চার বছরের ব্যবধানে এবার ফের প্রাণঘাতী হয়ে পড়েছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস। উপরন্তু দেশের সবকটি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। শহরের চেয়ে গ্রামের পরিস্থিতি বেশি নাজুক। সরকারের সর্বশেষ হিসাবে, চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৬ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে; আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে এক লাখ ত্রিশ হাজার। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি প্রকৃত সংখ্যা নয়। প্রকৃত সংখ্যা এর কয়েকগুণ। দেশে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা অতীতের যে কোনো সময়কে অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে।
বিশ্বের ৭০টি দেশে ছড়িয়েছে ডেঙ্গুর সংক্রমণ। সংক্রমিত এসব দেশের মধ্যে ২৫ শতাংশ মৃত্যুই বাংলাদেশে। আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুহারের দিক থেকেও বাংলাদেশের ধারেকাছে আর কোনো দেশ নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর বাহক এডিসের আচরণ বদলালেও মশা নিয়ন্ত্রণে দেশের প্রচলিত কর্মসূচি বদলায়নি। সময়মতো মশা মারতে না পারার বিষয়টি এডিসের বিস্তারে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে, ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি দিন দিন গুরুতর হচ্ছে। সামনে পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হতে পারে। এর পাশাপাশি রয়েছে- ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় নির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা মানছেন না চিকিৎসকরা। তদুপরি রয়েছে সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাব।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে মোট আক্রান্ত রোগীর ৯১ শতাংশই গত দুই মাসে। সে অনুযায়ী জুলাই ও আগস্টে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ১৫ হাজার ৮৩০ জন। এ সময়ে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন ৫৪৬ জন, যা চলতি বছরের মোট মৃত্যুর ৮৮ শতাংশ।
গত ১৮ আগস্ট ছেলে আরাফাতকে এবং ঠিক এক সপ্তাহ পর অর্থাৎ ২৫ আগস্ট মেয়ে রাইদাকে হারিয়েছেন মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতি। ডেঙ্গুতে প্রাণের চেয়েও প্রিয় দুই সন্তানকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ রাজধানীর পাইকপাড়ার এ দম্পতি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৪ আগস্ট ৯ বছর বয়সী আরাফাতের হালকা জ্বর দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাওয়ানো হয়। পরদিন তার রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। প্লাটিলেট ভালো থাকায় তাকে হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন নেই, সে সময় জানান চিকিৎসক। কিন্তু পরদিনই আরাফাতের প্লাটিলেট দ্রুত কমে যেতে থাকে। ১৮ আগস্ট হাসপাতালে নেওয়া হয় শিশুটিকে। কিন্তু ততক্ষণে সব চিকিৎসার ঊর্ধ্বে চলে গেছে সে। হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক জানান, আরাফাত বেঁচে নেই। একই সময়ে ডেঙ্গুর শিকার হয় রাইদাও। ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালের পিআইসিইউতে ভর্তি করা হয় তাকে। পাঁচ দিন চিকিৎসার পর অবস্থার উন্নতি হলে বাসায় নেওয়া হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সে আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। মহাখালীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় রাইদাকে। সেখানেই ২৫ আগস্ট মারা যায় সাড়ে ছয় বছরের শিশুটি।
সে সময়ে এ দুই শিশুর বাবা মোহাম্মদ ইব্রাহিম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমার ছেলেমেয়ের হায়াত ছিল না, সৃষ্টিকর্তা তাদের নিয়ে গেছেন।’ এরপরই তিনি যোগ করেন, ‘কিন্তু এ দেশের অধিকাংশ হাসপাতালেরই খুব খারাপ দশা। টাকা থাকলেও ভালো চিকিৎসা না পেয়ে আমার মেয়েটা মারা গেছে। আর ছেলের তো চিকিৎসা করানোর সময়ই পাইনি!’
