই দ্বিতীয় গ্রেড হতে দশম গ্রেডের কর্মকর্তারা কোনোভাবেই লাঞ্চভাতা পাবেন না। এ ছাড়া দৈনিক ভিত্তিতে এমন ভাতার সুযোগ নেই। রাকাব কর্তৃপক্ষ যা করেছে তা চাকরি (ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান) (বেতন ও ভাতাদি) আদেশ ২০১৫-এর লঙ্ঘন। এতে দুই অর্থবছরে ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৪ কোটি ২৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬শ টাকা।
অডিটকালে এ বিষয়ে আপত্তি তোলা হলে এর জবাবে সংশ্লিষ্টরা প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক লাঞ্চ সাবসিডি প্রদান করা হয়েছে দাবি করে অভিযোগ নিষ্পত্তির অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু এ জবাব আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য সহায়ক নয়। ব্যাংকের জবাবের সমর্থনে কোনো প্রমাণও তারা হাজির করতে পারেননি। এটি গুরুতর আর্থিক অনিয়ম- উল্লেখ করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে ২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারি চিঠি দেওয়া হয়। এরপর তাগাদাপত্রও দেওয়া হয়। কিন্তু এসবের কোনো জবাব না মেলায় গত বছরের ১ মার্চ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আধা-সরকারি পত্র দেওয়া হয়। এরও কোনো সুরাহাজনক জবাব মেলেনি।
কার্যালয়ভেদে ভোজনব্যয়
রাকাবের প্রধান কার্যালয় এবং এর আওতাধীন ৪০টি শাখায় ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে মধ্যাহ্নভোজের জন্য ৪ কোটি ২৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬শ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। অডিট প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী কার্যালয়ভেদে ভোজনব্যয়-
রাকাব প্রধান কার্যালয়ে ১ কোটি ৭০ লাখ ২০ হাজার ২০০ টাকা, স্থানীয় মুখ্য কার্যালয় (রাজশাহী) হতে ১৯ লাখ ৬৬ হাজার ৮০০ টাকা, ঢাকা করপোরেট শাখা হতে ১৩ লাখ ১৯ হাজার টাকা, বগুড়ার সান্তাহার শাখা হতে ৩ লাখ ৭২ হাজার ৪০০ টাকা, বড়াইহাট শাখা হতে ৯৬ হাজার টাকা, কাহালু শাখা হতে ৩ লাখ ৬৩ হাজার ৬০০ টাকা, শেরপুর শাখা হতে ৫ লাখ ৮ হাজার ২০০ টাকা, সারিয়াকান্দি শাখা হতে ১ লাখ ৫৯ হাজার ২০০ টাকা, গাবতলী শাখা হতে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৮০০ টাকা, দুপচাঁচিয়া শাখা হতে ২ লাখ ৫৬ হাজার ৮০০ টাকা লাঞ্চভাতা তোলা হয়েছে। একইভাবে জয়পুরহাটের কালাই শাখা হতে ২ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ টাকা, পাঁচবিবি শাখা হতে ৪ লাখ ৮ হাজার ৮০০ টাকা, আক্কেলপুর শাখা হতে ৩ লাখ ৭০ হাজার ২০০ টাকা, পুরানাপৈল শাখা হতে ২ লাখ ১৫ হাজার ৮০০ টাকা, নওগাঁ শাখা হতে ১২ লাখ ১৪ হাজার ৬০০ টাকা, রাণীনগর শাখা হতে ২ লাখ ৮৪ হাজার ২০০ টাকা, হাটচক গৌরী শাখা হতে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৮০০ টাকা, নিয়ামতপুর শাখা হতে ৪ লাখ ৩৩ হাজার ২০০ টাকা, মহাদেবপুর শাখা হতে ৬ লাখ ৫১ হাজার ৮০০ টাকা লাঞ্চভাতা পরিশোধ করা হয়েছে। লাঞ্চভাতা হিসেবে সিরাজগঞ্জ জোনাল কার্যালয় হতে ৩ লাখ ১১ হাজার ২০০ টাকা, তাড়াশ শাখা হতে ৩ লাখ ১৩ হাজার টাকা, বেলকুচি শাখা হতে ১ লাখ ৯১ হাজার ৬০০ টাকা, পাবনার কাশিনাথপুর শাখা হতে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮০০ টাকা, নাটোরের সিংড়া শাখা হতে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৪০০ টাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ শাখা হতে ৮ লাখ ৭০ হাজার ২০০ টাকা, নাটোর শাখা হতে ১০ লাখ ৫৯ হাজার ২০০ টাকা, বগুড়া শাখা হতে ১৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, সিরাজগঞ্জ শাখা হতে ১২ লাখ ১ হাজার ৪০০ টাকা, পাবনা শাখা হতে ১১ লাখ ৫১ হাজার ৪০০ টাকা প্রদান করা হয়। পঞ্চগড় শাখা হতে ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৬০০ টাকা, ঠাকুরগাঁও শাখা হতে ৬ লাখ ৮৫ হাজার ৬০০ টাকা, দিনাজপুর শাখা হতে ৬ লাখ ৬৮ হাজার ২০০ টাকা ও বীরগঞ্জ শাখা হতে ৪ লাখ ৫৬ হাজার ২০০ টাকা লাঞ্চভাতা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও নীলফামারী শাখা হতে ৬ লাখ ৩৬ হাজার ২০০ টাকা, সৈয়দপুর শাখা ৪ লাখ ৫৯ হাজার টাকা, লালমনিরহাট শাখা হতে ৭ লাখ ৯০ হাজার ২০০ টাকা, কুড়িগ্রাম শাখা হতে ৬ লাখ ৫৭ হাজার ৮০০ টাকা, রংপুর শাখা হতে ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৮০০ টাকা, মিঠাপুকুর শাখা হতে ৫ লাখ ৪৩ হাজার ৪০০ টাকা, গাইবান্ধা শাখা হতে ১১ লাখ ৫৭ হাজার ৮০০ টাকা এবং গোবিন্দগঞ্জ শাখা হতে ৯ লাখ ১৭ হাজার ৪০০ টাকা এ খাতে প্রদান করা হয়েছে।
কোন কর্মকর্তা কত তুলেছেন?
