সময়ের হিসাবে এখন ভরা মৌসুম ইলিশের। তবে বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে দেখা মিলছে না বাঙালির প্রিয় মাছটির। যা পাওয়া যাচ্ছে, তার দাম আকাশচুম্বী, সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে। নিষেধাজ্ঞা শেষে সাগরে গেলেও জেলেদের জালে ধরা পড়ছে না কাক্সিক্ষত পরিমাণের ইলিশ। ফলে বাজারে গিয়ে হতাশ হতে হচ্ছে ইলিশপ্রেমীদের। বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, গভীর পানির মাছটি পথ হারাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আবাসস্থল পরিবর্তন, ডুবোচরের কারণে ইলিশের অভয়াশ্রমের প্রবেশপথ ভরাট হয়ে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আষাঢ়-শ্রাবণেও পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়া, বর্জ্য থেকে পানি দূষণ, নির্বিচারে ইলিশের পোনা নিধনের কারণে ভরা মৌসুমেও পর্যাপ্ত ইলিশের দেখা মিলছে না।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. আনিছুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইলিশের চলাচল পথ এবং জীবনচক্রে অল্পস্বল্প প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইলিশ গভীর পানিতে দলবদ্ধভাবে চলাচল পছন্দ করে। কিন্তু চাঁদপুরে অসংখ্য চর-ডুবোচর, যত্রতত্র কারেন্ট জালের ব্যবহার ও পানি দূষণের কারণে ইলিশের আসা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থাৎ নিরাপদ আবাসস্থল না হলে এরা আসে না। যে কারণে সাগরে ইলিশ থাকলেও চাঁদপুর অংশে না আসতে পারায় পদ্মা-মেঘনায় কম ধরা পড়ছে। তাই চিহ্নিত অঞ্চলে পরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
তবে দেশের এই শীর্ষ মৎস্য বিজ্ঞানীর মুখে শোনা গেল আশার কথাও। তিনি বলেন, ইলিশের ভরা মৌসুম আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর। আমরা আশা করছি, সামনের অমাবস্যা থেকেই ইলিশ ধরা পড়বে। গেল কয়েক বছর ধরে সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের কারণে প্রতিবছরই এর উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত বছরও ৫ লাখ ৬৭ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ
উৎপাদন হয়েছে। আমরা এখনো আশাবাদী, এ বছর আরও বাড়বে।
রুপালি ইলিশের ঝলকানিতে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রগুলো গত বছর সরগরম ছিল, এ বছর সেগুলো অনেকটাই নীরব। মৎস্য শ্রমিকদের দিনের বেশির ভাগ সময় কাটছে অলসভাবে। তাদের মাঝে সেই প্রাণচাঞ্চল্য নেই। ইলিশের দেখা না মেলায় তাদের আয় কম হচ্ছে, সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে। ইলিশের অভয়াশ্রম সংশ্লিষ্ট নদ-নদী ঘিরে থাকা জেলেদের এখন এমনই অবস্থা।
এক সময় মিঠা পানির ইলিশের জন্যই সর্বত্র পরিচিতি পায় ‘চাঁদপুর’। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে সেই জৌলুসে ভাটা পড়েছে। চাঁদপুর শহরের সবচেয়ে বড় মাছের আড়ত বড়স্টেশন মাছঘাটে গিয়ে দেখা যায়, মাছের তুলনায় ক্রেতা বেশি। কিছু কিছু আড়তদার অল্প পরিমাণ ইলিশ নিয়ে বসে আছেন। অধিকাংশ আড়তে নেই কোনো ইলিশ। যে পরিমাণ ইলিশ ঘাটে এসেছে, তা আধা ঘণ্টার মধ্যেই বিক্রি হয়ে গেছে। গেল বছর এ সময়ে প্রতিদিন ইলিশের সরবরাহ ছিল দুই থেকে আড়াই হাজার মণ। কিন্তু এ বছর তা দাঁড়িয়েছে ১০০ থেকে ২০০ মণ।
মাছঘাটের ইলিশ ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, এবারের জাটকা মৌসুমে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ জাটকা ধরেছে অসাধু জেলেরা। কিন্তু প্রশাসন তাদের কিছুই করতে পারেনি। যে কারণে এবার ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। আমি মনে করি, ইলিশ উৎপাদন বাড়াতে হলে জাটকা ধরা বন্ধ করতে হবে।
