দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাতগুলোর সূচক নিম্নগতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। কমে যাচ্ছে ডলারের সংস্থান। কিন্তু ব্যয় কমছে না। এতে প্রতিনিয়তই বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, মাত্র ৯ দিনের ব্যবধানে বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত মজুদ ও মোট মজুদ উভয়ই কমে গেছে যথাক্রমে ৯ কোটি ও ১৮ কোটি মার্কিন ডলার। আগামী মাসে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের দায় (আকুর দায়) পরিশোধ করতে হবে। এতে আরো কমে যাবে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ।
সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুটি খাত রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়াতে না পারলে সামনে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর চাপ আরো বেড়ে যাবে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ আসে রফতানি আয় থেকে। বাকি ২৮ শতাংশ আসে রেমিট্যান্স থেকে। অন্যান্য খাত থেকে আসে মাত্র ২ শতাংশ। ফলে রফতানি ও রেমিট্যান্স এই দুটি খাতে আয় কমে গেলে সার্বিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা চাপে পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, এক মাসের ব্যবধানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুটি খাত রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স কমে গেছে। জুনের তুলনায় জুলাইয়ে দুই খাতে আয় কম হয়েছে। জুলাইয়ে দেশের রফতানি আয় হয়েছে ৪৫৯ কোটি ডলার। জুনে হয়েছিল ৫০৩ কোটি ডলার ও মে মাসে হয়েছিল ৪৮৫ কোটি ডলার। সে হিসাবে মে ও জুনের চেয়ে জুলাইয়ে রফতানি আয় কমেছে। তবে এপ্রিলের তুলনায় বেড়েছে। আবার নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত রফতানি আয় প্রতি মাসে গড়ে ৫০০ কোটি ডলারের উপরে ছিল। সে হিসাবে ওই মাসের তুলনায়ও রফতানি আয় কমেছে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে রফতানি আয় ওঠানামা করছে। এ কারণে সংশ্লিষ্টরা মাসিক ওঠানামাকেই গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। এ দিকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম আরো একটি খাত রেমিট্যান্স প্রবাহও কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার। অথচ গত জুনে এসেছিল ২২০ কোটি ডলার। গত বছরের জুলাইয়ে এসেছিল ২১০ কোটি ডলার। গত জুন ও গত বছরের জুলাইয়ের তুলনায় এ বছরের জুলাইয়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল গত জুনে। এর আগে ২০২০ সালের জুলাইয়ে সর্বোচ্চ ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল। মার্চে ২০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল। এপ্রিল ও মে মাসে তা কমে যায়।
এমন কি রোজার ঈদের মাসেও রেমিট্যান্স কমেছিল। গত অর্থবছরের জুলাই, আগস্ট, মার্চ ও জুন-এ ৪ মাস প্রতি মাসে গড়ে রেমিট্যান্স ২০০ কোটি ডলারের বেশি ছিল। বাকি ৮ মাস প্রতি মাসে গড়ে ২০০ কোটি ডলারের কম এসেছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাত রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমলেও ব্যয় তুলনামূলক কমছে না। বরং ফি মাসেই বকেয়া এলসির দায় পরিশোধ করতে ব্যাংকগুলো হিমশিম খাচ্ছে। ডলারের সংস্থান করতে না পেরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দ্বারস্থ হচ্ছে। কিন্তু রিজার্ভ কমে যাওয়ার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও আর আগের মতো সহযোগিতা করতে পারছে না। ফলে কিছু ব্যাংকের বকেয়া এলসির দায় দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এ দিকে আগামী মাসে আকুর দায়ও পরিশোধ করতে হবে। এমনিতেই প্রকৃত রিজার্ভ ও মোট রিজার্ভ উভয়ই কমে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় আগামী মাসে আকুর দায় পরিশোধ করলে রিজার্ভ আরো কমে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত ৯ আগস্ট বৃহস্পতিবার বৈদেশিক মুদ্রার মোট মজুদ ছিল ২ হাজার ৯৫৩ কোটি ডলার, যেখানে ৯ দিন আগে অর্থাৎ ৩১ জুলাইয়ে যা ছিল ২ হাজার ৯৭১ কোটি ডলার। ৯ দিনের ব্যবধানে রিজার্ভের মোট মজুদ কমেছে ১৮ কোটি ডলার। অথচ গত বছরের ৮ আগস্ট রিজার্ভের মোট মজুদ ছিল ৩ হাজার ৯৫৫ কোটি ডলার। এ হিসাবে এক বছরে মোট রিজার্ভ কমেছে ১ হাজার কোটি ডলারের ওপরে।
আবার প্রকৃত মজুদও কমে গেছে। গত ৯ আগস্ট প্রকৃত মজুদ ছিল ২ হাজার ৩২৬ কোটি ডলার, যেখানে ৩১ জুলাই ছিল ২ হাজার ৩৩৫ কোটি ডলার। এ হিসেবে রিজার্ভের প্রকৃত মজুদ ৯ দিনে কমেছে ৯ কোটি ডলার। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত পরিপালন করতে রিজার্ভের হিসাবে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হয়েছে। আর এ কারণেই প্রকৃত মজুদ কমে গেছে।
তবে, তারা বলেছে, প্রকৃত মজুদ কমপক্ষে ২৪ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার রাখতে হবে। এ হিসাবে আইএমএফের শর্তের নিচেই রয়েছে প্রকৃত রিজার্ভ। আগামী মাসে আকুর দায় পরিশোধ করলে প্রকৃত রিজার্ভ আরো কমে যাবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা আরো চাপে পড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।