সর্বাধিক লাঞ্চভাতা তুলেছেন গাইবান্ধা শাখার তৎকালীন কর্মকর্তা একেএম শামসুজ্জামান। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ৭১০ দিনের জন্য তিনি লাঞ্চভাতা তুলেছেন ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা, সিরাজগঞ্জ শাখার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সদুরুজ্জামান ৭০২ কর্মদিবসের জন্য লাঞ্চভাতা তুলেছেন ১ লাখ ৪০ হাজার ৪০০ টাকা, লালমনিরহাট শাখার ব্যবস্থাপক সাহেব উদ্দীন ৬৮৬ দিনের জন্য তুলেছেন ১ লাখ ৩৭ হাজার ২০০ টাকা, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মাকসুদা বেগম ৬৭৮ কর্মদিবসের জন্য লাঞ্চভাতা তুলেছেন ১ লাখ ৩৫ হাজার ৬০০ টাকা। এর পরই শীর্ষে আছেন নওগাঁ শাখার তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা খলিলুর রহমান ৬৫৭ কর্মদিবসের জন্য লাঞ্চভাতা তুলেছেন ১ লাখ ৩১ হাজার ৪০০ টাকা, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এস মোজাম্মেল এম হক ৬৩৮ দিনের ১ লাখ ২৭ হাজার ৬০০ টাকা, মুখ্য কর্মকর্তা জীবন মজুমদার ৬২৬ কর্মদিবসের জন্য ১ লাখ ২৫ হাজার ২০০ টাকা, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মোছা. ঝরনা বেগম ৬২৫ দিনের ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা, সেকেন্ড অফিসার নুরুন নাহার ৫৯২ দিনের ১ লাখ ১৮ হাজার ৪০০ টাকা, কর্মকর্তা আব্দুর রহিম ৫৮৩ দিনের ১ লাখ ১৬ হাজার ৬০০ টাকা, উর্ধ্বতন মুখ্য কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন ৪৫৩ কর্মদিবসের জন্য ১ লাখ ৮ হাজার ৬০০ টাকা। এই সৌভাগ্যবানদের তালিকায় আরও আছেন মহাদেবপুর শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক চিত্তরঞ্জন বসাক ৫১৩ দিনের লাঞ্চভাতা তুলেছেন ১ লাখ ২ হাজার ৬০০ টাকা, সেকেন্ড কর্মকর্তা রুহুল আমিন ১ লাখ ৩ হাজার ২০০ টাকা, রাজশাহীর স্থানীয় মুখ্য কর্মকর্তা তসিকুল আলম ৫৬৭ দিনের ১ লাখ ১৩ হাজার ৪০০ টাকা, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান ৫৯৫ দিনের ১ লাখ ১৯ হাজার টাকা, কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন ৬৫৯ দিনের ১ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ টাকা। রাকাবের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের তৎকালীন কর্মকর্তা গৌতম কুমার ৪৭৫ দিনের লাঞ্চভাতা তুলেছেন ৯৫ হাজার টাকা, বাজেট ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণ বিভাগের ঊর্ধ্বতন-মুখ্য কর্মকর্তা সরকার নাইমুন নাহার ৪৩৯ দিনের ৮৭ হাজার ৮০০ টাকা, গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের ঊর্ধ্বতন-মুখ্য কর্মকর্তা রেজা তফিকুল ইসলাম ৪৬৪ দিনের ৯২ হাজার ৮০০ টাকা।