নানামুখী তৎপরতায়ও ডলারের মূল্যে শৃঙ্খলা ফেরেনি। ব্যাংক কিংবা মানিচেঞ্জার কোথাও ঘোষিত মূল্যে ডলার বিক্রি হচ্ছে না। ক্রেতাদের কাছে বেশি দামে ডলার বিক্রি করে দেখানো হচ্ছে কম দাম। গতকাল রাজধানীর বেশির ভাগ মানি এক্সচেঞ্জে ডলার বিক্রি হয়েছে ১১৬.৫০ টাকা ১১৭ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু নিজস্ব সাইনবোর্ড ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাঠানো তথ্যে তারা দেখিয়েছে সর্বোচ্চ ১১১.৫০ টাকা। ব্যাংকগুলোতেও নির্ধারিত দামে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, নতুন এলসি খোলা এবং আগের এলসি নিষ্পত্তিতে ১১৫ টাকা পর্যন্ত আদায় করছে ব্যাংকগুলো। কেউ সংকট পুঁজি করে, আবার কেউ কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ইচ্ছামতো ডলারের দাম আদায় করছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে আমদানি ব্যয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দিয়ে সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এতে সংকট আরও বেড়ে যায়। পরে এই দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনকে (বাফেদা)। এরপর কয়েক দফা রেমিট্যান্স ও রপ্তানিতে ডলারের দাম বাড়ানো হয়েছে। সেই সঙ্গে গত দুই মাস ধরে আন্তঃব্যাংক ও আমদানিতে ডলারের সর্বোচ্চ দাম বেঁধে দেওয়া হচ্ছে।
সর্বশেষ গত ৩১ জুলাই এবিবি ও বাফেদা মিলে রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়, আন্তঃব্যাংক ও আমদানিতে ডলারের দাম আবারও বাড়িয়েছে, যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হয়। ওই ঘোষণা অনুযায়ী, এখন থেকে রপ্তানিকারকরা রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম পাচ্ছেন ১০৮.৫০ টাকা, আগে যা ছিল ১০৭.৫০ টাকা। প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয় ১০৯ টাকা, যা আগে ছিল ১০৮.৫০ টাকা। আর আন্তঃব্যাংক ও আমদানিতে ডলারের সর্বোচ্চ দাম ১০৯.৫০ টাকা বেঁধে দেওয়া হয়। তবে অনেক ব্যাংকেই ঘোষিত দরে ডলার মিলছে না। এক্ষেত্রে কারসাজির আশ্রয় নিচ্ছে অনেকে।
গত বৃহস্পতিবার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পোলট্রি খাতের সংগঠন ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) সহসভাপতি আনোয়ারুল হক অভিযোগ করেন, ‘সবাই বলছে কোনো কারণ ছাড়াই আমরা ডিম ও মুরগির দাম বাড়াচ্ছি। কিন্তু জানেন ডলারের দাম কত? এখন বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকবেন দেখবেন ১০৯.৫০ টাকা। কিন্তু আমি নিজে আমদানির জন্য একটি বেসরকারি ব্যাংকে ডলার রেট দিয়েছি ১১৪ টাকা ৫০ পয়সায়। এক
ডলারে ৫ টাকা বেশি নিচ্ছে এটা কে বহন করবে?’ এর আগে গত জুনে ব্যবসায়ী ও শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিনও ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে প্রায় একই অভিযোগ করেন।
তবে নির্ধারিত দামের বেশি নেওয়ার কথা তদন্তে প্রমাণিত হলে ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে। অস্থিরতা ঠেকাতে নিয়মিত রিজার্ভ থেকেও ব্যাংকগুলোতে ডলার সরবরাহ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গতকাল আন্তঃব্যাংকে ডলারের সর্বোচ্চ দাম ছিল ১০৯.৫০ পয়সা। আর সর্বনিম্ন দাম ছিল ১০৯.৪৫ টাকা। আর আন্তঃব্যাংকে যদি ডলারের সর্বোচ্চ দাম ১০৯.৫০ টাকা হয়, তাহলে আমদানি বিল নিষ্পত্তিতেও তা সর্বোচ্চ ১০৯.৫০ টাকাই হওয়ার কথা। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক ব্যাংকেই এই ঘোষিত দরে ডলার মিলছে না।
এ বিষয়ে জানতে বাফেদার চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের এমডি আফজাল করিম এবং এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আরএফ হোসেনের মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে তাদের মোবাইলে ও হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ দিয়ে বক্তব্য চাওয়া হয়, কিন্তু কেউ রেসপন্স করেননি।
চতুর্থ প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের ব্যাংকে রপ্তানি আয় খুব একটা নেই। আবার রেমিট্যান্সও আমাদের ব্যাংকের মাধ্যমে কম আসে। আবার যেটা আসে সেটার জন্যও নির্ধারিত দামের চেয়েও বেশি দামে আনতে হয়। ফলে চাইলেও ঘোষিত দরে ব্যবসায়ীদের কাছে ডলার বিক্রি করা সম্ভব হয় না। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা এমনভাবে বলে যে, ডলার তাদের ম্যানেজ করে দিতেই হবে। এক্ষেত্রে বেশি দাম হলেও কোনো সমস্যা নেই। সে ক্ষেত্রে শাস্তির মুখে পড়তে হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, যখন এলসি খোলা হয়, তখন ঘোষিত দরই কাগজে-কলমে দেখানো হয়। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত দরের টাকা অন্য পন্থায় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আদায় করা হয়। ফলে কাগজে-কলমে কোনো প্রমাণ থাকে না।
খোলাবাজারেও কারসাজি : ব্যাংকগুলো যে দরে নগদ ডলার বিক্রি করবে সেটির সঙ্গে সর্বোচ্চ দেড় টাকা যোগ করে ডলার বিক্রি করতে পারবে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো। গতকাল সোনালী ব্যাংক নগদ ডলার বিক্রি করেছে সর্বোচ্চ ১০৯.৫০ টাকায়। এর সঙ্গে দেড় টাকা যোগ করে মানি চেঞ্জাররা সর্বোচ্চ নিতে পারবে ১১১ টাকা। এই রেটে ডলার বিক্রির তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠিয়েছে তারা। গতকাল কয়েকটি মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানে সরেজমিন গিয়ে এই রেটে ডলার মেলেনি। রাজধানীর দিলকুশায় অবস্থিত স্ট্যান্ডার্ড মানি এক্সচেঞ্জ প্রতি ডলার বিক্রি করেছে ১১৬.৫০ টাকায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির অফিসে ঝুলিয়ে রাখা সাদা বোর্ডে ডলার বিক্রির সর্বোচ্চ রেট লিখে রেখেছিল ১১১ টাকা ৫০ পয়সা। আর ডলার কেনার রেট দেওয়া ছিল ১১০ টাকা। জামান মানিচেঞ্জিং হাউস গতকাল ডলার বিক্রি করেছে ১১৬ টাকা ৪০ পয়সায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির সাইনবোর্ডে বিক্রির রেট দেওয়া ছিল সর্বোচ্চ ১১১ টাকা ৫০ পয়সা।
মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মো. হেলাল উদ্দিন শিকদার আমাদের সময়কে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাঠানো রেটের বাইরে কোনো মানি এক্সচেঞ্জ হাউসের ডলার কেনাবেচা করার কথা নয়। তারপরও যদি কেউ এ ধরনের অনিয়ম করে থাকে এবং সেটি যদি প্রমাণিত হয় অবশ্যই সংশ্লিষ্ট মানি একচেঞ্জের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।