দেশের বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র (বিএফডিসি) বরগুনার পাথরঘাটায় দেখা যায়, জেলেরা ঘাটে শতাধিক ট্রলার নোঙর করে রেখেছেন। তারা বৈরী আবহাওয়ার কারণে ট্রলার নিয়ে গভীর সমুদ্রে যেতে পারছেন না। দু-একটি ট্রলার সাগরে গেলেও দু-এক ঝুড়ি মাছ নিয়ে ঘাটে ফিরেছেন। মাছ না থাকায় বন্দরে অলস সময় পার করছেন জেলে ও ব্যবসায়ীরা। এ সময়ে যে পরিমাণ মাছ অবতরণ কেন্দ্রে আসার কথা, তার তিন ভাগের এক ভাগও এবার পাওয়া যাচ্ছে না।
মৎস্য বন্দর ঘুরে রফিকুল ইসলাম, মো. লিটন, জুয়েলসহ কয়েকজন জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সমুদ্রে ইলিশ ধরা না পড়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন তারা। দিনরাত জাল ফেলে যে কয়টি মাছ পাওয়া যাচ্ছে, তা দিয়ে ট্রলারের তেল খরচও হয় না। অনেকে এনজিও ও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ইলিশ বিক্রির টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করবেন। কিন্তু ইলিশ ধরা না পড়ায় দেনাও শোধ করতে পারছেন না।
বন্দরের কয়েকটি ফিশিং ট্রলার মাঝির সঙ্গে আলাপ হলে তারা জানান, দুই মাস নিষেধাজ্ঞা শেষে প্রথম সপ্তাহ মোটামুটি ভালো ইলিশ ধরা পড়েছে। এরপর বৈরী আবহাওয়া সৃষ্টি হলে সাগরে ইলিশ ধরা পড়ছে না। তারা বলেন, মালিকের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে তারা সাগরে মাছ ধরেন। মাছ ধরা না পড়ায় এখন ওই টাকা পরিশোধ করতে পারছেন না।
পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার জিএম. মাসুদ শিকদার আমাদের সময়কে বলেন, নিষেধাজ্ঞা শেষে প্রথম সপ্তাহ ইলিশের উৎপাদন বেশ ভালোই ছিল। এরপর আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় প্রায় ১২ দিন ইলিশের উৎপাদন একবারেই কম। এখন ভারী বৃষ্টি হচ্ছে, উপকূলের নদ-নদীতে ইলিশ ধরা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কুয়াকাটাসংলগ্ন সমুদ্রে দীর্ঘ ২৮ বছর ইলিশ মাছ ধরে আসছেন জেলে জাহাঙ্গীর মল্লিক (৪৩)। তিনি জানান, আগে ইলিশের মৌসুম ছিল বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত। কিন্তু বর্তমানে এই সময়ের মধ্যে দুদফা অবরোধ দেয় সরকার। প্রথম ইলিশের প্রজনন মৌসুমে ২২ দিন, এর পরে আরও ৬৫ দিন। কিন্তু একই সময় ভারতের জেলেরা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করে হাজার হাজার টন মাছ শিকার করে নিয়ে যায়। অবরোধে দেশের জেলেরা মাছ ধরতে না পেরে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটায়; কিন্তু ভারতের জেলেরা মাছ ধরে নিয়ে যাওয়ায় ইলিশের উৎপাদন বাড়ে না।
একই এলাকার জেলে জামাল আকন (৫২) ও মো. সোহেল (২৯) জানান, সমুদ্রে যে মাছ পাওয়া যায়, বিক্রির সময় তার শতকরা ১০ ভাগ আড়তদার কমিশন হিসেবে নিয়ে নেয়। গভীর সমুদ্রে ঝড়ের মুখে পড়ে প্রায়ই নৌকা ও জাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এগুলো মেরামতের জন্য সময় অসময়ে নগদ টাকার দারকার হয়। কোনো কোনো সময় মাছ না পড়ায় দিনের দিনের পর শূন্যহাতে সাগর থেকে ফিরতে হয়। তখন বাধ্য হয়ে মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিতে হয়। মৌসুমে যদি মাছ মোটামুটি পড়ে, তাতে যা ইনকাম হয় তা দিয়ে কোনোমতে দিন চলে যায়।
জাহাঙ্গীর (৪৩), জামাল আকন (৫২), সোহেলসহ (২৯) একাধিক জেলে জানান, কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে প্রায় ১৯ কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বে সৃষ্টি হয়েছে চর বিজয় নামক বিশাল এক চরের। স্থানীয়দের কাছে যা হাইরার চর নামে পরিচিত। হাজার হাজার একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এ চর শীতকালে অতিথি পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। পূর্ব-পশ্চিমে ১০ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত এ চরের কারণে রামনাবাদসহ প্রায় ১০টি নদীর মোহনায় পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জেলেরা জানান, উপকূলজুড়ে অসংখ্য ছোটবড় চর জেগে ওঠায় মাছ চলাচলের গতিপথ নষ্ট হয়ে গেছে। এ ছাড়া পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের গরম পানি সরাসরি নদীতে ফেলায় রাবনাবাদ চ্যানেল অচিরেই মাছ শূন্য হবে বলে আশঙ্কা তাদের।
পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম জানান, পটুয়াখালী সমুদ্রসংলগ্ন এলাকা থেকে গত কয়েক বছর ধরে ইলিশ মাইগ্রেট করে কক্সবাজার এবং ভোলা জেলাসংলগ্ন চর কুকরি মুকরি, পটুয়াখালীর সোনার চরের মোহনাগুলো দিয়ে পদ্মা মেঘনায় যাতায়াত করছে। এ কারণে কুয়াকাটাসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে মাছের পরিমাণ কম। তিনি বলেন, এর কারণ নিয়ে বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন। তবে স্বাভাবিক দৃষ্টি ও অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, সমুদ্রের বুকে চর জেগে ওঠার ফলে মাছের গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে। এ ছাড়া বর্ষা দেরিতে আসাকে ইলিশ না পাওয়ার কারণ মনে করছেন তিনি।
এদিকে পদ্মা, মেঘনা ও ধলেশ^রী নদীবেষ্টিত জেলা মুন্সীগঞ্জ। এ জেলার মৎস্যজীবীরা বলেন, ইলিশ গভীর জলের মাছ। কিন্তু পদ্মা নদীর গভীরতা কম ও পদ্মা নদীর মুখ ভাষানচরে নাব্য সংকটের কারণে ইলিশ আসছে না।
লৌহজং উপজেলার জেলেদের মহাজন রুহুল আমিন দেওয়ান আমাদের সময়কে বলেন, পদ্মা নদীর প্রধান মুখ ভোলার ভাষানচর। ওখানে নাব্য সংকট দেখা দিয়েছে। ইলিশ মাছ চলাচলের জন্য পানির প্রয়োজন ৪০ থেকে ৫০ হাত। সেখানে মাত্র ৫ থেকে ৭ হাত হবে।
মাওয়া মৎস্য আড়তের সাধারণ সম্পাদক হামিদুল ইসলাল বলেন, একসময় দুই থেকে ৩ কোটি টাকার ইলিশ বিক্রি হতো। ককেক বছর ধরেই এ রকম বাজার আর পাচ্ছি না।
ইলিশ মাছ উৎপাদনে বিখ্যাত এলাকার একটি রাজবাড়ী। এ জেলার ৫ উপজেলার মধ্যে ৪টি পদ্মা ও একটি গড়াই নদীবিধৌত। পদ্মা নদীর পাশাপাশি গড়াই নদীতেও মিলত প্রচুর ইলিশ। কিন্তু দিন দিন রাজবাড়ীতে ইলিশের উৎপাদন কমতে শুরু করেছে।
রাজবাড়ী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মশিউর রহমান বলছেন, পদ্মার রাজবাড়ীর অংশসহ উজানে মাত্রাতিরিক্ত পলি পড়ে অসংখ্য ডুবোচর সৃষ্টি, দখল-দূষণসহ নানা কারণে ইলিশের অবাধ বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে দিন দিন রাজবাড়ীতে কমছে ইলিশের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের মতে, তিনটি কারণে দেশে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমছে। প্রথমত, সাগর থেকে নদী-মোহনায় ইলিশ আসার পথে অনেক ধরনের বাধা তৈরি হয়েছে। মেঘনা অববাহিকা এখন ইলিশের সবচেয়ে বড় বিচরণকেন্দ্র। দেশে সারা বছরে যে পরিমাণে ইলিশ হয়, তার ৫৬ শতাংশ আসে বঙ্গোপসাগর থেকে। ৩০ শতাংশ মেঘনা অববাহিকায় ও বাকি ৪ শতাংশ পদ্মা নদী থেকে আসে। সাগর থেকে মেঘনায় ইলিশের ঝাঁক আসার পথে কমপক্ষে দেড়শ ডুবোচর তৈরি হয়েছে। এসব চরের কারণে ইলিশ ততটা আসতে পারছে না।
দ্বিতীয়ত, মেঘনা থেকে পদ্মা পর্যন্ত বিশাল এলাকাজুড়ে দূষণ বেড়েছে। একই সঙ্গে নদীতে মাছের জন্য প্রয়োজনীয় জৈবখাদ্য কমেছে। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাবে, গত চার বছর খাদ্যের পরিমাণ কমার হার ৬ শতাংশ। আর দূষণের কারণে ইলিশ নদীতে আসছে না, এলেও দ্রুত সরে যাচ্ছে। ফলে নদীতে ইলিশ কম আসছে। তৃতীয়ত, দেশের বর্ষাকালের ধরনে পরিবর্তন এসেছে। বর্ষার নতুন পানি ও জোয়ার-ভাটার কারণে ইলিশ এ সময়ে সাগর থেকে নদীতে বেশি আসে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, গত বছর জুলাই মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৮ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। এ বছর জুলাইয়ে বৃষ্টি ৫০ শতাংশ কমেছে। বৃষ্টি কম থাকায় ইলিশও কম ধরা পড়ছে।