প্রায় ৮ মাস আগের একটি কার্যবিবরণী দেখিয়ে গতকাল মঙ্গলবার সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ নিজেকে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা দিয়েছেন। তার চেয়ারম্যান হওয়া সংক্রান্ত চিঠি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে ছড়িয়ে পড়লেও খোদ রওশন এরশাদই জানেন না। তার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ নয়া দিগন্তকে বললেন, চিঠিটি কিভাবে গেল বিষয়টি আমিও জানি না, ম্যাডামও (রওশন এরশাদ) জানেন না।
পার্টির মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নু এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘এই খবর ভুয়া। আমাদের দলের গঠনতন্ত্রে এভাবে কারো চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ নেই।’
২০১৯ সালে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ মারা যাওয়ার পর তার ভাই প্রথমে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং পরে কাউন্সিলের মাধ্যমে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক করা হয় রওশন এরশাদকে। একইসাথে তিনি সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা এবং জিএম কাদের উপনেতার দায়িত্বে রয়েছেন। রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান করা সংক্রান্ত খবরটি এমন সময় এলো যখন জিএম কাদের তিন দিনের সফরে ভারতে রয়েছেন। আজ বুধবার তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে।
মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া রওশনের চেয়ারম্যান হওয়া সংক্রান্ত খবরের পাশাপাশি একটি চিঠি ও একটি কার্যবিবরণী শেয়ার করেন কাজী লুৎফুল কবির ও কাজী শামসুল ইসলাম রঞ্জন। জাতীয় পার্টির প্যাডে রওশন এরশাদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ‘আমি বেগম রওশন এরশাদ, এমপি জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কো-চেয়ারম্যান এই মর্মে ঘোষণা করছি যে পার্টির সিনিয়র নেতাদের পরামর্শ ও সিদ্ধান্তক্রমে দলের গতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে দলের চেয়াম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম।’
এর সাথে আরো একটি কার্যবিরণীয় শেয়ার করা হয়। এতে বৈঠকের তারিখ হিসেবে ৭ ডিসেম্বর, ২০২২ উল্লেখ রয়েছে। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তবলীতে বলা হয়, ‘মামলা-মোকাদ্দমায় জাতীয় পার্টির চলমান অচলাবস্থা নিরসনে পার্টির চারজন কো-চেয়ারম্যান দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ এমপিকে সঙ্কট উত্তরণের ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নে উল্লেখিত পার্টির চারজন কো-চেয়ারম্যান প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ এমপিকে দলের ক্রান্তিকাল মোকাবেলায় অস্থায়ী ভিত্তিতে পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব অর্পন করেন।’
কার্যবিবরণীতে চারজন কো-চেয়ারম্যান যথাক্রমে- এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশিদ এমপি, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি, সালমা ইসলাম এমপি এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসরিন জাহান রত্মা এমপি (হাওলাদারের স্ত্রী) ও সফিকুল ইসলাম সেন্টুর স্বাক্ষর রয়েছে।’ এতে নিচের দিকে বেগম রওশন এরশাদের স্বাক্ষর রয়েছে। স্বাক্ষরের তারিখ হিসেবে ২২ আগস্ট ২০২৩ (মঙ্গলবার) উল্লেখ রয়েছে।
এদিকে, রওশন এরশাদের জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হওয়ার খবরটি মুহূর্তেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এতে দলের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যে কেউ ইচ্ছা করলেই চেয়ারম্যান হতে পারবে না। যে কাউকেই অব্যাহতি দেয়া যাবে না। নিয়ম আছে, সেই নিয়মের মধ্যে পড়তে হবে। জাতীয় পার্টি গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছে। আমার মনে হয়- কিছু ব্যক্তি যারা দল থেকে বহিষ্কৃত তারা ম্যাডামের (রওশন) নামটা ব্যবহার করে ফেক নিউজ দিয়েছে। সারাদেশের জাতীয় পার্টির নেতাকর্মী ও মানুষকে অনুরোধ করবো, এ ধরনের কোনো ঘটনা জাতীয় পার্টিতে ঘটেনি বা কোনো সুযোগ নেই।
মজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘যাদের স্বাক্ষর করার কথা বলা হচ্ছে, তাদের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত বা সিদ্ধান্তের সহযোগিতা করেননি। কোনো স্বাক্ষর দেয়ার প্রশ্নই আসে না। দলের বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিনি এটি শুনে “হাস্যকর” বলেছেন।’
সভার কার্যপত্রে স্বাক্ষর থাকা জাপার কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, এ বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই এ ধরনের ষড়যন্ত্র হতে থাকে। আমরা তো জন্ম থেকেই জ্বলছি। এটি ফেস করে আসছি। সামনে নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে সমস্যা আরো আসবে। এসব বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি।
আরেক কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ উদ্ভট, বানোয়াট ও মিথ্যা। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের সাহেব আছেন, থাকবেন। বেগম রওশন এরশাদ ম্যাডাম আমাদের মায়ের মতো। তিনি আমাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক।’
এ বিষয়ে অপর দুই কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদার ও সালমা ইসলাম এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসরিন জাহান রত্মার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে, রওশন এরশাদের চেয়ারম্যান করা সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে অবগত নন অপর প্রেসিডিয়াম সদস্য সফিকুল ইসলাম সেন্টু। তিনি বলেন, বছর খানেক আগে ম্যাডাম যখন চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেন তখন তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। তখন একটা জায়গা স্বাক্ষর করেছিলাম। সম্ভবত ওই স্বাক্ষরটাকেই ব্যবহার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বেগম রওশন এরশাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তার ছেলে শাদ এরশাদ এমপি, বিরোধী দলীয় নেতার মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশিদকে ফোন দিলেও রিসিভ করেননি। তবে, বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘আমি জানি না, ম্যাডামও জানেন না (রওশনের চেয়ারম্যান হওয়া), ম্যাডাম জানলে তো আমি জানব, আমি জানলে ম্যাডাম জানবেন। এটা কেউ করাইছে।’
তিনি বলেন, অ্যাক্টিং চেয়ারম্যান কিভাবে হতে হয়, এটা আমাদের গঠনতন্ত্রে ক্লিয়ার লেখা আছে। ডিক্লিয়ার করলেই তো হবে না। গঠনতান্ত্রিকভাবে হতে হবে, মিটিং ডাকতে হবে, লোকজন থাকতে হবে। আর আমার মাথায় তো ভূত চাপেনি যে, এভাবে তাকে চেয়ারম্যানক করে ঘোষণা দেব।’
রওশন এরশাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা সংক্রান্ত চিঠিটির বিষয়ে শাদ এরশাদ ও কাজী মামুন অবগত কিনা-জানতে চাইলে গোলাম মসীহ বলেন, শাদ জানে না। মামুন সাহেব জানে কিনা বলতে পারবো না।
নাম না প্রকাশে একাধিক জাপা নেতা বলছেন, জিএম কাদের যখন আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে কথা বলছেন তখন একটি মহল এটিকে ভালোভাবে নিচ্ছে না। দল থেকে বহিষ্কৃত কিছু নেতা ম্যাডামকে ভুল বুঝিয়ে অতীতেও নানা কিছু করার চেষ্টা করেছেন। ম্যাডামকে অন্ধকারে রেখে হয়তো তারাই তাকে চেয়ারম্যান করা সংক্রান্ত চিঠি শেয়ার করেছে।