ডেঙ্গু আক্রান্ত ঐতিহ্য (১০) আইসিইউতে, তার বাবা আজিজুল হক মাথায় হাত রেখে বসে আছেন। ছেলে সুস্থ হয়ে ফিরতে পারবে কিনা, তা নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন রাজধানীর মিরপুরের এ বাসিন্দা। গতকাল রবিবার বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়।
আজিজুল হক এদিন আমাদের সময়কে বলেন, ‘পাঁচ দিন আগে আমার ছেলের জ্বর শুরু হয়। এর দুই দিন পর নাক দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হয়। পরে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে ওষুধ দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু এরপরও অবস্থা গুরুতর হয়ে গেছে। তাই দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। শুরুতে ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়েছিল। কিন্তু অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় আজ আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে।’
শুধু এই তিন শিশুই নয়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় এমন নাজুক অবস্থা গোটা দেশেই; ডেঙ্গু আক্রান্ত বয়স্কদের অবস্থাও দ্রুতই জটিল হয়ে যাচ্ছে। বেশি মৃত্যুর ৪ কারণ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ৪টি কারণে এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার এতো বেশি।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম আমাদের সময়কে বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় এবার ডেঙ্গু সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামনের বছর আরও ভয়ংকর চিত্র দেখা যাবে। বিশেষ করে শিশু ও নারীদের অবস্থা গুরুতর হচ্ছে। শিশুরা বলতে পারে না, আর নারীদের একদিকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, অন্যদিকে রয়েছে চিকিৎসাজনিত অবহেলা। এবার ডেঙ্গুতে এত বেশি মৃত্যুর পেছনে আরও রয়েছে- দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি, ম্যানেজমেন্ট বিশেষ করে সঠিকমাত্রায় ফ্লুয়েড দিতে না পারা ও ওভার ফ্লুয়েড, নারীদের ভিটামিন ডির অভাব।
৬৪ শতাংশেরই মৃত্যু শক সিনড্রোমে
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশে চলতি বছর যেসব ডেঙ্গু রোগী মারা গেছে তাদের ৬৪ শতাংশ হয়েছে শক সিনড্রোমে। ঢাকায় মৃত্যু বেশি হলেও শক সিনড্রোমে সবচেয়ে বেশি ৭৩ শতাংশ মৃত্যু হয়েছে ঢাকার বাইরে। ঢাকায় এই হার ৬৩ শতাংশ। আর আক্রান্তদের শরীরের সবচেয়ে বেশি ৬২ শতাংশ পাওয়া গেছে ডেন-২। এ ছাড়া ২৯ শতাংশের দেহে ডেন-৩ এবং ১০ শতাংশের মাঝে মিলেছে ডেন-২ ও ৩ সেরোটাইপ বা ধরন।
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্থা ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোলের (ইসিডিসি) তথ্যমতে, গত ২৩ আগস্ট পর্যন্ত বিশে^র ৭০টি দেশে ৩৭ লাখ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন দুই হাজার জন। শীর্ষ আক্রান্ত দেশের মধ্যে ব্রাজিল, বলিভিয়া ও আর্জেন্টিনার নাম রয়েছে। তবে প্রাণহানির হার এসব দেশে অনেক কম। সংস্থাটির তথ্যমতে, বিশে^ মোট ডেঙ্গু রোগীর প্রায় ৩ শতাংশ বাংলাদেশে। তবে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি এখানে। মোট মৃত্যুর ২৫ শতাংশই এশিয়ার এ দেশটিতে।
ইসিডিসির তথ্যমতে, ব্রাজিলে আক্রান্তদের মধ্যে মত্যুহার ০.০৭ শতাংশ, পেরুতে ০.৩০, আর্জেন্টিনায় ০.০৫, মালয়েশিয়ায় ০.০৭, বলিভিয়ায় ০.৩০ এবং আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারতে ০.১০ শতাংশ। আর বাংলাদেশে এ হার ০.৫০ শতাংশ।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ইউনিভার্সেল মেডিক্যাল কলেজ গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান অধ্যাপক ডা. রিদওয়ানুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘আক্রান্তের অন্তত শূন্য দশমিক ৫ থেকে ১ শতাংশ মারা যাবেই। তবে সরকারিতে না হলেও বেসরকারিতে রোগী ম্যানেজমেন্টে সমস্যা হচ্ছে। এতে করে মৃতের সংখ্যা বেশি হচ্ছে। পাশাপাশি অনেকে আক্রান্ত হলেও হাসপাতালে যেতে চান না। আর নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক কম। তাই, তাদের মৃতের হার বেশি।’
গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। সব মিলিয়ে চলতি বছর মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৬৩৪ জনে ঠেকেছে। একই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত ২ হাজার ৬০৮ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম ব্যুরোর গতকাল পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঝর্না রাণী দত্ত নামে এক নারী পোশাককর্মীর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, একই সময়ে ১২৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।