মানুষ যা আয় করে তার সবটাই খরচ করে না। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কিছু অর্থ সঞ্চয়ও করে। মানুষ যে টাকা সঞ্চয় করে, সেটা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত হিসেবে জমা রাখে। কিন্তু গত বছরের জুন থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মানুষের মধ্যে নগদ টাকা হাতে রাখার প্রবণতা ছিল অস্বাভাবিক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুন পর্যন্ত ব্যাংকের বাইরে তথা মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা, যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ।
তথ্যমতে, গত এক বছরে মানুষের হাতে নগদ টাকা বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৫৫ হাজার কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধির হার প্রায় সাড়ে ২৩ শতাংশ। এর মধ্যে শুধু সর্বশেষ জুন মাসে ব্যাংকের বাইরের টাকার প্রবাহ বেড়েছে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা বা ১৪ শতাংশ। দেশের মোট প্রচলনে থাকা মুদ্রা থেকে ব্যাংকে জমানো টাকা বাদ দিয়ে প্রতি মাসে এই সংখ্যা বের করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল জুন মাসের তথ্য প্রকাশ করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও আস্থা সংকটে দেশের মানুষের মধ্যে টাকা হাতে রাখার প্রবণতা অস্বাভাবিক বেড়েছে। তবে এমন এক সময় মানুষের হাতে নগদ টাকার প্রবাহ বেশি রয়েছে, যখন ব্যাংক খাতের আমানতের প্রবৃদ্ধিতেও তেমন গতি নেই। এর ফলে কিছু কিছু ব্যাংক তারল্য সংকটেও ভুগছে। এটাকে দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংক খাতের জন্য অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন তারা।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছরের শেষ দিকে কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের খবর জানাজানি হওয়ার পর ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো থেকে টাকা তুলে নিতে থাকেন গ্রাহকরা। আবার ব্যাংকে নতুন আমানত আসাও কমে যায়। এতে ওই ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার সংকট তৈরি হয়।
এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এতে জীবনযাত্রার খরচ বেড়েছে। কিন্তু একই সময়ে মানুষের আয় খুব একটা বাড়েনি। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে ব্যাংকে আমানতের সুদের হার যেভাবে বাড়ার কথা, সেভাবে বাড়েনি। এতে ব্যাংকে টাকা রেখে প্রকৃত অর্থে সুদ পাচ্ছে না আমানতকারীরা। ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে একদিকে মানুষ টাকা তুলে খরচ করছে, অন্যদিকে কম সুদ মেলায় ব্যাংকে নতুন আমানতও আসা কমে গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, গত জুনে দেশে সাধারণ মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এটি আগের মাসেও ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত জুনে ব্যাংক খাতে গড় সুদহার ছিল ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। আগের মাস মে মাসে ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। তবে এই সুদ বা মুনাফা পুরোটাই আমানতকারীরা পাননি। কারণ মুনাফা থেকে নানা রকম ভ্যাট-ট্যাক্স কেটে রাখা হয়। এর মানে প্রকৃত আয় মূল্যস্ফীতির অর্ধেকেরও নিচে নেমে গেছে। এ কারণে মানুষ যেটুকু আয় করছে, তার একটি অংশ ব্যয় করছে। কিছু অংশ হাতে রাখছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ব্যাংকের বাইরে বেশি অর্থ থাকার মূল কারণই উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও আস্থার সংকট। গত এক বছরে সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে। আবার মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদ বাড়ায়নি। এর ফলে মানুষের ব্যাংকে আমানত রাখাও কমে গেছে। এছাড়া গত বছরের শেষদিকে কয়েকটি ব্যাংকের অনিয়মের জেরেও মানুষের মধ্যে নতুন করে আস্থার সংকট তৈরি হয়। ফলে ওই সময় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো থেকে রেকর্ড পরিমাণ আমানত তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এসব আমানতের একটা অংশ এখনো ব্যাংক ব্যবস্থায় ফিরেনি। তবে শেষ মাসে ব্যাংকের বাইরে বেশি টাকা যাওয়ার কারণ হিসেবে কোরবানির ঈদের খরচের কথা উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুন শেষে দেশের ব্যাংকগুলোতে মোট আমানত রয়েছে ১৫ লাখ ৯৪ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। এর বেশির ভাগই আছে মেয়াদি আমানত হিসেবে। এ সময়ে মেয়াদি আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৯৫ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। আর চাহিদা আমানতের (স্বল্পমেয়াদি ও চলতি) পরিমাণ ১৯ লাখ ৯৩ হাজার ৪ কোটি টাকা।
অন্যদিকে একই সময়ে ব্যাংকের বাইরে অর্থাৎ দেশের মানুষের হাতে নগদ টাকা রয়েছে প্রায় ২ লাখ ৯১ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ২ লাখ ৩৬ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা। ফলে এক বছরে মানুষের হাতে নগদ অর্থ বেড়েছে প্রায় ৫৫ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা, যা শতকরা ২৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এর মধ্যে গত জুন মাসেই নগদ টাকা বেড়েছে প্রায় ৩৬ হাজার ৮৩ কোটি টাকা বা ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত- এক বছরে ব্যাংকের বাইরে তথা মানুষের হাতে নগদ টাকার প্রবাহ বেড়েছিল মাত্র ২৬ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ৮৫ শতাংশ। আর ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরে মানুষের হাতে নগদ টাকা বাড়ে মাত্র ১৭ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। এর মানে গত এক বছরেই ব্যাংকের বাইরে তথা মানুষের হাতে নগদ টাকার প্রবাহ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, মানুষের হাতে যখন নগদ টাকার পরিমাণ বেড়ে গেছে, তখন ব্যাংকিং খাতে সামগ্রিক আমানতের প্রবৃদ্ধিও কম হচ্ছে। গত জুনে এই খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। অথচ দেশে করোনার আঘাত আসার আগে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বার্ষিক আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৮২ শতাংশ। সে প্রবৃদ্ধি বাড়তে বাড়তে ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১৪ দশনিক ৪৭ শতাংশে উঠেছিল। কিন্তু এরপর থেকেই কমতে থাকে আমানতের প্রবৃদ্ধি, যা গত বছরের ডিসেম্বরে সর্বনিম্ন ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশে নেমে এসেছিল। তবে গত কয়েক মাস ধরে এই প্রবৃদ্ধির ধারা কিছুটা ইতিবাচক হয়েছে, যদিও তা কাক্সিক্ষতহারের চেয়ে অনেক কম বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন।